মানব দেহের ত্বক ও চামড়ার নানান সমস্যার মধ্যে স্ট্রেচ মার্কস একটি কমন সমস্যা। প্রায় প্রতিটি মানুষকেই জীবনের কোন না কোন সময়ে স্ট্রেচ মার্কসের সম্মুখীন হতে হয়। এটি হতে পারে যে কোন বয়সে, নারী- পুরুষ নির্বিশেষে। এই স্ট্রেচ মার্কসের খুটিনাটি বিষয় নিয়েই আজকের আলোচনা।
Table of Contents
স্ট্রেচ মার্ক কি?
আমাদের শরীরের চামড়া ও ত্বকের মসৃণতা, টানটান ভাব নির্ভর করে কোলাজেন ও ইলাস্টিন নামক প্রোটিন তন্তুর উপর। যখন কোন কারনে শরীরের চামড়া অনেকখানি প্রসারিত হয়, তখন ত্বকের একদম উপরের লেয়ারের কোলাজেন ও ইলাস্টিনের তন্তুগুলো ছিড়ে ছিড়ে যায়। ফলে ত্বকে ধরে ফাটল। প্রসারিত ত্বক আবার আগের অবস্থায় ফেরত আসলেও, কিংবা না আসলেও এই দাগগুলি রয়ে যায়। সেই ফাটা দাগকেই আমরা বলি স্ট্রেচ মার্কস। সাদা-কালো মেশানো আঁচর দেয়ার মতো কাঁটা কাঁটা দাগ, কোথাও নিচু তো কোথাও উঁচু, কোথাও ডোরাকাটা এমনই দেখতে হয় এই স্ট্রেচ মার্কস।
প্রায় ২৮ রকমের কোলাজেন পাওয়া যায় একজন মানুষের শরীরে। ত্বকে পাওয়া যাওয়া কোলাজেনের কাজ হচ্ছে, ত্বকের নমনীয়তা ও টানটান ভাব ধরে রাখা।
স্ট্রেচ মার্কস কেন হয়?
মানব দেহে স্ট্রেচ মার্কস দেখাঁ দেয়ার কিছু কারণ হলো,
- বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের শরীর হঠাত ছেড়ে দেয়, বা লম্বা হয়ে যায় অনেকে। হঠাত অল্প সময়ে শারীরিক এই প্রসারনে কিশোর-কিশোরীদের বুক, পিঠ, কোমর ও উরুতে হালকা স্ট্রেচ মার্কস দেখা দিতে পারে।
- ওজন বৃদ্ধির ফলে স্ট্রেচ মার্কসের কবলে পড়েন প্রচুর মানুষ। ওজন বাড়লে চামড়ার নিচে চর্বি বাড়ার সাথে সাথে চামড়ার প্রসারণও ঘটে। যার ফলে ত্বকের উপরের লেয়ার ফেটে গিয়ে দেখা দেয় স্ট্রেচ মার্কস।
- স্ট্রেচ মার্কসের সবচেয়ে অনিবার্য কারণ হচ্ছে, গর্ভধারণ। গর্ভাবস্থায় পেটে শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে পেট স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকখানি বড় হয়। প্রসারন হয় পেটের চামড়ারও। সাথে ওজন বৃদ্ধির কারনে বুক, কোমর, উরুর চামড়ারও প্রসারন ঘটে। আর এইসব প্রসারনেরই ফলাফল স্ট্রেচ মার্কস। যা সন্তান জন্মদানের পরেও রয়ে যায়।
- শুধু ওজন বৃদ্ধিতেই যে স্ট্রেচ মার্কস হয়, তা কিন্তু নয়। হঠাত ওজন কমে গেলেও শরীরের প্রসারিত চামড়া ঝুলে গিয়ে দেখা দিতে পারে স্ট্রেচ মার্কস।
- দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড বা কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করলে দেহে হরমোনের তারতম্যে স্ট্রেচ মার্কস দেখা দিতে পারে চামড়ায়।
- কুশিং’স সিনড্রোম বা মারফ্যান সিনড্রোম নামক অসুস্থতায় ভোগা রোগীদের শরীরের চামড়া ও ত্বকের তন্তুগুলো দুর্বল হয়ে যায়। কোথাও ত্বক অস্বাভাবিক বাড়তে পারে, কোথাও ঝুলে পড়তে পারে। ত্বকের এই অস্বাভাবিকতার কারনেও দেখা দেয় স্ট্রেচ মার্কস।
গর্ভধারণের ফলে হওয়া স্ট্রেচ মার্কসকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলা হয়, স্ট্রায়া গ্র্যাভিডেরাম (Striae Gravidarum) ।
স্ট্রেচ মার্কসের লক্ষণগুলি কী কী?
হুট করেই একদিন ঘুম ভেঙ্গে দেখলেন, ত্বকে গভীর ডোরাকাটা স্ট্রেচ মার্কসের দাগ হয়ে আছে- ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। পরিপূর্ণ স্ট্রেচ মার্কস হওয়ার বেশ আগে থেকেই ত্বকে দেখা যায় কিছু লক্ষণ।
- হালকা চিকন চিকন দাগ। যা পরে আরো স্ফিত হয়।
- ত্বকের সেইসব অংশে রঙের পরিবর্তন। সেটা হতে পারে লালচে, গোলাপি, বাদামী, নীলচে ইত্যাদি।
- হালকা চিকন দাগগুলো আরো স্ফিত ফাটলে রূপ নিয়ে একসময় চকচকে ও সাদাটে হতে থাকে।
- ত্বকের প্রসারিত অংশে চুলকানি।
স্ট্রেচ মার্কস কীভাবে নির্ণয় করা হয়?
স্ট্রেচ মার্কস নির্ণয় করা খুব কঠিন কিছু নয়। গর্ভবতীদের গর্ভে শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথেই হতে থাকে স্ট্রেচ মার্কস। যা খালি চোখেই বোঝা যায়। ওজন বাড়া বা ওজন কমে যাওয়া মানুষদের স্ট্রেচ মার্কসের ক্ষেত্রেও একই।
তবে কারো স্ট্রেচ মার্কসে যদি মাত্রাতিরিক্ত চুলকানি বা অস্বস্তি বোধ হয়, তাহলে অবশ্যই একজন চর্মরোগের চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। এই অস্বস্তি কোন ওষুধ বা অন্য কোন অসুস্থতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে, সে হিসেবেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
স্ট্রেচ মার্ক দূর করার কার্যকরী উপায় কী?
স্ট্রেচ মার্কস একবার শরীরে হানা দিলে তা রাতারাতি একদম দূর করা কখনোই সম্ভব না। তবে কিছু প্রক্রিয়া মেনে চললে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা যেতে পারে স্ট্রেচ মার্কসের তীব্রতা।
১. প্রচুর পানি পান
প্রচুর পানি পান করলে ত্বকে আর্দ্রতা বজায় থাকে, ত্বক থাকে নরম ও নমনীয়। এতে ত্বক প্রসারিত ও স্ফিত হলেও, আর্দ্র, নরম ত্বকের কোষ টান খায় কম। স্ট্রেচ মার্কসের তীব্রতাও হয় কম।
২. ব্যায়াম
যারা নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করেন, তাদের শরীর ও ত্বক এমনিতেই বেশি ফ্লেক্সিবল বা নমনীয় থাকে। নিয়মিত স্ট্রেচিংয়ে অভ্যস্ত শরীরের ত্বকে স্ট্রেচ মার্কসের প্রভাব হয় কম।
৩. এলোভেরা
প্রাকৃতিক এলোভেরা পাতার জেলিতে ত্বকের রুক্ষতা দূর করার গুনের পাশাপাশি রয়েছে, যে কোন পোড়া, কাঁটা বা ক্ষত এর দাগ হালকা করার ক্ষমতা। তাই স্ট্রেচ মার্কসের দাগ হালকা করতে ক্ষতিগ্রস্থ ত্বকে ব্যবহার করা যায় এলোভেরা জেল।
৪. নারকেল তেল
চামড়ার প্রসারণে স্ট্রেচ মার্কসের জায়গা রুক্ষ হয়ে যায়। যার ফলে ফাটা দাগের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। নারকেল তেল পারে ত্বকের কোষের গভীর থেকে রুক্ষতা দূর করে ত্বকে আর্দ্রতা ফেরাতে। তাই ত্বকে নারকেল তেল ম্যাসাজ করার মাধ্যমে স্ট্রেচ মার্কস প্রতিরোধ ও কমানো সম্ভব।
৫. অলিভ অয়েল
অলিভ অয়েলে থাকা ভিটামিন-ই ত্বককে রুক্ষ হতে দেয় না, রাখে মোলায়েম ও কোমল। আর ত্বকে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা বজায় থাকলে অতিরিক্ত প্রসারনেও চামড়ায় মাত্রাতিরিক্ত ফাটা দাগ বা স্ট্রেচ মার্কস পড়ে না। ভিটামিন-ই ক্ষতিগ্রস্থ ত্বকের কোষকে পুনর্গঠিত হতে সাহায্য করার মাধ্যমে স্ট্রেচ মার্কসের পুরনো দাগকেও ধীরে ধীরে হালকা করে দিতে পারে।
স্ট্রেচ মার্ক দূর করার ক্রিম
স্ট্রেচ মার্কস দূর করার জন্য বাজারে পাওয়া যায় বেশ কিছু ক্রিমও। যাদের মূল উপাদান হিসেবে থাকা কার্যকরী উপাদান সাহায্য করে স্ট্রেচ মার্কসকে ধীরে ধীরে দূর করতে।
১. ভিটামিন-এ যুক্ত ক্রিম
চামড়ার প্রসারনে ত্বকের উপরিভাগের লেয়ার ফেটে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে জন্ম নেয়া দাগই মূলত স্ট্রেচ মার্কস। আর মানব দেহের সেলের গঠন ও নতুন সেল তৈরির হার নিয়ন্ত্রণ করে ভিটামিন-এ। তাই স্ট্রেচ মার্কসের যায়গায় নিয়মিত ভিটামিন-এ যুক্ত ক্রিম, লোশন বা সেরাম ব্যবহার করলে, ওইসব ক্ষতিগ্রস্থ ফাটা জায়গার কোষ ধীরে ধীরে মেরামত হতে থাকে। হালকা হতে থাকে স্ট্রেচ মার্কসের দাগ। তবে, গর্ভবতী, দুগ্ধদানকারী অবস্থায় রেটিনল ব্যবহার করা উচিত নয়।
ত্বকের পরিচর্যায় ভিটামিন-এ এর যে রূপটি ব্যবহৃত হয়, সেটি হচ্ছে রেটিনল।
২. হায়ারুলোনিক এসিড যুক্ত ক্রিম
স্ট্রেচ মার্কসের যায়গায় ত্বকের উপরিভাগের কোলাজেন ও ইলাস্টিনযুক্ত তন্তুগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায় বলে, ওইসব স্থানে ত্বকের কোষ স্বাভাবিক আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে না। অস্বাভাবিক রুক্ষতার কারনে ত্বকে টান খেয়ে ফাটা দাগগুলো আরো বাড়তে থাকে। হায়ারুলোনিক এসিডে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ ত্বক মেরামতের সাথে, ত্বকে আর্দ্রতা ধরে রাখার বিশেষ গুণ। হায়ারুলোনিক এসিড যুক্ত ক্রিম, সেরাম বা লোশন স্ট্রেচ মার্কসের যায়গায় ব্যবহার করলে, রুক্ষতা দূর হয়ে ত্বক ভেতর থেকে সেরে উঠতে থাকে। নতুন করে দাগ বাড়ে না, হালকা হতে থাকে স্ট্রেচ মার্কসের দাগ।
৩. সেনটেলা বা সীকা ক্রিম
কোরিয়ান স্কিনকেয়ারের বিভিন্ন প্রোডাক্টে বহুলভাবে ব্যবহার হওয়া একটি প্রাকৃতিক উপাদান হচ্ছে সেনটেলা এসিয়াটিকা (Centella asiatica)। এই সেনটেলা এসিয়াটিকা যুক্ত ক্রিমগুলোকে বলা হয় সিকা ক্রিম (Cica Cream) । ক্ষতিগ্রস্থ ত্বকে অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ সারানোর জন্যই এই ক্রিম বাজারে আনে কোরিয়ান স্কিনকেয়ারের বিভিন্ন কোম্পানি। ত্বকের ক্ষতিগ্রস্থ যায়গায় প্রদাহ কমিয়ে কোলাজেনের উৎপাদন হার বাড়াতেও এই ক্রিম বেশ কার্যকরী। কোলাজেনের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে এটি স্ট্রেচ মার্কসের দাগ ও ফেটে যাওয়া ত্বক সারাতেও কাজ করে।
স্ট্রেচ মার্কস দূর করতে ত্বকে যে উপাদানই ব্যবহার করেন না কেন, অবশ্যই প্যাচ টেস্ট করতে ভুলবেন না। কারণ সবার ত্বকের ধরন যেমন এক নয়, সব ত্বকে সব ধরণের উপাদানও মানানসই নয়।
যে কোন উপাদান আপনার ত্বকের জন্য উপযুক্ত কিনা বুঝতে অল্প পরিমাণে সেই উপাদানটি আগে ত্বকের কোথাও লাগিয়ে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কি না পরীক্ষা করে দেখা। একেই বলে প্যাচ টেস্ট।
Reference
Bernstein S. (2020, August 11) Stretch Marks, Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/beauty/what-are-stretch-marks
Barode S. (2022, November 10) Natural Home Remedies for Stretch Marks, Retrieved from Pharmeasy: https://pharmeasy.in/blog/home-remedies-for-stretch-marks/
Cobb C. (2023, May 8) How to Get Rid of StretchMarks: 11 Ingredients to Try, Retrieved from Healthlone: https://www.healthline.com/health/home-remedies-for-stretch-marks
Last Updated on October 31, 2023
Leave A Comment