আমরা প্রতিনিয়ত যে খাবার খেয়ে থাকি তা হার্টের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ সহ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার বর্জন করা জরুরী।
খাবার গ্রহণ এবং জীবন যাপনের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম মেনে চলা হার্টের রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং সুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। এই অনুচ্ছেদে হার্টের রোগীর জন্য যেসব খাবার খাওয়া উচিত এবং যা এড়িয়ে চলা উচিত সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
হার্টের রোগীদের কী খাবার খাওয়া উচিত?
হার্টের জন্য উপকারী খাবারগুলো সম্পর্কে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার
আমাদের দেশে খাদ্য তালিকার একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে শর্করা জাতীয় খাবার। অর্থাৎ ভাত অথবা রুটি। শর্করা জাতীয় খাবার থেকে প্রতিদিনের ক্যালরি চাহিদার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ করা যেতে পারে। তবে সেই শর্করা জাতীয় খাবার হতে হবে উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ।
সাদা ভাত, ময়দার তৈরি রুটি, বিস্কুট ও পাউরুটিতে খুব সামান্য পরিমাণ ফাইবার থাকে। পক্ষান্তরে বাদামী চালের ভাত, লাল আটার রুটি, ওটস (Oats), যব ইত্যাদি হলো উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ শর্করা জাতীয় খাবার যা হার্টের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সাহায্য করে।
এছাড়াও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেলে তা কোষ্ঠকাঠিন্য ও কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সহ শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রায় সবগুলো খাবারের মধ্যেই কমবেশি ফাইবার রয়েছে। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আপেল, নাশপাতি, স্ট্রবেরি, অ্যাভোকাডো, গাজর, ব্রকলি, বাঁধাকপি, শিম, ছোলা, মিষ্টি আলু, বাদাম, কলা ইত্যাদি।
ভালো মানের প্রোটিন
শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাদ্য উপাদান হলো প্রোটিন। ডিম, মাছ, মাংস, দুধ ইত্যাদি হলো প্রোটিনের সবচেয়ে ভালো উৎস। এছাড়াও উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত কিছু খাবার (ডাল, শিম, বাদাম, সয়াবিন, পালংশাক ইত্যাদি) থেকে সামান্য পরিমাণে প্রোটিন পাওয়া যায়।
শরীরের ওজন প্রতি ১ কেজির জন্য ১ গ্রাম অনুপাতে দৈনিক প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে। হার্টের রোগীদের জন্য সবচেয়ে ভালো মানের প্রোটিন হলো মাছ যা সপ্তাহে অন্তত দুই দিন খাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। মাছে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড যা হার্টের জন্য অত্যন্ত উপকারী। (University of California, San Francisco)
সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়া হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়ায় না। তবে অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে তাদের জন্য ডিমের কুসুম ও হাসের ডিম খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
মাংসের মধ্যে মুরগির মাংস খাওয়া যাবে তবে চামড়া খাওয়া যাবে না। এছাড়াও গরু, খাসি ও ভেড়ার মাংস না খাওয়াই উত্তম। একান্তই খেতে চাইলে পরিমাণে খুবই কম এবং চর্বিযুক্ত অংশ বাদ দিয়ে খেতে হবে।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার বর্জন করা উচিত। তবে ফ্যাট ফ্রি দুধ ও ইয়োগার্ট খাওয়া যাবে। এছাড়াও উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন গুলো খাওয়া নিরাপদ হবে। (WENDLER, 2022)
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট বলতে আনস্যাচুরেটেড (Unsaturated) ফ্যাট বোঝানো হয়েছে। যেমনঃ ওলিভ অয়েল, সূর্যমুখী তেল, বাদাম তেল, সয়াবিন, রাইস ব্রান অয়েল ইত্যাদি।
দৈনিক ক্যালরি চাহিদার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ফ্যাট থেকে নেওয়া যাবে। সেই হিসেবে মোটামুটি পরিশ্রমী একজন মানুষের জন্য দৈনিক ৭৫ গ্রাম ফ্যাট খাওয়া নিরাপদ। তবে যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের জন্য আরো কম পরিমাণে ফ্যাট খেতে হবে। কারণ ফ্যাট অনেক বেশি ক্যালরি সম্পন্ন যা শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ফলমূল ও শাকসবজি
সবচেয়ে কম ক্যালোরিযুক্ত ও উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার হলো ফলমূল ও শাকসবজি। হার্টের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে।
শাকসবজি যতটা সম্ভব কম তাপে রান্না করতে হবে। কারণ তাপের প্রভাবে ভিটামিন ও এন্টি অক্সিডেন্ট (Antioxidants) নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তাই দীর্ঘসময় ধরে শাকসবজি রান্না করা যাবে না। আর কিছু কিছু সবজি (টমেটো, গাজর, শশা, কাঁচা পেঁপে ইত্যাদি) সালাদ হিসেবে খাওয়া বেশি উপকারী হবে।
প্রতিবেলা খাবার খাওয়ার সময় একদম পেট ভরে না খেয়ে বরং খাওয়ার শেষে ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এছাড়াও স্ন্যাকস হিসেবে ফল খাওয়া যেতে পারে। ফলের জুস বানিয়ে খাওয়ার চেয়ে আস্ত ফল খাওয়া বেশি উপকারী হবে।
যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের জন্য মিষ্টি ফল (খেজুর, তরমুজ, আম, আঙ্গুর, আনারস, কলা, কাঁঠাল ইত্যাদি) পরিমিত মাত্রায় খেতে হবে।
বাদাম
কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, চীনাবাদাম সহ অনেক ধরনের বাদাম রয়েছে যা স্ন্যাকস হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। বাদামে থাকে ফাইবার যা দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখে। এছাড়াও বাদামে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও মিনারেলস সহ এন্টি অক্সিডেন্ট যা হার্টের জন্য অনেক উপকারিতা বয়ে আনে।
কাঁচা বাদামে পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন থাকে। তাই ভাজা বাদাম না খেয়ে বরং কাঁচা অবস্থায় খাওয়ার চেষ্টা করুন। প্রতিদিন যেকোনো ধরনের (চীনাবাদাম সবচেয়ে সহজলভ্য) ৩০ গ্রাম বাদাম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। বাদামের সাথে লবণ মিশিয়ে খেতে ভালো লাগে। তবে অতিরিক্ত লবণ হার্টের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই বাদামের সাথে লবণ খাওয়া যাবে না।
পানি
শরীরের সার্বিক কার্যক্রমে পানির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে (২ থেকে ৩ লিটার) পানি পান করতে হবে। এছাড়াও শরীরে পানি সরবরাহের জন্য ফলের রস, শরবত, ডাবের পানি, ফল, শাকসবজি ইত্যাদি খাওয়া উপকারী হবে।
চা ও কফি নিরাপদ তবে অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে পান করা উচিত। দিনে ২ থেকে ৩ কাপ চা অথবা কফি পান করা হার্টের জন্য উপকারী হবে। তবে চায়ে চিনি মেশানো যাবে না। এছাড়াও রাতে চা ও কফি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এতে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। রাতে ভালো ঘুম না হলে তা হার্টের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
হার্টের রোগীদের কী খাবার খাওয়া উচিত নয়?
চিনি
চিনি কে বলা হয় সাদা বিষ (White poison) যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখে অথবা না দেখে খাচ্ছি। মিল্ক ব্রেড পাউরুটি, জেলি, বাজারে কিনতে পাওয়া ফ্রুট জুস, কোমল পানীয় ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে যা হয়তো অনেক মানুষ জানেন না। চিনি ও চিনিযুক্ত খাবার যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে।
লবণ (NaCl)
খাবারের একটি অপরিহার্য উপাদান হলো লবণ। তবে এই লবণ বেশি পরিমাণে খাওয়া যাবে না। কারণ তা হার্টের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে বিশেষ করে রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রতিদিন ৫ গ্রামের (১ চা চামচ পরিমাণ) বেশি লবণ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। (World Health Organization, 2020)
খাওয়ার সময় অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার অভ্যাস থাকলে তা পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়াও অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবারগুলো (পটেটো চিপস, সস, ফাস্টফুড, চানাচুর ও প্রক্রিয়াজাত মাংস) বর্জন করা উচিত।
ক্ষতিকর ফ্যাট
ক্ষতিকর ফ্যাট বলতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাটকে বোঝানো হয়েছে। এই দুই ধরনের ফ্যাট রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল (LDL– low density lipoprotein) এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL– high density lipoprotein) এর মাত্রা কমিয়ে দেয়। রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বেশি থাকা হার্টের রোগ সৃষ্টির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
গরু ও খাসির মাংস, দুধ মাখন, পনির, ঘি, পাম অয়েল, নারিকেল তেল ইত্যাদি হলো স্যাচুরেটেড ফ্যাটের উৎস যা খুব সামান্য পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে। তবে ট্র্যান্স ফ্যাট যুক্ত খাবারগুলো (পোড়া তেলে ভাজা খাবার, পটেটো চিপস, ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার) একদম বর্জন করা উচিত।
ধুমপান ও মদ্যপান
ধুমপান খাবারের অন্তর্ভুক্ত নয় তবে একজন ধুমপায়ী ব্যক্তি খাবারের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন ধুমপানের ব্যাপারে যা ভয়াবহ রকমের নেশা। এই নেশা হার্ট ও ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই আপনার যদি ধূমপানের অভ্যাস থাকে তবে যেভাবেই হোক এই অভ্যাস বর্জন করতে হবে।
মদ্যপানের অভ্যাস রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের (Triglycerides) মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে যা হার্টের রোগ সৃষ্টির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এছাড়াও মদ্যপানের ফলে ফ্যাটি লিভার ও লিভার সিরোসিসের মতো জটিল রোগ হতে পারে। তাই মদ্যপান করার অভ্যাস পরিত্যাগ করা জরুরী।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েডের সমস্যা, কিডনি ডিজিজ, ফ্যাটি লিভার, আইবিএস ইত্যাদি সহ জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ডায়েট সম্পর্কে জানার জন্য একজন পুষ্টিবিদের (Dietitian) শরণাপন্ন হতে হবে।
হার্টের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের জন্য খাবার গ্রহণের ব্যাপারে নিয়ম মেনে চলার পাশাপাশি আরো যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে তা হলোঃ
- প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট এবং সপ্তাহে ৫ দিন ব্যায়াম করতে হবে।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট হতে হবে।
- রাতে ভালো ঘুম (৭ থেকে ৯ ঘন্টা) হওয়া জরুরী।
Bibliography
University of California, San Francisco. (n.d.). Eating Right for Your Heart. Retrieved from UCSF Health: https://www.ucsfhealth.org/education/eating-right-for-your-heart
WENDLER, R. (2022, May 12). Heart-healthy diet. Retrieved from MD Anderson Cancer Center: https://www.mdanderson.org/cancerwise/cardiac-diet-heart-healthy-diet-what-is-it–what-can-you-eat-and-what-should-you-avoid.h00-159539745.html
World Health Organization. (2020, April 29). Healthy diet. Retrieved from WHO: https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/healthy-diet
Last Updated on November 1, 2023
Leave A Comment