গুলেন ব্যারি সিনড্রোম (GBS) কি? একটি বিরল প্রকৃতির অটো ইমিউন ডিজিজ হলো গুলেন ব্যারি সিনড্রোম (Guillain-Barre Syndrome) যেখানে স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। বিশেষ করে শরীরের প্রান্তীয় স্নায়ুর সংবেদনশীলতা বা কার্যক্ষমতা কমে যায় যার ফলে শরীর ও মস্তিষ্কের মধ্যে সংকেত আদান প্রদান ব্যাহত হয়। 

গুলেন ব্যারি সিনড্রোমের ফলে শরীরে অস্থায়ী প্রকৃতির প্যারালাইসিস (Paralysis) দেখা যায়। আবার কখনো কখনো তা স্থায়ী সমস্যা সহ অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এই অনুচ্ছেদে গুলেন ব্যারি সিনড্রোম (GBS) এর কারণ, কাদের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা, জটিলতা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

গুলেন ব্যারি সিনড্রোম (GBS) এর কারণ কি? 

গুলেন ব্যারি সিনড্রোম (GBS) হলো একটি অটো ইমিউন ডিজিজ অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউন সিস্টেম ভুল করে শরীরের নিজস্ব কোষকে (নার্ভ বা স্নায়ু) আক্রমণ করে থাকে এবং এর ফলে নার্ভের কার্যক্ষমতা কমে যায়। তবে ঠিক কেন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমন আচরণ করে (গুলেন ব্যারি সিনড্রোম হওয়ার প্রকৃত কারণ) তা জানা যায়নি। তবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার এমন অস্বাভাবিক আচরণের সাথে কিছু বিষয়ের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। যেমনঃ (Mayo Clinic, 2022) 

  • শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন 
  • পরিপাকতন্ত্রের ইনফেকশন 
  • সার্জারি অথবা আঘাত 
  • জিকা ভাইরাস 
  • ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস 
  • Cytomegalovirus
  • Epstein-Barr virus
  • Mycoplasma pneumonia
  • Hodgkin’s lymphoma

যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে গুলেন ব্যারি সিনড্রোম হতে পারে। তবে ৫০ বছরের অধিক বয়সী ব্যক্তি এবং মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়াও হেপাটাইটিস এ, বি, সি ও ই আক্রান্ত ব্যক্তি এবং এইডস (AIDS) রোগীদের ক্ষেত্রে গুলেন ব্যারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়।

গুলেন ব্যারি সিনড্রোম (GBS) এর লক্ষণগুলি কী কী? 

স্নায়ু মস্তিষ্কের সাথে সিগন্যাল বা অনুভূতি আদান প্রদান সহ পেশি পরিচালনা করে থাকে। গুলেন ব্যারি সিনড্রোমের আক্রমণ স্নায়ুতে হয়ে থাকে। আর তাই এই রোগের লক্ষণগুলো স্নায়ু ও পেশি কেন্দ্রিক দেখা যায়। যেমনঃ (Cafasso, 2021) 

  • প্রথমদিকে পায়ে ঝিনঝিন অনুভব হয় এবং দুর্বলতা দেখা যায় 
  • পরবর্তীতে দুই পা থেকে দুই হাতে এই সমস্যা ছড়িয়ে পড়তে থাকে 
  • হাত ও পায়ের কব্জি ও আঙ্গুলে সুচ ফোটানোর মতো ব্যথা অনুভব হয় 
  • হাঁটাহাঁটি ও সিঁড়ি বেয়ে উঠা নামা করতে অসুবিধা হয় 
  • মুখমণ্ডলের পেশি আক্রান্ত হয়ে কথা বলা, খাওয়া, চোখের নড়াচড়া ইত্যাদিতে অসুবিধা হয় 
  • কোমড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব হয় 
  • মুত্র নিঃসরণে নিয়ন্ত্রণ থাকে না  
  • হার্ট রেট বেড়ে যায় 
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হয় 
  • প্যারালাইসিস 

গুলেন ব্যারি সিনড্রোমের চিকিৎসার জন্য জরুরী ভিত্তিতে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ করে পায়ে ঝিনঝিন ও দুর্বলতা এবং তা ধীরে ধীরে হাতের দিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

রোগ নির্ণয় 

প্রাথমিক পর্যায়ে গুলেন ব্যারি সিনড্রোম নির্ণয় করা খুব কঠিন। কারণ স্নায়ুবিক অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। চিকিৎসক রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীর মুখে বর্ণনা শোনা সহ শারীরিক পর্যবেক্ষণ এবং কতিপয় টেস্ট করানোর নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেমনঃ 

  • Spinal tap (Lumbar puncture): শিরদাঁড়া (Spinal canal) থেকে সরু সুচের সাহায্যে তরল সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। 
  • Electromyography: পেশিতে নার্ভের কার্যক্ষমতা জানার জন্য সুক্ষ্ম সুচের মতো ইলেক্ট্রোড (Electrodes) পেশির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। 
  • Nerve conduction studies: ত্বকে (নার্ভ রয়েছে এমন স্থানে) ইলেক্ট্রোড স্থাপন করে নার্ভের মধ্যে দিয়ে কত দ্রুত সিগন্যাল যেতে পারে তা দেখা হয়।   

চিকিৎসা 

গুলেন ব্যারি সিনড্রোমের ক্ষেত্রে ইমিউন সিস্টেম একধরনের এন্টিবডি (Antibodies) তৈরি করে যা স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। এই রোগের চিকিৎসার উদ্দেশ্য হলো শরীর থেকে এন্টিবডি দূর করা যা দুইটি পদ্ধতিতে করা হয়। যেমনঃ 

Plasma Exchange (Plasmapheresis) 

বিশেষ একটি যন্ত্রের সাহায্যে রক্তে থাকা এন্টিবডি দূর করা হয়। তবে এটি খুব ব্যয়বহুল একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা বাংলাদেশের মাত্র কয়েকটি হাসপাতালে রয়েছে। যেমনঃ নিউরোসায়েন্স ইন্সটিটিউট, স্কয়ার হাসপাতাল ইত্যাদি। 

Immunoglobulin Therapy 

শিরার মাধ্যমে একধরনের ইমিউনোগ্লোবিন (Immunoglobulin) দেওয়া হয় যা এন্টিবডি (গুলেন ব্যারি সিনড্রোমের সাথে সম্পর্কিত) ধ্বংস করে দেয়। এই পদ্ধতিটি তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল।‌ 

এছাড়াও ব্যথা নিরাময়ের জন্য ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যথা নাশক ওষুধ সেবন এবং পেশির কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনার জন্য ফিজিওথেরাপি নেওয়া যেতে পারে। 

জটিলতা 

সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করা হলে এই রোগের ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশ রোগী ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ১ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। এছাড়াও পরবর্তী সময়ে পুনরাক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম দেখা যায়। 

তীব্র প্রকৃতির আক্রমণ অথবা যথাসময়ে চিকিৎসা গ্রহণের অবহেলা জনিত কারণে এই রোগের ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা দেখা যায় তা হলোঃ 

  • ফুসফুস এবং শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চলার সাথে সম্পর্কিত পেশি সমূহ আক্রান্ত হলে তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এমতাবস্থায় রোগীকে জরুরী ভিত্তিতে আইসিইউতে রাখতে হয়। অন্যথায় শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম বন্ধ হয়ে রোগী মারা যেতে পারে। 
  • রোগ সেরে যাওয়ার পরেও হাত ও পায়ে মৃদু প্রকৃতির ঝিনঝিন অনুভব ও দুর্বলতা দেখা যায়। 
  • ব্লাড প্রেসার উঠানামা করে, হার্টের স্পন্দন বা ছন্দ অনিয়মিত হয়ে যায় এবং হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। 
  • মুত্রথলি ও মলাশয়ের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে অসাড়ে মুত্র নিঃসরণ এবং মলত্যাগ হতে পারে। 
  • প্যারালাইসিস হয়ে চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়া এবং রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। 

প্রতিরোধ 

গুলেন ব্যারি সিনড্রোম সংক্রামক প্রকৃতির রোগ নয় অর্থাৎ এই রোগটি একজন অসুস্থ ব্যক্তি থেকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে না।‌ তাই কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমে এই রোগের আক্রমণ ঠেকানো যায় না। মোটকথা, গুলেন ব্যারি সিনড্রোম প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই। তবে আশার কথা হলো, জটিল এই‌ রোগটি বংশগতভাবে মা বাবা অথবা ভাই বোনদের কারো থাকলে সন্তান বা সহোদরের হবে এমন কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয় না। 

 

References

Cafasso, J. (2021, July 14). Guillain-Barré Syndrome (GBS). Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/guillain-barre-syndrome

Mayo Clinic. (2022, June 14). Guillain-Barre syndrome. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/guillain-barre-syndrome/symptoms-causes/syc-20362793

 

Last Updated on June 3, 2023