ইসবগুলের ভুসি (Psyllium husk) হলো ফাইবার জাতীয় একটি খাবার যা অনেকেই কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য খেয়ে থাকেন। তবে শুধু কোষ্ঠকাঠিন্য নয়, বরং ইসবগুলের ভুসি শরীরের জন্য আরো অনেক উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। 

মূলত ভারতে উৎপন্ন হলেও পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ইসবগুলের ভুসি পাওয়া যায়। এই অনুচ্ছেদে ইসবগুলের ভুসির স্বাস্থ্যগত উপকারিতা এবং খাওয়ার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও ইসবগুলের ভুসির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং গর্ভবতী নারীদের জন্য খাওয়া যাবে কিনা তা জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

ইসবগুলের ভুসির স্বাস্থ্যগত উপকারিতা 

বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার স্বাস্থ্যগত যেসব উপকারিতা সম্পর্কে জানা গেছে তা নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো। (Semeco, 2023) 

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে 

কোষ্ঠকাঠিন্য একটি যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা যা বিশেষ করে বৃদ্ধ মানুষের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। দীর্ঘদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে তা পাইলসএনাল ফিশারের মতো জটিল রোগ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

গবেষণায় দেখা গেছে যে, দীর্ঘদিন যাবত কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দিনে ২ বার ৫ গ্রাম পরিমাণে ইসবগুলের ভুসি দুই সপ্তাহ ধরে খাওয়ার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়ে গেছে। 

ইসবগুলের ভুসি প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ সমৃদ্ধ যা অন্ত্রের (Intestine) মধ্যে গিয়ে পানি শোষণ করে খাবারের অবশিষ্ট অংশের সাথে মিশে নরম মল তৈরি এবং মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। যাদের পাইলস বা এনাল ফিশারের সমস্যা রয়েছে এবং মলের প্রকৃতি শক্ত বা নিয়মিত মলত্যাগ হয় না তাদের জন্য প্রতিদিন ইসবগুলের ভুসি খাওয়া অনেক উপকারী হবে। 

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য প্রতিদিন সকালে ও রাতে খাবার খাওয়ার পরে ১ থেকে ২ চা চামচ পরিমাণ ইসবগুলের ভুসি একগ্লাস পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে। মনে রাখবেন, ইসবগুলের ভুসি পানিতে দীর্ঘ সময় ধরে ভিজিয়ে রাখা যাবে না এবং পানিতে চিনি যোগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, চিনি তথা সরল শর্করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

ডায়রিয়ার রোগীদের জন্য উপকারী  

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ইসবগুলের ভুসি যেমন উপকারী তেমনিভাবে ডায়রিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রেও ইসবগুলের ভুসি খাওয়া উপকারী হবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ইসবগুলের ভুসি খাওয়া ডায়রিয়া নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থাৎ ইসবগুলের ভুসি খেলে অন্ত্রের ভেতর এমন প্রকৃতির মল তৈরি হয় যা কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো শক্ত নয় আবার ডায়রিয়ার মতো তরল প্রকৃতিরও নয়। 

ডায়রিয়া জনিত পাতলা পায়খানা হওয়ার পর খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি ১ চা চামচ ইসবগুলের ভুসি একগ্লাস পানিতে গুলিয়ে খাওয়া হলে তা ঘন ঘন মলত্যাগের সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে। 

পেটের দীর্ঘস্থায়ী রোগ আইবিএসের (IBS– Irritable bowel syndrome) রোগীদের ক্ষেত্রে কখনো কোষ্ঠকাঠিন্য আবার কখনো ডায়রিয়া দেখা যায়। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নিয়মিত ইসবগুলের ভুসি খাওয়া অনেক উপকারী হবে। (Singh, 2023)

হার্টের জন্য উপকারী 

গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ১০ গ্রাম পরিমাণ ইসবগুলের ভুসি ৩ সপ্তাহ ধরে খাওয়ার ফলে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের (LDL- low density lipoprotein) মাত্রা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। রক্তে LDL এর মাত্রা বেশি থাকলে তা উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাকস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। 

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে হার্টের রোগের ঝুঁকি কমাতে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ গ্রাম পরিমাণ ইসবগুলের ভুসি খেতে হবে। যারা কোলেস্টেরল কমানোর জন্য ওষুধ (Statin) সেবন করেন তারাও ইসবগুলের ভুসি খেতে পারবেন। 

এর পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিশেষ করে ক্ষতিকর ফ্যাট যুক্ত খাবার বর্জন করা জরুরী। যেমনঃ গরু ও খাসির মাংস, পনির, ঘি, মাখন, পাম অয়েল, পোড়া তেলে ভাজা খাবার, ফাস্টফুড, পটেটো চিপস, প্রক্রিয়াজাত খাবার ইত্যাদি।  

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে 

image4 2

ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার ফলে হজম প্রক্রিয়ার গতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাওয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ইসবগুলের ভুসি খাওয়া উপকারী হবে। 

প্রতিদিন ১০ গ্রাম পরিমাণ ইসবগুলের ভুসি দিনে ২ বার খাবার খাওয়ার পরে খেতে হবে। আবার কেউ চাইলে খাবার খাওয়ার আগেও ইসবগুলের ভুসি খেতে পারবেন। 

অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে 

ইসবগুলের ভুসিতে কোনো ক্যালরি নেই তবে তা দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখতে সহায়তা করে যা শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ডায়েট কন্ট্রোল করছেন এমন ব্যক্তিদের জন্য বেশ উপকারী একটি খাদ্য উপাদান হতে পারে। 

সকালে ও রাতে খাবার খাওয়ার আগে এক গ্লাস পানিতে ২ চা চামচ ইসবগুলের ভুসি গুলিয়ে খেলে তা ক্ষুধার কমিয়ে দেয়। ওজন কমানোর জন্য ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।  

ক্যান্সার প্রতিরোধ করে 

অলস‌ জীবন যাপন করা, ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার কম খাওয়া, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ, অলস জীবন যাপন এবং শরীরের অতিরিক্ত ওজনের সাথে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়াও দুঃখজনক একটি বিষয় হলো, কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ বোঝা যায় না। আর তাই এই‌ রোগ প্রতিরোধে সচেষ্ট হতে হবে যার মধ্যে একটি প্রচেষ্টা হতে পারে ইসবগুলের ভুসি খাওয়া। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে যে,‌ নিয়মিত ইসবগুলের ভুসি খাওয়া কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।  

ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার সঠিক নিয়ম 

মহিলাদের জন্য দৈনিক খাদ্য তালিকায় সর্বনিম্ন ২৫ গ্রাম এবং পুরুষদের জন্য ৩৮ গ্রাম ফাইবার থাকা উচিত। শরীরে ফাইবারের চাহিদা পূরণের জন্য নিয়মিত ইসবগুলের ভুসি খাওয়া যেতে পারে। তবে শরীরে ফাইবারের চাহিদা মেটানোর জন্য শুধুমাত্র ইসবগুলের ভুসির উপর নির্ভর করা যাবে না। বরং ফাইবার সমৃদ্ধ অন্যান্য খাবার গুলোও খেতে হবে। যেমনঃ আপেল, নাশপাতি, কলা, গাজর, অ্যাভোকাডো, ওটস, বাদাম সহ সবধরনের ফলমূল ও শাকসবজি। 

একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য ৫ থেকে ১০ গ্রাম মাত্রায় দিনে সর্বোচ্চ ৩ বার ইসবগুলের ভুসি খাওয়া যেতে পারে। প্রথমদিকে কম পরিমাণে ইসবগুলের ভুসি খাওয়া শুরু করতে হবে এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে পরিমাণ বাড়াতে হবে। 

ইসবগুলের ভুসি অবশ্যই পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে। কারণ শুকনো অবস্থায় খেলে তা খাদ্যনালীতে আটকে সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার পরে দিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। কারণ পেটের মধ্যে গিয়ে ইসবগুলের ভুসি প্রচুর পরিমাণে পানি শোষণ করে।

স্বাদ বৃদ্ধির জন্য পানিতে ইসবগুলের ভুসি মেশানোর সময় সামান্য পরিমাণে মধু যোগ করা যেতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে চিনি অথবা মধু কোনোটি যোগ করা যাবে না।‌ 

কেউ চাইলে পানির পরিবর্তে দুধের সাথে ইসবগুলের ভুসি মিশিয়ে খেতে পারেন। তবে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স বা আইবিএস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দুধ খাওয়া যাবে না।   

ইসবগুলের ভুসির সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া 

image3 4

ইসবগুলের ভুসি প্রায় সবার জন্যই খাওয়া নিরাপদ হবে এবং এর কোনো জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে ইসবগুলের ভুসি খেলে কিছু সমস্যা দেখা যেতে পারে। যেমনঃ 

  • হজমে সমস্যা 
  • পেটে গ্যাস হওয়া 
  • পেট ফাঁপা ইত্যাদি 

এছাড়াও অতিরিক্ত পরিমাণে বা দীর্ঘদিন ধরে ইসবগুলের ভুসি খেতে থাকলে তা অন্ত্রে ভিটামিন বি১২,‌ জিংক, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, কপার ইত্যাদি শোষণে ব্যাঘাত ঘটায় যার ফলে শরীরে ভিটামিন বা মিনারেলের ঘাটতি জনিত রোগ সৃষ্টি হতে পারে। আর তাই অতিরিক্ত পরিমাণে দীর্ঘদিন ধরে ইসবগুলের ভুসি খাওয়া যাবে না। 

কিছু কিছু ওষুধ সেবনের সময় ইসবগুলের ভুসি খাওয়া হলে তা ওষুধের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। যেমনঃ (Lefton, 2022) 

  • আয়রন ট্যাবলেট 
  • Tegretol (carbamazepine)
  • Lanoxin (digoxin)
  • Glumetza (metformin)
  • Zyprexa (olanzapine) 

আপনাকে যদি কোনো ওষুধ সেবন করতে হয় তবে সেক্ষেত্রে ওষুধের সাথে ইসবগুলের ভুসি খাওয়া যাবে কিনা সেই ব্যাপারে চিকিৎসকের কাছে থেকে জেনে নিন।

গর্ভবতী নারীদের জন্য ইসবগুলের ভুসি খাওয়া যাবে কি? 

গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা যায়। আবার রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য গর্ভবতী নারীদের জন্য আয়রন ট্যাবলেট গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয় যা কোষ্ঠকাঠিন্য সৃষ্টির সাথে জড়িত। তবে গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য ইসবগুলের ভুসি খাওয়া যাবে কিনা সেই ব্যাপারে গবেষণালব্ধ নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই।‌ এছাড়াও শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মায়েদের জন্য ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার ফলে শিশুর উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কিনা তা জানা যায়নি। 

যদিও ইসবগুলের ভুসি একটি নিরাপদ খাদ্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তবে গর্ভাবতী নারী ও স্তন্যদানকারী মায়ের ক্ষেত্রে ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার জন্য একজন গাইনী ডাক্তার বা পুষ্টিবিদের (Dietitian) পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

আমাদের দেশে মুদি দোকান অথবা ভেষজ ওষুধ বিক্রি হয় এমন দোকানে ইসবগুলের ভুসি কিনতে পাওয়া যায়। আবার বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির তৈরি ইসবগুলের ভুসির পাউডার বা ক্যাপসুল রয়েছে যা পেতে হলে ফার্মেসিতে খোঁজ করতে হবে। পাউডার বা ক্যাপসুলের তুলনায় সরাসরি ইসবগুলের ভুসি তুলনামূলক সস্তায় পাওয়া যায়। তবে কার্যকারিতার ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নেই। 

Bibliography

Lefton, J. (2022, September 5). The Health Benefits of Psyllium Husk. Retrieved from Very Well Health: https://www.verywellhealth.com/the-benefits-of-psyllium-89068

Semeco, A. (2023, March 16 ). 7 benefits of psyllium husk. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/318707

Singh, R. (2023, May 02). Isabgol (Psyllium Husk): Uses, Benefits & Side Effects. Retrieved from PharmEasy: https://pharmeasy.in/blog/isabgol-psyllium-husk-uses-benefits-side-effects/#Benefits_of_Isabgol

Last Updated on June 5, 2023