শিশু জন্মের পর থেকে পরবর্তী ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধ এবং পরবর্তী ১.৫ বছর বা তার বেশি সময় অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি মায়ের বুকের দুধ পান করে থাকে। মায়ের বুকের দুধের পুষ্টিগুণ অতুলনীয় এবং শিশুর জন্য অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা বয়ে আনে তা সবাই জানেন।
এই অনুচ্ছেদের বিষয়বস্তু মায়ের বুকের দুধ সম্পর্কিত নয়, বরং গৃহপালিত প্রাণীর দুধ বা প্যাকেটজাত দুধের পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কিত। বিশেষ করে গরুর দুধে কি কি পুষ্টি উপাদান থাকে, দুধ পান করলে কি কি উপকারিতা পাওয়া যায়, দুধ পান করার সঠিক নিয়ম, কাদের জন্য দুধ পান করা উচিত নয় ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
পুষ্টি উপাদান
গরুর দুধের ৮৮ শতাংশ হলো পানি। বাকি অংশে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান রয়েছে। যেমনঃ কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ও মিনারেলস। (Arnarson, 2021)
কার্বোহাইড্রেট
দুধের প্রায় ৫ শতাংশ হলো কার্বোহাইড্রেট অর্থাৎ ৩০ মিলিলিটার দুধ থেকে প্রায় ৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায়। দুধে থাকা কার্বোহাইড্রেটের নাম হলো ল্যাকটোজ (Lactose) যা একধরনের সরল শর্করা। দুধ খাওয়ার পরে পরিপাকতন্ত্রে ল্যাকটেজ (Lactase) নামক এনজাইম ল্যাকটোজকে ভেঙ্গে গ্লুকোজ ও গ্যালাকটোজে রুপান্তর করে।
প্রোটিন
দুধ থেকে ভালো মানের প্রোটিন পাওয়া যায়। প্রতি এক আউন্স (৩০ মিলিলিটার) গরুর দুধে ১ গ্রাম প্রোটিন রয়েছে। দুধে অনেক ধরনের প্রোটিন থাকে তবে কেসিন (Casein) হচ্ছে মূল প্রোটিন। কেসিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি শরীরে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণে সহায়তা করে।
ফ্যাট
দুধের প্রায় ৪ শতাংশ হলো ফ্যাট। দুধের ফ্যাটের বেশিরভাগ হলো স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং সামান্য পরিমাণে ট্র্যান্স ফ্যাট রয়েছে। এছাড়াও দুধে থাকা ফ্যাটের ২৮ শতাংশ হলো মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ২.৩ শতাংশ হলো পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট।
এক গ্লাস পরিমাণ (২৪৪ মিলিলিটার) গরুর দুধ থেকে ১৫২ ক্যালরি পাওয়া যায়।
ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান
দুধ হলো ভিটামিন ও মিনারেলসের দারুণ একটি উৎস। দুধ থেকে যেসব ভিটামিন ও মিনারেলস পাওয়া যায় তা হলোঃ
ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লেভিন)
শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো ভিটামিন বি২ যার অভাব জনিত লক্ষণ (মুখে ঘা হওয়া) প্রায়ই দেখা যায়। দুধ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি২ পাওয়া যায়।
ভিটামিন বি১২ (কোবালামিন)
ভিটামিন বি১২ প্রধানত প্রাণীজ উৎস থেকে পাওয়া যায় যা মূলত স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক গ্লাস দুধ ভিটামিন বি১২ এর দৈনিক চাহিদার প্রায় অর্ধেক পূরণ করতে সক্ষম।
ক্যালসিয়াম
হাড়ের জন্য ক্যালসিয়াম অত্যন্ত উপকারী যা দুধ থেকে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। দুধের ক্যালসিয়াম শরীরে সহজে শোষণ হয়। কারণ দুধে থাকা কেসিন ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করে।
ফসফরাস
দাঁত ও হাড়ের গঠনে ফসফরাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুধ থেকে প্রচুর পরিমাণে ফসফরাস পাওয়া যায় এবং দুধে থাকা কেসিন ফসফরাস শোষণে সহায়তা করে।
অন্যান্য উপাদান
দুধ থেকে সামান্য পরিমাণে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, আয়োডিন, জিংক, কোলাইন (Choline) ইত্যাদি পাওয়া যায়। এছাড়াও বাজারে ফর্টিফায়েড (Fortified) দুধ পাওয়া যায় যেগুলোতে ভিটামিন এ অথবা ভিটামিন ডি থাকে।
শরীরের জন্য উপকারী যে খাদ্য উপাদানটি দুধে একদম অনুপস্থিত তা হলো ফাইবার।
দুধের হরমোন
গরুর দুধে বিভিন্ন ধরনের হরমোন থাকে যা গরুর বাচ্চার জন্য উপকারী। তবে দুধ পান করার ফলে মানুষের শরীরে এইসব হরমোন কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না। একমাত্র IGF-1 (Insulin-like growth factor-1) নামক একটি হরমোন শারীরিক বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
দুধের স্বাস্থ্য উপকারিতা
দুধের মধ্যে অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে এই ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই। তবে দুধ পান করা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী হবে সেই ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ের গবেষণার ফলাফলে ভিন্নতা দেখা যায়। হার্ভার্ডের তথ্য অনুযায়ী দুধ পান করা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী সেই ব্যাপারে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ (Harvard T.H. Chan School of Public Health, 2021)
হার্ট
দুধে রয়েছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়াম যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। রাতে ঘুমানোর আগে দুধ পান করার ফলে ভালো ঘুম হয় যা হার্ট ভালো রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দুধে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট রয়েছে যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় তথা হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্যের জন্য দুধ আসলে হার্টের জন্য উপকারী নাকি ক্ষতিকর তা স্পষ্টভাবে বলা মুশকিল। তবে এই সমস্যার একটি সমাধান সূত্র পাওয়া গেছে। আর তা হলো, ফ্যাট ফ্রি দুধ। আজকাল বাজারে ফ্যাট ফ্রি দুধ কিনতে পাওয়া যায় যা সবধরনের ফ্যাট মুক্ত এবং হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়ায় না।
হাড়
দুধে হাড়ের জন্য উপকারী বিভিন্ন উপাদান (ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন, ভিটামিন ডি ইত্যাদি) রয়েছে। তবে দুধ পান করার ফলে হাড় ক্ষয় রোগ প্রতিরোধ এবং হাড় ভালো রাখে এমনটি গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত নয়।
শরীরের ওজন
ফ্যাট ফ্রি দুধ পান করা এবং সেই সাথে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়াম করার ফলে শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো যায়। তবে ফ্যাট সমৃদ্ধ দুধ অতিরিক্ত পরিমাণে পান করা হলে তা শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ ফ্যাট অনেক বেশি ক্যালরি সরবরাহ করে। আর শরীরের চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করা হলে ওজন বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস
দুধ একটি লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খাবার অর্থাৎ দুধ খাওয়ার পরে খুব দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায় না। তবে দুধ পান করা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে কিনা সেই ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিরূপ প্রভাব
দুধ পান করার ফলে অনেকের শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বিশেষ করে যাদের ক্ষেত্রে দুধে এলার্জি ও ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স (Lactose intolerance) রোগ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা বেশি হয়।
ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স
দুধে থাকা কার্বোহাইড্রেট (ল্যাকটোজ) ভাঙ্গার জন্য ল্যাকটেজ নামক এনজাইমের প্রয়োজন হয়। জন্মের পর শিশু মায়ের বুকের দুধ পান করে এবং এই সময়ে সবার শরীরেই ল্যাকটেজ এনজাইম তৈরি হয়।
কারো কারো ক্ষেত্রে বড় হওয়ার পরে ল্যাকটেজ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দুধ পান করার ফলে ল্যাকটোজ হজম হয় না যাকে মেডিকেলের ভাষায় ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স বলা হয়। এই রোগের লক্ষণ হিসেবে দুধ পান করার পরে পেটে গ্যাস হওয়া, পেট ফাঁপা, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া ইত্যাদি দেখা যায়।
ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স রোগীদের জন্য বাজারে ল্যাকটোজ ফ্রি দুধ (Lactose-free milk) পাওয়া যায় যা খেলে কোনো সমস্যা হয় না।
এলার্জি
কারো কারো ক্ষেত্রে দুধ পান করার ফলে এলার্জি দেখা যায়। এটি খুব বিরল ঘটনা। দুধে থাকা বিশেষ ধরনের প্রোটিন এলার্জি সৃষ্টির জন্য দায়ী মনে করা হয়। এলার্জি হলে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলো- ত্বকে র্যাশ (Skin rash), মুখমণ্ডল ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া ইত্যাদি।
ব্রণ (Acne)
অতিরিক্ত দুধ পান করার সাথে ব্রণ হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। যারা অতিরিক্ত পরিমাণে দুধ পান করেন তাদের ক্ষেত্রে (বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের মেয়েদের ক্ষেত্রে) ব্রণ হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। দুধে থাকা IGF-1 হরমোনের প্রভাবে এমনটি হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়।
ক্যান্সার
অতিরিক্ত পরিমাণে দুধ পান করা পুরুষের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যান্সারের (Prostate cancer) ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আবার দুধ পান করা কোলন ক্যান্সার (Colorectal cancer) প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
দুধ পান করার সঠিক নিয়ম
দুধ পান করার ফলে কোনো বিরূপ প্রভাব দেখা না গেলে তাদের জন্য প্রতিদিন এক গ্লাস পরিমাণ (২৪০ মিলিলিটার) দুধ পান করা যেতে পারে। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া যাবে না।
- যেকোনো সময় (সকাল, বিকাল বা রাতে) দুধ পান করা যাবে।
- দুধের সাথে চিনি মেশানো হলে দুধের পুষ্টিগুণে কোনো পরিবর্তন হয় না। তবে চিনি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই চিনি মেশানো উচিত নয়।
- দুধের সাথে মধু মেশানো হলে মধুর পুষ্টিগুণ যোগ হবে।
- প্যাকেটজাত দুধের পুষ্টিগুণ গরুর দুধের চেয়ে তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। তবে ছাগলের দুধ প্রায় সমান পুষ্টিগুণ সম্পন্ন বলা চলে।
- গাভীর দুধ দোয়ানোর পর সরাসরি সেই কাঁচা দুধ খাওয়া যাবে না। কারণ এতে ক্ষতিকর অণুজীব থাকতে পারে। তাই দুধ জ্বাল দিয়ে খেতে হবে।
- যেকোনো ধরনের খাবারের সাথে মিশিয়ে দুধ খাওয়া যাবে। এতে কোনো সমস্যা হবে না।
- কাঁচা ডিম গরম দুধের মধ্যে দিয়ে খাওয়া যাবে না। কারণ এতে ডিম যতটা সিদ্ধ হয় তাতে ক্ষতিকর অণুজীব থেকে যায়। বিশেষ করে কাঁচা ডিমে টাইফয়েডের জীবাণু থাকতে পারে।
- উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত (বাদাম, সয়া ও নারকেল) দুধে ল্যাকটোজ ও ক্ষতিকর ফ্যাট থাকে না। গরুর দুধের বিকল্প হিসেবে এই ধরনের দুধ খাওয়া যেতে পারে।
অসুস্থতা জনিত কারণে ডাক্তার দুধ খেতে বারণ করলে অবশ্যই সেই নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
References
Arnarson, A. (2021, 10 21). Milk 101: Nutrition Facts and Health Effects. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/milk
Harvard T.H. Chan School of Public Health. (2021). Milk. Retrieved from HSPH: https://www.hsph.harvard.edu/nutritionsource/milk/
Last Updated on October 31, 2023
Leave A Comment