বাহ্যিকভাবে চুলের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণভাবে চুলের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ চুলের গোড়ায় শরীর থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি শোষণ হলে তবেই চুল সুন্দর ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল থাকে। পক্ষান্তরে শরীরে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হলে চুলের নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়। বিশেষ করে চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া এবং অতিরিক্ত চুল পড়ে যাওয়া খুব কমন সমস্যা।   

চুলের যত্নে কোন কোন ভিটামিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং সেগুলো কিভাবে পেতে পারেন তা এই অনুচ্ছেদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। এছাড়াও চুলের জন্য কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে সেই বিষয়ে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

চুল বৃদ্ধির জন্য সেরা ভিটামিন 

খাবারের মোট ৭টি উপাদানের একটি হলো ভিটামিন‌ যা শরীরের জন্য খুব সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয়। তবে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে‌। মোট ১৩টি ভিটামিন রয়েছে যার প্রায় সবগুলোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চুলের যত্নে ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ চুলের পুষ্টি জোগায়। তবে যেগুলো সরাসরি চুলের স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো নিচে বর্ণনা করা হয়েছে। 

খাবার থেকে ভিটামিন পাওয়া যায় আবার ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট (ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও ইনজেকশন ফর্মে)‌ রয়েছে। তবে খাবার হলো ভিটামিনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উৎস। 

কারণ খাবার যত বেশি পরিমাণেই খাওয়া হোক না কেন তা শরীরে ভিটামিনের মাত্রা অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয় না। অর্থাৎ Vitamin toxicity হয় না বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। পক্ষান্তরে অযাচিতভাবে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত নয়।  

ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার যত খুশি খাওয়া যাবে এবং খাবার খাওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজন নেই। তাই ভিটামিনের খাদ্য উৎস উল্লেখ করা হয়েছে। 

১. ভিটামিন ই 

Vitamin E Supplement

চুলের যত্নে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত হলো ভিটামিন ই ক্যাপসুল যা চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি একটি শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট যা চুল স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রাখে।    

চুলের যত্নে ভিটামিন ই ক্যাপসুল মুখে সেবন এবং বাহ্যিকভাবে চুলে ব্যবহার করার মাধ্যমে উপকারিতা পাওয়া যায়। মুখে সেবনের জন্য যথাযথ ডোজ সম্পর্কে সঠিক নির্দেশনা পেতে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।  

বাহ্যিকভাবে চুলে ভিটামিন ই ক্যাপসুল ব্যবহারের জন্য ক্যাপসুল ভেঙে ভেতরে থাকা তরল বের করতে হবে। অতঃপর তেলের সাথে ভিটামিন ই মিশিয়ে মাথায় দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে সপ্তাহে ১ বার ব্যবহার করাই যথেষ্ট হবে এবং প্রতিবার চুলের পরিমাণ অনুযায়ী ২ থেকে ৩টি ক্যাপসুল ব্যবহার করতে পারেন। 

ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার হলো সূর্যমুখী তেল, সয়াবিন তেল, অলিভ অয়েল, বাদাম, অ্যাভোকাডো, মিষ্টি কুমড়া, টমেটো, পালংশাক, ব্রকলি, ডিম, মাছ ইত্যাদি। চুলের পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। 

২. ভিটামিন ডি 

শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি এর অভাব হলে চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। বিভিন্ন গবেষণায় চুলের স্বাস্থ্যের উপর ভিটামিন ডি এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সম্পর্কে জানা গেছে। (Ashpari, 2023) 

চুলের যত্ন ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভিটামিন ডি এর ভূমিকা রয়েছে। যেমনঃ হাড়ের গঠন মজবুত রাখা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, হরমোন নিঃসরণ, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা ইত্যাদি। 

ভিটামিন ডি এর চাহিদা পূরণের জন্য মাঝেমধ্যে রোদ পোহাতে হবে। সূর্যের তাপ সরাসরি ত্বকে লাগলে শরীরে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয়। এছাড়াও ডিম, দুধ, মাছ, মাংস,‌ দুগ্ধজাত খাবার, টফু ইত্যাদি থেকে খাবার ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।  

রোদ পোহানোর সময় চুলে‌ রোদ লাগানোর প্রয়োজন নেই। বরং চুল ঢেকে রাখতে হবে। কারণ রোদের প্রভাবে চুল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়াও মুখের ত্বক রক্ষার জন্য মুখে সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে।  

ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট কিনতে পাওয়া যায়‌ যা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করা যেতে পারে।  

৩. ভিটামিন বি৭ (বায়োটিন)

ভিটামিন বি এর সর্বমোট আটটি প্রকরণ রয়েছে যার মধ্যে একটি হলো ভিটামিন বি৭ বা বায়োটিন। শরীরে‌ বায়োটিনের অভাবের সাথে চুল পড়ে যাওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। 

বায়োটিন চুল পড়া রোধ করে এবং চুলের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে কেরাটিন (যা চুলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) উৎপাদনের ক্ষেত্রে বায়োটিনের ভূমিকা রয়েছে। (Booth, 2023) 

বায়োটিন হলো পানিতে দ্রবণীয় একটি ভিটামিন অর্থাৎ এই ধরনের ভিটামিন শরীরে সংরক্ষিত থাকে না। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় বায়োটিন সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে।

দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, কলা, বাদাম, মিষ্টি আলু, মাশরুম, অ্যাভোকাডো, সূর্যমুখী বীজ ইত্যাদি থেকে প্রচুর বায়োটিন পাওয়া যায়। এছাড়াও ক্যাপসুল ও ট্যাবলেট আকারে বায়োটিন সাপ্লিমেন্ট কিনতে পাওয়া যায়।  

৪. ভিটামিন বি১২ (কোবালামিন) 

চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রে ভিটামিন বি১২ এর ভূমিকা রয়েছে। খাদ্যতালিকায় ভিটামিন বি১২ সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। যেমনঃ মাছ, মাংস, কলিজা, ডিম, দুধ, দুগ্ধজাত খাবার ইত্যাদি। 

যারা নিরামিষ আহার করেন (অর্থাৎ প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার গ্রহণ করেন না) তাদের শরীরে ভিটামিন বি১২ এর অভাব দেখা যায়। কারণ ভিটামিন বি১২ উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবারে পাওয়া যায় না। 

নিরামিষাশী ব্যক্তিদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন বি১২ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।

৫. ভিটামিন সি 

Vitamin C Fruits

চুল পড়া রোধ এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ভিটামিন সি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।‌ 

ভিটামিন সি পানিতে দ্রবণীয় যা শরীরে সংরক্ষিত থাকে না। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। লেবু, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুর, কলা, পেঁপে, আমড়া, আমলকী, পেয়ারা, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি হলো ভিটামিন সি জাতীয় খাবার। 

৬. ভিটামিন এ  

চুলের স্বাস্থ্য রক্ষায় ভিটামিন এ এর ভূমিকা রয়েছে। ভিটামিন এ চর্বিতে দ্রবণীয় একটি ভিটামিন যা শরীরে সংরক্ষিত থাকে। তাই সচরাচর শরীরে ভিটামিন এ এর ঘাটতি দেখা যায় না। 

ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার হলো ছোট মাছ, দুধ, দুগ্ধজাত খাবার, মাংস, ডিম, গাজর, পালংশাক, বাধাকপি, ব্রকলি, লাল মরিচ, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া, লেটুসপাতা, আম, জাম্বুরা, পাকা পেঁপে ইত্যাদি। 

কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে? 

পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ সত্ত্বেও চুলের স্বাস্থ্যের অবনতি (অতিরিক্ত চুল পড়া বা চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া) দেখা দিলে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ শরীরে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি ছাড়াও বিভিন্ন কারণে চুলের নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমনঃ  

  • শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা   
  • ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া 
  • চুলের সঠিক যত্ন না‌ নেওয়া 
  • মাথার ত্বকে ফাংগাস সংক্রমণ 
  • অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা 

চুলের স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ নির্ণয় করতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। অতপর যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে চুলের সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।

শেষ কথা 

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য যেমন ভিটামিনের প্রয়োজন হয় তেমনি চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রে ভিটামিনের ভূমিকা রয়েছে। তাই সুন্দর ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুলের জন্য নিয়মিত ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। এছাড়াও শরীরে ভিটামিনের অভাব পূরণের জন্য ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত নয়। 

শুধু ভিটামিন নয়, বরং চুলের যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য ভালো মানের প্রোটিন, স্বাভাবিক ফ্যাট,‌ ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেলস (খনিজ উপাদান) গ্রহণ করতে খেতে হবে এবং পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। অর্থাৎ চুলের পুষ্টির জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। 

Bibliography

Ashpari, Z. (2023, May 16). Can I use vitamins to promote hair growth? Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/318403

Booth, J. (2023, 08 25). Best Vitamins And Supplements For Hair Growth: An Expert Guide. Retrieved from forbes: https://www.forbes.com/health/body/best-vitamins-and-supplements-for-hair-growth/

Last Updated on November 4, 2023