স্তন ক্যান্সার (Breast cancer) সাধারণত বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে হতে দেখা যায়। পুরুষের ক্ষেত্রেও স্তন ক্যান্সার হতে পারে তবে তা খুব বিরল। স্তন ক্যান্সার একটি জটিল প্রকৃতির রোগ যার চিকিৎসা পদ্ধতি খুব ব্যয়বহুল হয়ে থাকে এবং স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা হিসেবে সার্জারির মাধ্যমে স্তন কেটে ফেলার প্রয়োজন পড়ে। স্তন কেটে ফেলা একজন নারীর জন্য সৌন্দর্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই স্তন ক্যান্সার যেন না হয় সেই ব্যাপারে অর্থাৎ স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেষ্ট হতে হবে।  

স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে খাবারের ভূমিকা রয়েছে। স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে এমন ১২টি খাবার নিয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

যেসব খাবার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে 

যেসব খাবার নিয়মিত খাওয়া স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে তা নিচে তুলে ধরা হলো। (Fernando, 2022) 

১। শাকসবজি  

Vegetables

শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট (Antioxidant) রয়েছে যা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। দৈনিক খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি রাখতে হবে। বিশেষ করে পালংশাক, ব্রকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, মিষ্টি কুমড়া, লেটুস, বীট ইত্যাদি বেশি বেশি খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। 

শাকসবজি যতটা সম্ভব কম তাপে রান্না করা উচিত। অর্থাৎ সিদ্ধ হয়ে গেলে আর দীর্ঘসময় পর্যন্ত আগুনের তাপে রাখা যাবে না। কারণ তাপের ফলে পুষ্টিগুণ কমে যায়। যেসব সবজি (টমেটো, গাজর, শশা ও কাঁচা পেঁপে) কাঁচা অবস্থায় খাওয়া যায় সেগুলো রান্না না করে বরং সালাদ হিসেবে খাওয়া উত্তম।‌ 

২। ফলমূল (Fruits) 

ফল থেকে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেলস ও এন্টি অক্সিডেন্ট পাওয়া যায় যা স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। বিশেষ করে সাইট্রাস গোত্রের ফল (লেবু, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুর, আমলকী, স্ট্রবেরি, জাম, ডুমুর, ডালিম, আনারস ও কিসমিস), মৌসুমী ফল (আম, কাঠাল, লিচু, তরমুজ ইত্যাদি) সহ আপেল, পেয়ারা, কলা, পাকা পেঁপে ইত্যাদি বেশি বেশি খেতে হবে। ফলের জুস না খেয়ে বরং ফল খাওয়া উত্তম। 

৩। আঁশযুক্ত শর্করা 

শরীরের ক্যালরি চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ শর্করা জাতীয় খাবার থেকে গ্রহণ করতে হবে। 

ভাত ও ময়দার রুটি হলো আমাদের দেশের প্রধান খাবার যা সরল শর্করা। আর সরল শর্করা জাতীয় খাবার স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। 

তাহলে শর্করার চাহিদা মেটানোর উপায় কি? 

সরল শর্করা (ভাত ও ময়দার তৈরি খাবার) না খেয়ে বরং আঁশযুক্ত শর্করা জাতীয় খাবার খেতে হবে। যেমনঃ বাদামী চালের ভাত, আটার রুটি, যব, ওটস ইত্যাদি। 

ওটস খাওয়ার বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

৪। ভালো মানের প্রোটিন 

Fish: High protein

শরীরের জন্য প্রোটিন জাতীয় খাবার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা প্রতিদিনের ক্যালরি চাহিদার নূন্যতম ১০ শতাংশ হওয়া উচিত। স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত ভালো মানের প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। যেমনঃ মাছ, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, মুরগির মাংস ইত্যাদি। বিশেষ করে মাছ স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। কারণ এতে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড যা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। 

দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারে থাকা ফ্যাট হার্টের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই নিরাপদ হলো লো ফ্যাট বা ফ্যাট ফ্রি দুধ খাওয়া। এছাড়াও ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ল্যাকটোজ ফ্রি দুধ খেতে হবে।

৫। বাদাম (Nuts)  

বাদাম সহজলভ্য ও মজাদার একটি খাবার যা শরীরের জন্য অনেক উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। বাদামে থাকা ভিটামিন, মিনারেলস, এন্টি অক্সিডেন্ট, উপকারী ফ্যাট ইত্যাদি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। বিভিন্ন ধরনের (আখরোট, চীনাবাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, পেস্তাবাদাম ইত্যাদি) বাদাম রয়েছে। যেকোনো এক ধরনের বাদাম প্রতিদিন খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। 

৬। রসুন ও পেঁয়াজ 

রসুন ও পেঁয়াজে থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট গুণাবলী স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মহিলাদের ক্ষেত্রে খাদ্য তালিকায় নিয়মিত পেঁয়াজ ও রসুন রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। পেঁয়াজ ও রসুন সাধারণত রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে বেশি উপকারিতা পাওয়ার জন্য প্রতিদিন এক কোয়া কাঁচা রসুন খাওয়া যেতে পারে। 

৭। ভিটামিন ডি 

ভিটামিন ডি শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভূমিকা রাখে যার মধ্যে অন্যতম হলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখা। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি থাকা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে। ভিটামিন ডি এর সবচেয়ে ভালো উৎস হলো সূর্য অর্থাৎ সূর্য রশ্মি ত্বকে সরাসরি লাগলে শরীরে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয়। এছাড়াও যেসব খাবার থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায় তা হলো মাছ, দুধ, ডিমের কুসুম, মাশরুম, কমলা, শস্যদানা ইত্যাদি। 

শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব হলে কি কি লক্ষণ দেখা যায় তা জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।  

৮। মিষ্টি আলু 

মিষ্টি আলু ফাইবার, ভিটামিন, মিনারেলস ও এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ একটি খাবার যা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। এক্ষেত্রে সাদা বর্ণের মিষ্টি আলুর তুলনায় রঙ্গিন মিষ্টি আলু খাওয়া বেশি উপকারী হবে। কারণ রঙ্গিন মিষ্টি আলুতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে। 

ফাইবার সমৃদ্ধ ১৮টি খাবার সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।  

৯। পানি 

শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখার জন্য দৈনিক ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হবে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ ঘাম ও মুত্রের মাধ্যমে বেড়িয়ে যেতে সাহায্য করে। এছাড়াও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করার মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে পানি পান করার ভূমিকা রয়েছে। 

১০। গ্রিন টি (Green tea) 

সবধরনের চায়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হলো গ্রিন টি যা নিয়মিত পান করার ফলে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। দিনে ২ থেকে ৩ কাপ গ্রিন টি (চিনি ছাড়া) পান করতে হবে। 

গ্রিন টি পান করার বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন। 

১১। অলিভ অয়েল (Olive oil) 

অলিভ অয়েল খাওয়া স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে। রান্নার কাজে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ব্যবহার করা বা সালাদের সাথে মিশিয়ে অলিভ অয়েল খাওয়া যেতে পারে। 

১২। ইয়োগার্ট (Yogurt) 

ইয়োগার্ট হলো প্রোবায়োটিকস সমৃদ্ধ একটি খাবার যা শরীরের জন্য বিভিন্ন উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রোবায়োটিকস সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত খাওয়া স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে।  

স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে যেসব খাবার এবং পানীয় এড়ানো উচিত 

স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে নিচে উল্লেখিত খাবারগুলো বর্জন করা উচিত। তবে এসব খাবার একেবারেই বাদ দিতে না পারলে যতটা সম্ভব কম খেতে হবে। (Dresden, 2019)

  • চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার
  • কোমল পানীয় (Soft drink)
  • ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস
  • ফাস্টফুড (Fast food) 
  • পোড়া তেলে ভাজা খাবার 

শরীরের অতিরিক্ত ওজনের সাথে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। আর তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রতিদিন নূন্যতম ৩০ মিনিট হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম (সপ্তাহে ৫ দিন) করতে হবে। 

এছাড়াও শিশুকে বুকের দুধ পান করাতে হবে। কারণ এতে শিশু মায়ের বুকের দুধের পুষ্টি পায় এবং মায়ের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।  

References

Dresden, D. (2019, July 22). Dietary choices to help prevent breast cancer. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/316720

Fernando, I. (2022, 10 07). What Foods Help Prevent Breast Cancer Risk? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/breast-cancer-foods

Last Updated on October 30, 2023