প্রত্যেক মানুষের গলায় দুইটি ছোট বলের মতো অঙ্গ রয়েছে যাকে টনসিল (Tonsils) বলা হয়। 

টনসিল মানুষের শরীরের ইমিউন সিস্টেমের একটি অংশ যা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণ হলে টনসিলে প্রদাহ হয় যা মেডিকেলের ভাষায় টনসিলাইটিস (Tonsillitis) নামে পরিচিত।

তবে সাধারণ মানুষ টনসিলাইটিসকে সহজভাবে টনসিল বলে থাকেন এবং এই অনুচ্ছেদে টনসিল বলতে টনসিলাইটিসকেই বোঝানো হয়েছে। 

টনসিল হওয়ার কারণ, লক্ষণ, ধরন, ঘরোয়া চিকিৎসা, ঔষধ ইত্যাদি বিষয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও টনসিলের চিকিৎসা করা না হলে সম্ভাব্য কি কি জটিলতা হতে পারে এবং কখন একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত সেই বিষয়ে জানতে একদম শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

টনসিল কেন হয়?

টনসিলের সমস্যা সাধারণত ছোট বাচ্চাদের (৫ থেকে ১৫ বছর) ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। কারণ, টনসিল অঙ্গটি ছোটদের শরীরে একটিভ বা কার্যকর অবস্থায় থাকে এবং রোগজীবাণু প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করে। কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রে টনসিল প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আর তাই বড়দের ক্ষেত্রে টনসিলের সমস্যা হওয়ার ঘটনা খুব কম দেখা যায়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টনসিল ইনফেকশনের কারন থাকে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া।‌ তবে কদাচিৎ সাইনুসাইটিস ও হে ফিভার (Hay fever) এর প্রভাবে টনসিলে সমস্যা হতে পারে। টনসিল হওয়ার জন্য দায়ী ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া গুলো হলোঃ (Newman, 2019)

ভাইরাস

  • Adenovirus
  • Rhinovirus
  • Influenza
  • Respiratory syncytial virus

ব্যাকটেরিয়া

  • Streptococcus pyogenes
  • Staphylococcus aureus
  • Mycoplasma pneumonia
  • Chlamydia pneumonia
  • Bordetella pertussis
  • Fusobacterium
  • Neisseria gonorrhoeae

টনসিলের লক্ষণ 

টনসিলের সবচেয়ে কমন লক্ষণগুলো হলোঃ 

  • গলা ব্যথা (sore throat) বিশেষ করে খাবার গিলতে বেশি ব্যথা‌ হয়
  • টনসিল ফুলে যায় ও লাল হয়  
  • জ্বর ও শীত বোধ (Chills)
  • কাশি 
  • মাথাব্যথা 
  • কানে ব্যথা
  • ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট

বিরল লক্ষণ

  • ক্লান্তি 
  • বমি বমি ভাব 
  • বমি হওয়া
  • পেট ব্যথা 
  • কথা বলতে সমস্যা হয় 
  • মুখে দুর্গন্ধ হয় 
  • জিহ্বার উপর প্রলেপ পড়ে 

টনসিলের ধরন 

টনসিলের লক্ষণ কতদিন যাবত স্থায়ী হচ্ছে এবং আক্রমণের প্রকৃতি কেমন তার উপর ভিত্তি করে টনসিল ধরনের হয়ে থাকে।

১. একিউট টনসিলাইটিস (Acute tonsillitis)

হঠাৎ আক্রমণ হয় এবং লক্ষণ তীব্র ভাবে দেখা দেয়। তবে ৩ থেকে ৪ দিনের ভেতরে ভালো হয়ে যায়। এই ধরনের টনসিল সর্বোচ্চ ২ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। 

২. টনসিলাইটিসের পুনঃসংক্রমণ (Recurrent tonsillitis)

মাঝে মধ্যেই টনসিলের সমস্যা হয় তবে বেশি দিন স্থায়ী হয় না। ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। বছরে কয়েকবার এমন সমস্যা হয়ে থাকে। 

৩. ক্রনিক টনসিলাইটিস (Chronic tonsillitis)

টনসিল ফুলে থাকে এবং লক্ষণ খুব বেশি তীব্রতর হয় না। তবে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা থাকে এবং মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। 

 

গলায় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে তাকে Strep throat বলা হয় যার লক্ষণ অনেকটা টনসিলের মতো।‌‌ যেমনঃ গলা ব্যথা, জ্বর ও খাবার গিলতে সমস্যা হয়। তবে টনসিল এবং গলায় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দুইটি সম্পূর্ণ আলাদা রোগ। 

 

টনসিলের ঘরোয়া চিকিৎসা কি?

একিউট টনসিলের প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ তীব্র সমস্যা শুরু না হলে কতিপয় ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা টনসিল নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।‌ যেমনঃ (Newman, 2019) 

  • যতটা সম্ভব বিশ্রামে থাকতে হবে যেন শরীরের এনার্জি সঞ্চিত হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শরীরকে সুস্থ করতে পারে।
  • শরীরে রোগ জীবাণুর আক্রমণ হলে স্বাভাবিকের তুলনায় পানির চাহিদা কিছুটা বেড়ে যায়। আর তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে।  
  • শক্ত খাবার গিলতে সমস্যা হলে যতটা সম্ভব নরম ও তরল খাবার (স্যুপ) খেতে হবে। 
  • চাকফি পান করা উপকারী হবে। তবে চা ও কফিতে চিনির পরিমাণ একদম কম হওয়া উচিত।
  • গরম পানিতে আদা ও লেবুর রস মিশিয়ে পান করা হলে ব্যথা কমে যাবে। 
  • ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যেমনঃ লেবু, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুর, পেঁপে, স্ট্রবেরি ইত্যাদি।  
  • কুসুম গরম পানিতে একটু লবণ মিশিয়ে গড়গড়া (Gurgle) করলে ব্যথা কমে যাবে। দিনে কয়েকবার গড়গড়া করা যেতে পারে।
  • গলার উপরিভাগে গরম সেঁক দিলে তা ব্যথা কমাতে সহায়তা করবে। 
  • ধুমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, ধুমপান করলে গলার ব্যথা ও প্রদাহ বেড়ে যেতে পারে। 
  • যতটা সম্ভব কম কথা বলতে হবে। 

টনসিল এর ঔষধ

টনসিলের সমস্যা দূর করার জন্য ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বনের পাশাপাশি কিছু ওটিসি‌ (OTC- over the counter) ঔষধ সেবন করা যেতে পারে এবং এর জন্য ডাক্তারের নির্দেশনার প্রয়োজন হবে না। এক্ষেত্রে ব্যথা ও জ্বর কমানোর জন্য যেসব ঔষধ সেবন করা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে তা হলোঃ 

  • Paracetamol (Napa®, Ace®, Depyrin®, Fast®, Renova®)
  • Ibuprofen (Advel®, Profen®, Reumafen®, Intaflam®) 

 

জ্বর বেশি থাকলে সেক্ষেত্রে প্যারাসিটামল (Paracetamol) ট্যাবলেট ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় দিনে ৩ থেকে ৪ বার কমপক্ষে ৬ ঘন্টা ব্যবধানে ভরা পেটে খেতে হবে। ১২ বছরের কম বয়সীদের জন্য অর্ধেক ট্যাবলেট এবং ৫ বছরের কম বয়সী‌দের জন্য সিরাপ জাতীয় ঔষধ দিতে হবে।

 

জ্বর কম কিন্তু ‌গলা ব্যথা বেশি থাকলে প্যারাসিটামল না খেয়ে বরং আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) ট্যাবলেট ৪০০ মিলিগ্রাম দিনে ৩ বার ভরাপেটে সেবন করতে হবে। আর ছোট বাচ্চাদের (১২ বছরের কম) জন্য সিরাপ জাতীয় ঔষধ খাওয়ানো উচিত।

সম্ভাব্য জটিলতা 

ভাইরাস জনিত টনসিলের সমস্যায় তেমন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয় না। ঘরোয়া চিকিৎসা এবং ওটিসি মেডিসিন সেবনের মাধ্যমে ১ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। 

তবে ব্যাকটেরিয়া জনিত টনসিল সহজে ভালো হতে চায় না।‌ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ গুরুতরভাবে হলে যথাযথ এন্টি বায়োটিক ঔষধ সেবন না করলে লক্ষণ তীব্রতর হতে থাকে। এছাড়াও আরো যেসব জটিলতা হতে পারে তা হলোঃ 

  • টনসিলের ভেতর পুঁজ জমে যায়
  • গলায় ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং খাবার গিলতে খুব সমস্যা হয়ে থাকে
  • ঘুমের সময় শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হয় যাকে মেডিকেলের ভাষায় Obstructive sleep apnea বলে
  • স্কারলেট জ্বর হয় (scarlet fever)
  • ব্যাকটেরিয়া শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে বাতজ্বর, হার্টের রোগ ও কিডনির ‌সমস্যা হতে পারে 

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন? 

ব্যাকটেরিয়া নাকি ভাইরাসের সংক্রমণে টনসিল হয়েছে তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা খুব কঠিন। আর তাই টনসিলের সম্ভাব্য জটিলতা এড়ানোর জন্য কতিপয় লক্ষণ দেখা দিলে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে যেন চিকিৎসক টেস্ট করার মাধ্যমে সংক্রমণের ধরন বুঝতে পারেন। যেসব লক্ষণের জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে তা হলোঃ (Kaneshiro, 2022) 

  • শিশুর মুখ‌ থেকে অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ হওয়া
  • ১০১° ফারেনহাইটের বেশি জ্বর 
  • খাবার গিলতে এবং শ্বাস প্রশ্বাসের ক্ষেত্রে খুব বেশি সমস্যা হওয়া 
  • গলার আশেপাশে ও কানের নিচের দিকে লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া অর্থাৎ ছোট ছোট গোটার মতো ফোলাভাব দেখা গেলে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ (ইএনটি স্পেশালিস্ট) এর শরণাপন্ন হতে হবে। 

টনসিল নির্ণয়

সর্বপ্রথম চিকিৎসক রোগীর মুখে রোগ লক্ষণের বর্ণনা শুনবেন। অতঃপর গলার আশেপাশে, কানের নিচে, গলার ভেতর ও জিহ্বা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। ভাইরাস নাকি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ তা নির্ণয়ের জন্য গলার ভেতর থেকে শ্লেষ্মা (swab) বা শরীর থেকে রক্ত সংগ্রহ করে পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হবেন।‌ 

টনসিলের চিকিৎসা 

ভাইরাস জনিত টনসিলের জন্য চিকিৎসক উপরে উল্লেখিত ঔষধ সেবন করা, বিশ্রামে থাকা এবং ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে ব্যাকটেরিয়া জনিত টনসিলের ক্ষেত্রে এন্টি বায়োটিক (Antibiotics) ঔষধ প্রেসক্রাইব করেন। 

গলা ব্যথা দূর হয়ে গেলে অথবা টনসিলের ফোলাভাব কমে গেলেই এন্টি বায়োটিক সেবন বন্ধ করা যাবে না।‌ চিকিৎসকের নির্দেশনা মোতাবেক এন্টি বায়োটিক ঔষধের ডোজ সম্পূর্ণ করতে হবে এবং অবশ্যই নিয়ম মেনে নির্ধারিত সময়ে ঔষধ সেবন করতে হবে। 

 

এন্টি বায়োটিক ঔষধের ডোজ সম্পূর্ণ না করলে এন্টি বায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হতে পারে অর্থাৎ পরবর্তীতে শরীরে আর এন্টি বায়োটিক ঔষধ কাজ করবে না।  

 

টনসিলের পুনঃসংক্রমণ, ক্রনিক টনসিল বা শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা বেশি হলে সেক্ষেত্রে সার্জারির মাধ্যমে টনসিল কেটে ফেলে দেওয়া হয়। টনসিল কেটে ফেলে দিলে শরীরের জন্য তেমন কোনো ক্ষতি হয় না।

টনসিল প্রতিরোধে করণীয় 

টনসিল একটি সংক্রামক রোগ অর্থাৎ এই রোগের জীবাণু একজন অসুস্থ ব্যক্তির শরীর থেকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে মারাত্মক পর্যায়ের ছোঁয়াচে নয় যেমনটি করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।‌ 

টনসিল প্রতিরোধে নিচে উল্লেখিত নিয়ম গুলো মেনে চলতে হবে। (Dunkin, 2022) 

  • টয়লেট ব্যবহারের পর এবং খাবার খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুতে হবে
  • ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র (কাপড়, তোয়ালে, ব্রাশ ইত্যাদি) কারো সাথে শেয়ার করা যাবে না
  • হাঁচি কাশি দেওয়ার সময় রুমাল বা কনুইয়ের সাহায্যে মুখ ঢেকে নিতে হবে
  • গলা ব্যথা বা টনসিলে‌ আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে
  • শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য নিয়মিত ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে। 

 

References

Dunkin, M. A. (2022, August 30). Tonsillitis. Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/oral-health/tonsillitis-symptoms-causes-and-treatments

Kaneshiro, N. K. (2022, February 10). Tonsillitis. Retrieved from Penn Medicine: https://www.pennmedicine.org/for-patients-and-visitors/patient-information/conditions-treated-a-to-z/tonsillitis

Newman, T. (2019, November 07). All you need to know about tonsillitis. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/156497

 

 

Last Updated on April 8, 2023