একজন সুস্থ পুরুষের বীর্যে অসংখ্য শুক্রাণু (Sperm) থাকে যা নারীর ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হওয়ার মাধ্যমে গর্ভধারণ তথা সন্তান জন্ম হয়ে থাকে। কোনো কারণ বশত পুরুষের বীর্যে শুক্রাণু অনুপস্থিত থাকলে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এজোস্পার্মিয়া (Azoospermia) বলা হয়। সুস্থ পুরুষের বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কত, এজোস্পার্মিয়া কেন হয়, শুক্রাণু না থাকলে করণীয় কি সেই বিষয়গুলো নিয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

এজোস্পার্মিয়া এর কারণ 

এজোস্পার্মিয়া সমস্যাটি বর্তমান সময়ে অনেক পুরুষের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যা ইনফার্টিলিটি তথা সন্তান না হওয়ার একটা অন্যতম প্রধান কারণ। এজোস্পার্মিয়া কেন হয় তা বুঝতে হলে আগে শুক্রাণু কোথায় কিভাবে উৎপাদন হয় এবং বীর্যপাতের প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকতে হবে। 

পুরুষের অন্ডকোষে শুক্রাণু উৎপাদন হয় আর এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে বিভিন্ন হরমোন যেমনঃ টেস্টোস্টেরন, ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন, লিউটিনাইজিং হরমোন ইত্যাদি। এই হরমোন গুলোর নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি গ্ল্যান্ড। তাহলে বোঝা যাচ্ছে খুব জটিল শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুক্রাণু উৎপাদন হয়ে থাকে। এখানেই শেষ নয়,‌ বরং শুক্রাণু উৎপাদনের পর শুক্রবাহী নালীর বিভিন্ন অংশ যেমনঃ এপিডিডাইমিস, ভাস ডিফারেন্স, সেমিনাল ভেসিকল সহ প্রস্টেট গ্রন্থিতে অবস্থান করা, বৃদ্ধি, চলাচল, পুষ্টি গ্রহণ ইত্যাদি কার্যক্রম চলে। সর্বশেষ বীর্যপাতের মাধ্যমে শুক্রাণু নিঃসরণ হয়ে থাকে। বীর্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বীর্য চলাচল অথবা বীর্যপাতের মাধ্যমে বীর্য নিঃসরণের প্রক্রিয়া গুলোর কোনো একটি ধাপে সমস্যা হলে তা এজোস্পার্মিয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেমনঃ (Gurevich, 2021)

  • পিটুইটারি গ্ল্যান্ড অথবা হাইপোথ্যালামাস এর সমস্যার দরুণ প্রয়োজনীয় হরমোন নিঃসরণ না হওয়া 
  • যথাযথ হরমোনের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও অন্ডকোষ শুক্রাণু উৎপাদনে ব্যর্থ হওয়া 
  • অন্ডকোষে শুক্রাণু উৎপাদন হয় কিন্তু শুক্রবাহী নালীর সমস্যার দরুণ চলাচল করতে পারে না
  • পশ্চাৎমুখী বীর্যপাত (Retrograde ejaculation) অর্থাৎ বীর্যপাতের মাধ্যমে বীর্য শরীরের বাইরে বের না হওয়া ইত্যাদি 

এজোস্পার্মিয়া নির্ণয়

শুক্রাণুর আকার এতোই ক্ষুদ্র (৩ থেকে ৪ মাইক্রোমিটার) হয়ে থাকে যা খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। আর তাই বীর্যে শুক্রাণু আছে কি নেই তা খালি চোখে বোঝা যাবে না। তবে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই,‌ কারণ ল্যাবরেটরিতে খুব সহজ একটি পরীক্ষার মাধ্যমে এজোস্পার্মিয়া নির্ণয় করা যায়। এই‌ পরীক্ষাটির নাম হলো সিমেন এনালাইসিস (Semen Analysis) যার জন্য নমুনা হিসেবে বীর্য সংগ্রহ করা হয়।‌

একজন সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষের প্রতি মিলিলিটার বীর্যে ১৫ থেকে ২০০ মিলিয়ন পর্যন্ত শুক্রাণু থাকতে পারে। প্রতি মিলিতে সর্বনিম্ন ১৫ মিলিয়ন এর কম অথবা সম্পূর্ণ বীর্যে ৩৯ মিলিয়ন এর কম থাকলে তাকে অলিগোস্পার্মিয়া (Oligospermia) বলা হয়। তবে কারো ক্ষেত্রে যদি একদম শুক্রাণু অনুপস্থিত থাকে তবে তা এজোস্পার্মিয়া হিসেবে বিবেচিত হবে। (MayoClinic, 2022) সাধারণত ৩ মাসের ব্যবধানে দুই বার পরীক্ষা (সিমেন এনালাইসিস) করে নিশ্চিত ভাবে এজোস্পার্মিয়া নির্ণয় করা হয়ে থাকে। 

আপনার ক্ষেত্রে এজোস্পার্মিয়া হয়েছে কিনা তা কখন বুঝবেন বা কখন পরীক্ষা করাবেন? জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো পদ্ধতি অবলম্বন না করে টানা এক বছর যৌন সঙ্গমের মাধ্যমে গর্ভধারণ না হলে পুরুষের ক্ষেত্রে এজোস্পার্মিয়ার ধারণা করা যেতে পারে। এছাড়াও, কতিপয় লক্ষণ রয়েছে যা এই সমস্যাকে ইঙ্গিত করে। যেমনঃ

  • কম পরিমাণে বীর্য নিঃসরণ হওয়া
  • যৌন সঙ্গমের পর ঘোলাটে প্রস্রাব
  • প্রস্রাবের সময় ব্যথা বোধ হওয়া
  • অন্ডকোষ ফুলে যাওয়া ও ব্যথা
  • অন্ডকোষের আকার খুব ছোট
  • যৌন ইচ্ছা ও সক্ষমতা খুব কম
  • বড় স্তন (গাইনেকোমাস্টিয়া) 

গাইনেকোমাস্টিয়া কেন হয় এবং হলে করণীয় কি সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

এজোস্পার্মিয়া চিকিৎসা 

এজোস্পার্মিয়ার কারণের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্নতর হয়ে থাকে। হরমোন জনিত সমস্যা হলে সেক্ষেত্রে কিছু ঔষধ সেবন করা বা হরমোন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের মাধ্যমে সমাধান হতে পারে। আর যদি শুক্রবাহী নালীর সমস্যার কারণে এমনটি হয়ে থাকে তবে সেক্ষেত্রে সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্ট এর প্রয়োজন পড়ে। কারণ নির্ণয় পূর্বক চিকিৎসকের নির্দেশনা মোতাবেক যথাযথ ঔষধ সেবন অথবা সার্জারির মাধ্যমে বীর্যে শুক্রাণুর উপস্থিতি দেখা যেতে পারে। তবে এটি একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া যার জন্য ধৈর্য্য সহকারে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। আর মনে রাখবেন, সর্বাবস্থায় ঔষধ চালু অথবা বন্ধ করার ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের পরেও এজোস্পার্মিয়ার সমাধান না হলে সেক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে উন্নত প্রযুক্তির চিকিৎসা আইভিএফ (IVF- In vitro fertilization) নিয়ে ভাবা যেতে পারে।

এজোস্পার্মিয়া আক্রান্ত হলে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে না পড়ে বরং একজন চিকিৎসকের নির্দেশনা মোতাবেক প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করুন। তবে মনে রাখবেন, সন্তান না হওয়া সমস্যার জন্য চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার সঙ্গীকে সাথে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কারণ ঠিক কার কোন সমস্যার দরুণ বাচ্চা হচ্ছে না তা উভয়ের শরীরে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত ভাবে জেনে সেই মোতাবেক চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। 

References

Gurevich, R. (2021, November 1). Azoospermia: When Your Sperm Count Is Zero. Retrieved from verywellfamily:

https://www.verywellfamily.com/azoospermia-overview-4178823

MayoClinic. (2022, December 17). Low sperm count. Retrieved from mayoclinic:

https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/low-sperm-count/diagnosis-treatment/drc-20374591

Last Updated on October 31, 2023