আমাদের দেশের জাতীয় মাছ হলো ইলিশ (Hilsa) যা স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। ইলিশ মাছ শুধু খেতে মজাদার তাই নয়, বরং এটি অনেক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এবং শরীরের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। তবে সবার জন্য ইলিশ মাছ খাওয়া নিরাপদ হবে কিনা সেটা নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে।  

এই অনুচ্ছেদে ইলিশ মাছের পুষ্টিগুণ এবং ইলিশ খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও গর্ভবতী না্রীদের জন্য ইলিশ মাছ খাওয়া নিরাপদ হবে কিনা সেই সম্পর্কে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।    

ইলিশ মাছের পুষ্টিগুণ 

বাংলাদেশে নদীর (পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা) ও সাগরের ইলিশ পাওয়া যায়। স্থানভেদে ইলিশ মাছের পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ ও স্বাদের ক্ষেত্রে কিছুটা কমবেশি হয়ে থাকে। ইলিশ মাছের ওজন অনুপাতে ১৯ থেকে ২১ শতাংশ পর্যন্ত প্রোটিন পাওয়া যায়। এছাড়াও ৫ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত ফ্যাট ও খুবই সামান্য পরিমাণে (০.৫ শতাংশ) কার্বোহাইড্রেট থাকে। ১০০ গ্রাম পরিমাণ ইলিশ মাছ থেকে ১২৮ থেকে ১৬১ ক্যালরি পাওয়া যায়। মাছের তেল বা ফ্যাটের পরিমাণের পরিবর্তনের ফলে ক্যালরি কম বেশি হয়ে থাকে। অর্থাৎ ইলিশ মাছে যখন তেলের পরিমাণ বেশি থাকে তখন সবচেয়ে বেশি ক্যালরি পাওয়া যায়। ইলিশ মাছে যেসব পুষ্টি উপাদান রয়েছে তা নিচে উল্লেখ করা হলো। (Begum, 2016)  

  • আয়োডিন 
  • সেলেনিয়াম 
  • ক্যালসিয়াম  
  • ভিটামিন এ 
  • ভিটামিন বি  
  • ভিটামিন সি  
  • ভিটামিন ডি  
  • ফসফরাস 
  • ম্যাঙ্গানিজ 
  • কপার 
  • আয়রন  
  • জিংক 
  • কোলাইন 

ইলিশ মাছের উপকারিতা 

ইলিশ খাওয়ার ফলে যেসব স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায় তা‌ নিচে বর্ণনা করা হলো। (Hasin, 2022)

১। প্রোটিনের ভালো উৎস 

একজন মানুষের দৈনিক চাহিদার ১০ শতাংশ ক্যালরি প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে সংগ্রহ করা উচিত। সেই হিসেবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ৬০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। ইলিশ মাছ প্রোটিনের একটি ভালো উৎস। ১০০ গ্রাম ইলিশ থেকে যে পরিমাণ প্রোটিন পাওয়া যায় যা দৈনিক ক্যালরি চাহিদার এক তৃতীয়াংশের চেয়েও বেশি।   

২। হার্টের জন্য উপকারী 

ইলিশ মাছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega-3 fatty acid) রয়েছে যাকে কার্ডিও প্রটেকটিভ (Cardio-protective) বলা হয়। অর্থাৎ এই ধরনের ফ্যাট হার্টের জন্য খুব উপকারী। বিশেষ করে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাকস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে। 

৩। মস্তিষ্কের জন্য উপকারী 

নিয়মিত ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার (যেমনঃ ইলিশ মাছ) খাওয়ার ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ভালো থাকে এবং বয়সজনিত মস্তিষ্কের রোগে (আলজেইমার্স ডিজিজ) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। 

এছাড়াও শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শিশুদেরকে ইলিশ মাছ খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে।

৪। দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে 

Good Eye Sight

ইলিশ মাছ থেকে ভিটামিন এ পাওয়া যায় যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়াও বয়স্কদের চোখের রোগে (Age-related macular degeneration) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে ইলিশে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

৫। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় 

শরীরে রোগ জীবাণুর আক্রমণ প্রতিহত করার মাধ্যমে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার গুরুত্ব অপরিসীম। ইলিশে বিদ্যমান ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি ও মিনারেলস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। 

৬। বিষন্নতা (Depression) দূর করে 

বিষন্নতা হলো একটি মানসিক রোগ যার ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। ইলিশে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড বিষন্নতা প্রতিরোধে ও প্রতিকারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ সুস্থদের ক্ষেত্রে বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায় আর যারা বিষন্নতায় ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে বিষন্নতা নিরাময়ের ওষুধের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। 

৭। ঘুমের সমস্যা দূর করে 

Healthy Sleep

শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতির হলে রাতে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। সূর্যের তাপ সরাসরি ত্বকে লাগলে শরীরে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয়। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই সূর্যের তাপ গায়ে লাগানোর সুযোগ তেমন একটা হয় না। যেসব খাবার থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায় তার মধ্যে একটি হলো ইলিশ মাছ। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ ইলিশ মাছ খাওয়া ভালো ঘুমের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।   

৮। আয়োডিনের ভালো উৎস  

ইলিশ মাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন পাওয়া যায় যা থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্রম ভালো রাখতে সাহায্য করে। থাইরয়েড গ্রন্থি কোষের বিপাক প্রক্রিয়া বা মেটাবলিসম, দেহের তাপমাত্রা ও হার্টের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

আয়োডিনের অভাবে গলগন্ড (Goitre) রোগ হয়। নিয়মিত আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার (ইলিশ মাছ) খাওয়া হলে তা গলগন্ড রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার ফলে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে বিভিন্ন এনজাইম নিঃসরণ হয় যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।  

গর্ভাবস্থায় ইলিশ মাছ খাওয়া যাবে কি?

গর্ভাবস্থায় ইলিশ মাছ খাওয়া যাবে এবং এতে গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ শিশুর কোনো ক্ষতি হবে না। বরং ইলিশ মাছে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। যেমনঃ  

  • গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্ক ও চোখের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
  • কম ওজন নিয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করার ঝুঁকি হ্রাস পায়। 
  • গর্ভকালীন ৩৭ সপ্তাহের আগেই বাচ্চা প্রসব হওয়ার ঝুঁকি কমায়। 
  • গর্ভবতী নারীর বিষন্নতায় ভোগার সম্ভাবনা কমায়। 
  • শিশুর মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডের গঠনগত ত্রুটি (Neural tube defects) হওয়ার ঝুঁকি কমায়। 

ইলিশ মাছ খাওয়া নিরাপদ হবে কিনা এই সংশয়ের কারণ হলো সামুদ্রিক ইলিশে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান (মার্কারী) থাকতে পারে যা গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ শিশুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে খুব নগণ্য পরিমাণে মার্কারী থাকার সম্ভাবনা রয়েছে যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। এই ব্যাপারে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো সামান্য পরিমাণে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানের ভয়ে সামুদ্রিক মাছের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। তবে গর্ভবতীদের জন্য সপ্তাহে সর্বোচ্চ দুই দিনের বেশি সামুদ্রিক মাছ না খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। (Harvard T.H. Chan, School of Public Health) 

 ইলিশ মাছ খাওয়ার ফলে অনেকের ক্ষেত্রে এলার্জির লক্ষণ (ত্বকে র‍্যাশ হওয়া, চুলকানি, মুখমণ্ডল ফুলে যাওয়া,‌ শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি) দেখা যায়। যাদের ক্ষেত্রে ইলিশ খেলে এলার্জি হয় তাদের জন্য খাওয়া যাবে না।

Bibliography

Begum, M. (2016). Nutritional Profile of Hilsa Fish. Retrieved from Journal of Nutrition & Food Sciences: https://www.longdom.org/open-access/nutritional-profile-of-hilsa-fish-emtenualosa-ilishaem-hamilton-1822-in-sixselected-regions-of-bangladesh-36017.html

Harvard T.H. Chan, School of Public Health. (n.d.). Fish: Friend or Foe? Retrieved from Harvard: https://www.hsph.harvard.edu/nutritionsource/fish/

Hasin, C. T. (2022, 8 16). The health benefits of eating hilsa. Retrieved from The Daily Star: https://www.thedailystar.net/life-living/news/the-health-benefits-eating-hilsa-3096276

Last Updated on October 31, 2023