সন্তান জন্মদানের পরে মায়ের শরীরে নানাবিধ পরিবর্তন দেখা যায় যার মধ্যকার খুব কমন একটি সমস্যা হলো অতিরিক্ত চুল পড়া। প্রসবোত্তর (সন্তান জন্মদানের পরে) চুল পড়ার প্রধান কারণ শরীরে হরমোনের পরিবর্তন। তবে এর বাইরেও নানাবিধ কারণে অতিরিক্ত চুল পড়তে পারে। 

এই অনুচ্ছেদে প্রসবোত্তর চুল পড়ার কারণ সমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও এমতাবস্থায় করণীয় কি, কতদিন পর্যন্ত চুল পড়া সমস্যা থাকতে পারে এবং কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে সেই বিষয়ে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

প্রসবোত্তর বা বাচ্চা হবার পর চুল পড়ার কারণ কি?  

গর্ভকালীন সময়ে নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। যার ফলে গর্ভবতী নারীদের চুলের স্বাস্থ্য বেশ ভালো থাকে। সন্তান জন্মদানের পর নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা বেশ কমে যায়। হঠাৎ ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা পরিবর্তনের (কমে যাওয়া) ফলে চুল পড়া শুরু হয়। 

সাধারণত সন্তান জন্মদানের ঠিক পরপরই হরমোন জনিত চুল পড়া সমস্যা শুরু হয় না। বরং প্রসবের দুই থেকে চার মাস পর থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় চুল পড়তে দেখা যায়। তবে ব্যক্তিভেদে সময় এবং চুল পড়ার পরিমাণ কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। 

প্রসবোত্তর চুল পড়া খুব জটিল কোনো রোগ নয়। বরং এটি একটি সাময়িক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, প্রসব পরবর্তী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে অতিরিক্ত চুল পড়া কমে যায়। (Narayana Health, 2022)   

শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোন জনিত সমস্যা ছাড়াও আরো যেসব কারণে প্রসবোত্তর অতিরিক্ত মাত্রায় চুল পড়া সমস্যা দেখা দিতে পারে তা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। 

পুষ্টির অভাব 

A nutritious meal

স্তন্যদানকারী মায়েদের শরীরে পুষ্টি উপাদানের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু শিশুকে খাওয়ানোর ব্যাপারে মায়েরা বেশ সচেতন থাকলেও নিজের খাবার গ্রহণের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে থাকেন। ফলে শরীরে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হয় এবং এর প্রভাবে অতিরিক্ত চুল পড়তে দেখা যায়। 

বিশেষ করে শরীরে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলের অভাবের ফলে অতিরিক্ত চুল পড়তে থাকে। 

চুলের সঠিক যত্ন না নেওয়া 

সন্তান জন্মদানের পর মায়ের সবটুকু মনোযোগ বাচ্চার দিকে চলে যায়। তাই বাচ্চার প্রতি অনেক যত্নবান হয়ে উঠেন। যার ফলে নিজের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য চর্চার দিকে তেমন কোনো খেয়াল থাকে না। 

চুলে নিয়মিত শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করা, তেল দেওয়া, চুল আঁচড়ানো, গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি হয়ে উঠে না।‌ চুলের প্রতি যত্নের ঘাটতি হলে চুল পড়ে যেতে থাকে।   

অতিরিক্ত মানসিক চাপ 

সন্তানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সাংসারিক বিভিন্ন কাজকর্ম করার ফলে মানসিক চাপ অনেকটাই বেড়ে যায়। বিশেষ করে কর্মজীবী নারীদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানের পর দায়িত্ব অনেক গুণ বেড়ে যায়। 

সন্তানের জন্য কাজ ও চিন্তা মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে শরীরে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত কর্টিসল হরমোন চুল পড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

থাইরয়েডের সমস্যা 

অনেক মায়ের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানের পর থাইরয়েডের সমস্যা দেখা যায়। বিশেষ করে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণের মাত্রা কমে যায় যাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয়। থাইরয়েডের সমস্যার ফলে অতিরিক্ত চুল পড়তে থাকে। 

প্রসবোত্তর বা বাচ্চা হবার পর চুল পড়লে করণীয় কি? 

প্রসবোত্তর চুল পড়ার জন্য বিশেষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন নেই। আর তাছাড়া প্রসবোত্তর চুল পড়া প্রতিকারের শতভাগ কার্যকরী কোনো উপায় নেই বললেই চলে। তবে কতিপয় নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে চুল পড়া কিছুটা কমানো সম্ভব। 

  • মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত ইয়োগা ও মেডিটেশন চর্চা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।‌ এছাড়াও প্রতিদিন কিছুক্ষণ সময় ব্যায়াম করতে হবে। 
  • পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমনঃ ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, বাদাম, ডাল, ফলমূল ও শাকসবজি। পর্যাপ্ত খাবার খেতে হবে। কোনো বেলার খাবার বাদ দেওয়া যাবে না। 
  • চিনি, ট্র্যান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয় ইত্যাদি যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে।
  • সপ্তাহে দুইদিন শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে। প্রতিবার শ্যাম্পু ব্যবহারের পর চুলে কন্ডিশনার দিতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একদিন মাথায় তেল (নারিকেল তেল বা অলিভ অয়েল) দিতে হবে। 
  • নিয়মিত চুল আঁচড়াতে হবে এবং চুল গুছিয়ে রাখতে হবে। তবে ভেজা চুল আঁচড়ানো যাবে না। এছাড়াও খুব শক্তভাবে রাবার ব্যান্ড দিয়ে চুল বাঁধা যাবে না। এতে চুল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 
  • চুলে কোনো রাসায়নিক উপাদান বা কালার ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়াও হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এতে চুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফ্যানের বাতাসে চুল শুকাতে হবে।
  • বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের সমন্বয়ে হেয়ার প্যাক তৈরি করে মাথার ত্বক ও চুলে ব্যবহার করা হলে তা চুলের জন্য উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। যেমনঃ মধু ও ডিমের সাদা অংশ, এলোভেরা ও অলিভ অয়েল, মেথি ও অলিভ অয়েল, পেঁয়াজের রস ইত্যাদি। (Jones, 2023) 

কখন‌ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে? 

Doctor consultation for hair loss

প্রসবোত্তর এক বছর সময় পার হয়ে গেলেও চুল পড়া না কমলে সেক্ষেত্রে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ, গাইনী ডাক্তার বা হরমোন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।  

এছাড়াও চুল পড়া কমানোর জন্য প্রসবোত্তর সময়ে একজন গাইনী ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমনঃ 

চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত নয়।

শেষ কথা

প্রসবোত্তর চুল পড়া একটি কমন সমস্যা যা ইস্ট্রোজেন হরমোন জনিত কারণে হয়ে থাকে। 

এর জন্য তেমন কোনো চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন নেই।‌ বরং কিছুদিনের মধ্যেই এমনিতেই এই সমস্যা ঠিক হয়ে যায়। তবে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং চুলের সঠিক যত্ন নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। 

Bibliography

Jones, B. (2023, May 01). What You Need to Know About Postpartum Hair Loss. Retrieved from health: https://www.health.com/postpartum-hair-loss-7480927

Narayana Health. (2022, August 28). DEALING WITH HAIR LOSS AFTER PREGNANCY. Retrieved from Narayana Health: https://www.narayanahealth.org/blog/dealing-with-hairloss-after-pregnancy/

Last Updated on December 20, 2023