রান্নার কাজে হলুদ (Turmeric) খুব কমন একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। খাবারের গন্ধ, কালার ও স্বাদ বৃদ্ধিতে হলুদ সাহায্য করে। তবে এর পাশাপাশি হলুদের রয়েছে কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা। বিভিন্ন সময়ে হলুদ নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যে, স্বাস্থ্যের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনতে পারে হলুদ। আর তাইতো রান্না ছাড়াও সরাসরি কাঁচা হলুদ খেতে উৎসাহ দেওয়া হয়ে থাকে।

আজকের অনুচ্ছেদে কাঁচা হলুদ খাওয়ার ১০ টি উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও কাদের জন্য কাঁচা হলুদ খাওয়া যাবে না সেই ব্যাপারে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

Table of Contents

১. ঔষধি গুন সম্পন্ন বায়ো একটিভ উপাদান

স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হলুদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বায়োঅ্যাকটিভ উপাদানের নাম হলো কারকিউমিন (Curcumin) যা কাঁচা হলুদে ৩ শতাংশ পর্যন্ত থাকে। এটি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। (Gunnars, 2021) 

দুঃখজনক বিষয় হলো, হলুদ খাওয়ার পরে পরিপাকতন্ত্রে খুব সামান্য কারকিউমিন শোষণ হয়ে থাকে। তবে শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি করার জন্য হলুদের সাথে গোল মরিচ (Black pepper) খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। গোল মরিচে Piperine রয়েছে যা কারকিউমিন শোষণে সাহায্য করে। 

২. প্রাকৃতিক এন্টি ইনফ্লামেটরি হিসেবে কাজ করে

হলুদে বিদ্যমান কারকিউমিনের অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি গুণাগুণ রয়েছে যা বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহজনিত রোগের উপসর্গ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে এর জন্য সাধারণত যে পরিমাণে হলুদ রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয় তাতে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না। 

প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি হিসেবে কার্যকরী ফলাফল পাওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হলুদ তথা কারকিউমিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।

৩. শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা বাড়ায়

হলুদে বিদ্যমান কারকিউমিন শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা বাড়ায় যা ফ্রি রেডিক্যাল (Free radicals) এর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফ্রি রেডিক্যাল কোষের ক্ষতি সাধন করে এবং বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।  

৪. মস্তিষ্কে নিউরোট ট্রাফিক ফ্যাক্টর বৃদ্ধি করে

মস্তিষ্কের নিউরন কোষের নিয়ন্ত্রক হলো BDNF (brain-derived neurotrophic factor) যা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সহ ডিপ্রেশন ও আলজেইমার্স রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন BDNF এর মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।  

৫. হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়

বিশ্ব ব্যাপী অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো হার্টের রোগ। হলুদে বিদ্যমান কারকিউমিন হার্টের রোগের (উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট অ্যাটাক) ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। 

৬. ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে

ক্যান্সার প্রতিরোধে হলুদের কারকিউমিন সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে পরিপাকতন্ত্রের ক্যান্সার (Colorectal cancer) প্রতিরোধে গোল মরিচ সহযোগে কাঁচা হলুদ খাওয়া উপকারী হবে। গোল মরিচে বিদ্যমান Piperine হলুদে বিদ্যমান কারকিউমিন রক্তে শোষণে সহায়তা করে।  

স্তন ক্যান্সার সচেতনতা ও চিকিৎসা জানতে পড়ুন

৭. আলঝাইমার রোগের চিকিৎসায় উপকারী

আলজেইমার্স সাধারণত বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে যার ফলে স্মৃতি শক্তি কমে যায়। এই রোগ সারিয়ে ফেলার মতো কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। তবে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগের লক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। আলজেইমার্স রোগে চিকিৎসার পাশাপাশি হলুদ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা হলে তা রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে। 

৮. আর্থ্রাইটিস রোগের উপশম

আর্থ্রাইটিস রোগের ফলে শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে প্রদাহ হয়। আর্থ্রাইটিসের প্রদাহ নিরাময়ে হলুদ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা হলে উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ হলুদে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি গুণাবলী সম্পন্ন কারকিউমিন যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। 

৯. বিষন্নতা দূর করে

বিষণ্নতা একটি মানসিক সমস্যা যার ফলে স্বাভাবিক জীবন যাপন মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হয়। বিষণ্নতা নিরাময়ের জন্য কাউন্সেলিং সহ বিভিন্ন ওষুধ রয়েছে।‌ তবে এর পাশাপাশি হলুদ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা হলে তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিষন্নতা দূর করতে সাহায্য করে। 

এছাড়াও হলুদ খাওয়ার ফলে মস্তিষ্কের BDNF এর মাত্রা বেড়ে যায় যা বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। 

১০. বার্ধক্য জনিত সমস্যা দূর করে

বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় যা বার্ধক্য জনিত রোগ নামে পরিচিত। নিয়মিত হলুদ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে তাদের ক্ষেত্রে বার্ধক্য জনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায় এবং দীর্ঘজীবী হতে সহায়তা করে। 

অন্যান্য ক্ষেত্রে কাঁচা হলুদের ব্যবহারঃ

এই দশটি উপকার ছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে কাঁচা হলুদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সেগুলো হলো –

১. ত্বকের যত্নে

প্রাচীন যুগ থেকে ত্বকের যত্নে কাঁচা হলুদ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দাগ, রিংকেল, সানবার্ন থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্যতম উপাদান হচ্ছে কাঁচা হলুদ। কাঁচা হলুদের রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা বয়সের ছাপ থেকে রক্ষা করে। মুখের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।

২. ওজন কমাতে ভুমিকা

বর্তমানে সবাই অনেক সচেতন দেহের ওজন নিয়ে। অতিরিক্ত ওজন কমাতে সবাই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও কিছু কৌশল অবলম্বন করে। কাঁচা হলুদে রয়েছে অ্যান্টি ওবেসিটি গুন যা শরীরের মেদ জমতে বাঁধা দেয় এবং মেটাবলিজমের হার বাড়ায়। ফলে কাঁচা হলুদ শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে অন্যতম উপকারী উপাদান।

৩. খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে

কাঁচা হলুদের গ্যাস্ট্রো প্রটেক্টিভ কিছু গুণ থাকে যা খাবারকে হজম করতে সাহায্য করে। হজমের গোলমাল, গ্যাসের সমস্যার ক্ষেত্রে কাঁচা হলুদের গুরুত্ব অপরিসীম।

৪. খাদ্য সংক্রমণ

কাঁচা হলুদে অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান থাকে যা বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ থেকে খাদ্যনালীকে বাঁচায়। আমরা রোজ যে খাবার খাই তাতে নানা ধরনের জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া থাকে। কাঁচা হলুদ এই ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে এবং আমাদের প্রদাহ থেকে মুক্তি দেয়।

৫. ডায়াবেটিসে কাঁচা হলুদের ভুমিকা

কাঁচা হলুদে কারকিউমিন ও অ্যান্টি ডায়াবেটিক এজেন্ট থাকে। যা রক্তের শর্করা মাত্রা কমায় এবং ইনসুলিন হরমোনের ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। যাদের ডায়াবেটিসের মাত্রা অতিরিক্ত তারা নিয়মিত কাঁচা হলুদ খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

৬. হাড় জোড়া লাগাতে কাঁচা হলুদ

বহু প্রাচীন যুগ থেকে হাত পা মচকে গেলে চুন হলুদের ব্যবহার হয়ে আসছে। হলুদ হাড়ের টিস্যুকে রক্ষা করে ভাঙা হাড় জোড়া লাগাতে সাহায্য করে। দুধের সাথে কাঁচা হলুদ মিশিয়ে একত্রে খেলে ব্যাথা এবং প্রদাহ কমায়।

৭. দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে

কাঁচা হলুদ দাঁতের এনামেল আস্তরনকে রক্ষা করে। মাড়ি থেকে রক্ত পড়া এবং মুখের ভেতর ক্ষত নিরাময় করতে কাঁচা হলুদ সাহায্য করে।

৮. এলার্জিতে ভূমিকা

কাঁচা হলুদে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুন রয়েছে যা এলার্জি নিরাময়ে সাহায্য করে।

কাঁচা হলুদ খাওয়ার নিয়ম

প্রতিদিন সকালে ও রাতে ২৫০ মিলিগ্রাম করে কাঁচা হলুদ খাওয়া যেতে পারে। সকালে খালি পেটে কাঁচা হলুদ খেলে ভালো উপকার পাওয়া যায় এবং রাতে ঘুমানোর আগে দুধের সাথে কাঁচা হলুদ মিশিয়ে খেতে পারেন। 

কাদের জন্য কাঁচা হলুদ খাওয়া উচিত নয়? 

রান্নার কাজে যে পরিমাণে হলুদ ব্যবহার করা হয় তা সবার জন্য নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তবে কারকিউমিনের উপকারিতা পাওয়ার আশায় অতিরিক্ত পরিমাণে কাঁচা হলুদ খাওয়া বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা সবার জন্য নিরাপদ নাও হতে পারে। যেমনঃ (Allarakha, 2023) 

    • কিডনিতে পাথর, লিভারের রোগ ও পিত্তথলিতে পাথর থাকলে তাদের জন্য অতিরিক্ত হলুদ খাওয়া যাবে না।
    • হলুদ অন্ত্রে আয়রন শোষণে বাঁধার সৃষ্টি করে থাকে। তাই রক্তস্বল্পতার রোগীদের জন্য অতিরিক্ত হলুদ খাওয়া যাবে না। 
    • স্তন ক্যান্সারের জন্য কেমোথেরাপি গ্রহণের সময় হলুদ সাপ্লিমেন্ট খাওয়া যাবে না। কারণ এতে কেমোথেরাপির কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। 
    • যারা রক্ত পাতলা রাখার জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন তাদের ক্ষেত্রে হলুদ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত হবে না। 
  • গর্ভবতী মায়েদের জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে কাঁচা হলুদ খাওয়া নিরাপদ নয়।
  • স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য হলুদ সাপ্লিমেন্ট নিরাপদ তবে খাওয়ার মাত্রা সম্পর্কে সঠিক নির্দেশনা পেতে পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হতে হবে।  
  • কাঁচা হলুদ রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়। তবে অতিরিক্ত কাঁচা হলুদ খেলে শর্করার মাত্রা অতিরিক্ত পরিমাণে কমে যেতে পারে যাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া (Hypoglycemia) বলা হয়। 
  • কাঁচা হলুদে এলার্জি হলে তাদের কাঁচা হলুদ খাওয়া উচিত হবে না। 

কাঁচা হলুদের নিরাপদ মাত্রা

প্রতিদিন ৫০০ থেকে ২০০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত হলুদ খাওয়া নিরাপদ। দৈনিক দুই থেকে আড়াই হাজার মিলিগ্রাম হলুদের গুড়া রান্নায় ব্যবহার করলে তা থেকে কারকিউমিন মিলবে ৬০ থেকে ১০০ মিলিগ্রাম এতে দেহের কোন অসুবিধা হয় না।

তবে হলুদ সাপ্লিমেন্ট খেতে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

References

Gunnars K. (2021, 7may). 10 Proven Health Benefits of Turmeric and Curcumin. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/top-10-evidence-based-health-benefits-of-turmeric

Last Updated on May 15, 2023