শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার গ্রহণ করা। সাধারণত একজন পুরুষ মানুষের জন্য দৈনিক ২৪০০ ক্যালোরি এবং মহিলাদের জন্য দৈনিক ২০০০ ক্যালোরি গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ করার ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যায়। আর তাই যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা কম ক্যালোরি গ্রহণ করতে হবে। কম ক্যালোরি গ্রহণ করার ফলে শরীরে জমে থাকা ফ্যাট বার্ন হয়ে ক্যালোরি সরবরাহ করবে এবং শরীরের ওজন কমতে থাকবে।

কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাবার হলো ক্যালোরির উৎস। প্রতি ১ গ্রাম ফ্যাট থেকে ৯ ক্যালোরি এবং প্রতি ১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন থেকে ৪ ক্যালোরি পাওয়া যায়। ফাইবার, ভিটামিন, খনিজ উপাদান, পানি ইত্যাদিতে কোনো ক্যালোরি নেই। এই অনুচ্ছেদে কম ক্যালোরিযুক্ত ১০ টি খাবার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে যা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। (Ajmera, 2023)

১০ টি কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার:

১. ওটস (Oats) 

দৈনিক ক্যালোরি চাহিদার সবচেয়ে বড় উৎস হলো কার্বোহাইড্রেট আর আমাদের দেশে কার্বোহাইড্রেট বলতে ভাত বোঝানো হয়ে থাকে।‌ ভাত আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো এটি একটি রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট বা সরল শর্করা যা দ্রুত হজম হয় ও মেটাবলিসমের মাধ্যমে প্রচুর ক্যালোরি সরবরাহ করে।

ওজন কমানোর জন্য ভাতের বিকল্প হিসেবে ওটস (Oats) দারুন উপকারী হতে পারে। ওটস সরল শর্করা নয় বরং এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও নিয়মিত ওটস খাওয়ার ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং হার্টের রোগ ও‌ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।‌ 

ওটস ধীরে ধীরে হজম হয় বলে ওটস খাওয়ার ফলে দীর্ঘসময় পেট ভরা থাকে। ওজন কমানোর জন্য সকালে ও বিকালে ওটস খেতে হবে। ১ কাপ পরিমাণ ওটস থেকে ৩০৭ ক্যালোরি পাওয়া যায়। ওটসের সাথে দুধ, কলা, দই ইত্যাদি মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে এবং সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।‌ 

২. দই (Yogurt) 

দই (Yogurt) হলো একটি প্রোবায়োটিক ফুড যা অন্ত্রে থাকা শরীরের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ১০০ গ্রাম দই থেকে ৬৩ ক্যালোরি পাওয়া যায়। দই এর ধরন ভেদে ক্যালোরির পরিমাণ কম বেশি হতে পারে। তবে দই একটি প্রোবায়োটিক ফুড যা ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেট মেটাবলিসমে সহায়তা করার মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।‌ 

ওটসের সাথে দই মিশিয়ে দারুন সকালের নাস্তা হতে পারে যা একাধারে সুস্বাদু ও কম ক্যালোরি সম্পন্ন হবে। এছাড়াও দীর্ঘসময় পেট ভরা রাখবে যার ফলে একটু পরেই পুনরায় খাবার খাওয়ার প্রয়োজন হবে না। 

৩. স্যুপ (Soup) 

স্যুপ হলো তরল‌ প্রকৃতির একটি খাবার যার অনেকগুলো ধরন রয়েছে এবং ধরন অনুযায়ী ক্যালোরির পরিমাণ‌ কম বেশি হয়ে থাকে। তবে ক্যালোরির পরিমাণ সাধারণত এতো বেশি হয় না‌ যা শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।‌‌ বরং স্যুপ খুব স্বাস্থ্যকর একটি খাবার যা ক্ষুধার অনুভূতি কমায় এবং পেট‌ ভরা রাখতে সাহায্য করে। যারা‌ নিয়মিত স্যুপ খায় তাদের শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে‌ থাকে এবং পেটে অতিরিক্ত চর্বি জমে না। 

স্বাস্থ্যকর স্যুপ তৈরির জন্য ফুল ফ্যাট দুধ, কর্নস্টার্চ (Cornstarch), ডিমের কুসুম ও পনির সহ কৃত্রিম উপকরণের সংখ্যা যতটা সম্ভব কম হওয়া উচিত। এছাড়াও পরিমিত পরিমাণে লবণ ব্যবহার এবং স্যুপ যেন খুব বেশি ঘন‌ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৪. ডিম (Eggs) 

ডিমে খুব ভালো মানের প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, ভিটামিন ডি, মিনারেলস, কোলাইন (choline) ও এন্টি অক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। একটি সিদ্ধ ডিমে ৮৪ ক্যালরি রয়েছে যা সকালের নাস্তার সাথে দারুন একটি উপাদান হতে পারে। তবে তেল দিয়ে ডিম ভাজি করা হলে তেলে থাকা ক্যালোরি অতিরিক্ত হিসেবে যোগ হয়। আর তাই শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিম ভেজে না খেয়ে বরং সিদ্ধ করে খাওয়া উচিত। 

গর্ভবতী নারী সহ ছোট বড় সকলের জন্য ডিম খাওয়া নিরাপদ।‌ ডিম খাওয়ার ফলে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। চীন দেশের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ১টি করে ডিম খাওয়ার ফলে হার্টের রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়। (Lewin, 2021)

৫. পপকর্ণ (Popcorn) 

১ কাপ পরিমাণ (৮ গ্রাম) পপকর্ণে মাত্র ৩১ ক্যালোরি রয়েছে। স্ন্যাকস হিসেবে পপকর্ণ খাওয়ার ফলে ক্ষুধার অনুভূতি কমে যায় যা বেশি খাবার খাওয়ার প্রবণতা হ্রাস করে।‌ পপকর্ণ খাওয়ার মাধ্যমে শরীরের ওজন কমানো এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।‌

তবে অনেক বেশি পরিমাণে পপকর্ণ খাওয়া যাবে না।‌ এছাড়াও অতিরিক্ত তেল, চিনি ও লবণ দিয়ে পপকর্ণ বানানো হয়েছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অতিরিক্ত ফ্যাট, লবণ ও চিনি সমৃদ্ধ পপকর্ণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। 

৬. চিয়া বীজ (Chia seeds) 

চিয়া বীজ (Chia seeds)

 

শরীরের ওজন কমাতে আগ্রহী মানুষদের কাছে চিয়া বীজের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারণ প্রচুর ফাইবার সমৃদ্ধ এই বীজগুলো সামান্য পরিমাণে খাওয়া হলেই তা ক্ষুধার অনুভূতি কমাতে সাহায্য করে। 

১ গ্লাস পানিতে ১ থেকে ২ চা‌ চামচ পরিমাণ চিয়া বীজ মিশিয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ভিজিয়ে রাখার পর খালিপেটে খেয়ে ফেলুন। এতে ক্ষুধার অনুভূতি অনেকটাই কমে যাবে এবং অল্প পরিমাণ খাবার খেয়ে পেট ভরা‌ থাকবে।

১ আউন্স (২৮ গ্রাম বা ২ টেবিল চামচ) চিয়া বীজে ১৩৮ ক্যালোরি রয়েছে। নিয়মিত চিয়া বীজ খাওয়ার ফলে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ সহ ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ ও ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। 

৭. মাছ (Fish) 

স্বাস্থ্যকর প্রোটিন ও শরীরের জন্য উপকারী ফ্যাট তথা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিডের খুব ভালো একটি উৎস হলো মাছ। এছাড়াও মাছ থেকে ভিটামিন ও‌ মিনারেলস পাওয়া যায় যা শরীরের জন্য খুব উপকারী ভূমিকা রাখে। 

মাছের ধরন অনুযায়ী ক্যালোরির পরিমাণ ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমনঃ ১০০ গ্রাম টুনা মাছ থেকে ১০৯ ক্যালোরি পাওয়া যায়। আবার চর্বিযুক্ত মাছে তুলনামূলক বেশি ক্যালোরি থাকে তবে তা ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না।‌

 

গবেষণায় দেখা গেছে যে, যাদের নিয়মিত মাছ খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। আর তাই সপ্তাহে অন্তত ২ দিন মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। 

 

৮. আলু (Potatoes) 

আলু খুব সহজলভ্য একটি খাবার যা ভর্তা, ভাজি,‌ রান্না সহ বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যায়। খোসা সহ ১০০ গ্রাম সিদ্ধ আলু মাত্র ৯৪ ক্যালোরি সরবরাহ করে। আলুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার সহ সামান্য ভিটামিন ও মিনারেলস রয়েছে।‌ আলু শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কারণ, আলু খাওয়ার ফলে ক্ষুধার অনুভূতি কমে যায় এবং পেট ভরা রয়েছে বলে মনে হয়। 

আলুর তৈরি ফ্রেন্চ ফ্রাই ও পটেটো চিপস স্বাস্থ্যকর নয় এবং আর তাই এসব খাবার যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে।

 

সাধারণ আলুর চেয়ে বেশি পুষ্টিগুণ কিন্তু কম ক্যালোরি সম্পন্ন হলো মিষ্টি আলু (Sweet potatoes) যার প্রতি ১০০ গ্রামে মাত্র ৮৬ ক্যালোরি রয়েছে। এছাড়াও এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা শরীরের ওজন কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।‌

৯. চর্বিহীন মাংস (Lean meat) 

চর্বিহীন মাংস কম ক্যালোরি সম্পন্ন হয়ে থাকে। কারণ, মাংসের ক্যালোরির একটি বড় অংশ আসে চর্বি থেকে। যেমনঃ ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে ২৬ গ্রাম প্রোটিন এবং ১২ গ্রাম চর্বি থাকে। প্রতি ১ গ্রাম প্রোটিন থেকে ৪ ক্যালোরি পাওয়া যায় পক্ষান্তরে ১ গ্রাম চর্বিতে ৯ ক্যালোরি রয়েছে। চর্বি বাদ দিলে মাংসের ক্যালোরি প্রায় অর্ধেক কমে যায়। আর তাই যতটা সম্ভব চর্বিহীন মাংস খেতে হবে।‌ বিশেষ করে মুরগির চামড়াতে প্রচুর পরিমাণে চর্বি রয়েছে যা খাওয়া উচিত নয়। 

প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেটের মধ্যে সমান অনুপাতে ক্যালোরি (১ গ্রামে ৪ ক্যালোরি) রয়েছে তবে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হজম ও মেটাবলিসমের জন্য শরীরের নিজস্ব ক্যালোরি ব্যয় হওয়ার হার বেশি। আর তাই শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে উৎসাহ দেওয়া হয়। 

১০. তরমুজ (Watermelon) 

তরমুজ (Watermelon)

 

তরমুজের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে পানি এবং এতে খুব অল্প পরিমাণ ক্যালরি রয়েছে। এক স্লাইস পরিমাণ তরমুজ (প্রায় ১৫২ গ্রাম) থেকে মাত্র ৪৬ ক্যালরি পাওয়া যায় এবং সামান্য পরিমাণে ভিটামিন এ ও সি রয়েছে। 

তরমুজ ছাড়াও আরো অনেক ফল রয়েছে যেগুলো কম ক্যালরি সম্পন্ন কিন্তু পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। যেমনঃ আনারস, পেঁপে, সবুজ আপেল, কমলা, স্ট্রবেরি, জাম্বুরা, আঙ্গুর ইত্যাদি। অল্প কিছু খাবার খাওয়ার পরে ফল খেলে পেট ভরা থাকবে তবে ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ খুব বেশি হবে না। 

References

Ajmera, R. (2023, February 22). 13 Low Calorie Foods That Are Surprisingly Filling. Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/nutrition/low-calorie-foods

Lewin, J. (2021, August 31). Top 5 health benefits of eggs. Retrieved from bbc good food: https://www.bbcgoodfood.com/howto/guide/ingredient-focus-eggs/amp

 

Last Updated on April 16, 2023