ঘি (Clarified butter) একটি চর্বিজাতীয় খাবার যা রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। রান্না ছাড়াও এমনিতেই ঘি খাওয়া যায়। ঘি খুব মজাদার একটি খাবার। তবে ঘি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নাকি ক্ষতিকর সেই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় থাকেন।
এই অনুচ্ছেদে ঘি এর পুষ্টিগুণ, ঘি খাওয়ার উপকারিতা এবং ঘি খাওয়ার স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। কাদের জন্য ঘি খাওয়া উচিত নয় এবং ঘি এর বিকল্প ফ্যাট জাতীয় খাবার হিসেবে কি খাওয়া যেতে পারে সেই সম্পর্কে জানতে হলে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
পুষ্টিগুণ
ঘি এর প্রায় পুরোটাই ফ্যাট অর্থাৎ ১ গ্রাম ঘি এর মধ্যে প্রায় ১ গ্রাম ফ্যাট থাকে। এর পাশাপাশি খুব সামান্য মাত্রায় ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে ইত্যাদি রয়েছে। তবে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার ও মিনারেলস নেই। (Juber, 2022)
ঘি উচ্চ ক্যালরি সম্পন্ন একটি খাবার। ১ টেবিল চামচ (১৫ মিলিলিটার) ঘি ১৩০ ক্যালরি সরবরাহ করে।
ঘি খাওয়ার উপকারিতা
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ঘি ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে যা রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এই অনুচ্ছেদে শুধুমাত্র খাবার হিসেবে ঘি খাওয়ার উপকারিতা সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে।
খাবার সুস্বাদু করে তোলে
রান্নার কাজে ঘি ব্যবহারের করা হলে তা খাবারের স্বাদ ও ফ্লেভার বৃদ্ধি করে থাকে। তেলের পরিবর্তে ঘি ব্যবহারের করা যেতে পারে। তবে ঘি তেলের তুলনায় বেশ ব্যয়বহুল।
শিশুদের খাবার তৈরিতে (যেমনঃ তেলের পরিবর্তে ঘি দিয়ে রান্না করা) ঘি ব্যবহার করা হলে শিশু মজার সাথে খাবার খেতে চাইবে। এছাড়াও গরম ভাতের সাথে সামান্য ঘি মিশিয়ে খেতে অনেকেই পছন্দ করেন।
ছয় মাস বয়সের পর থেকেই বাচ্চাদের ঘি (তেলের পরিবর্তে) খেতে দেওয়া যাবে।
উচ্চ স্মোক পয়েন্ট
ঘি এর স্মোক পয়েন্ট ৪৮৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট যা তেলের তুলনায় বেশি। সয়াবিন তেলের স্মোক পয়েন্ট ৪৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
স্মোক পয়েন্ট বলতে কত তাপমাত্রায় রান্না করা হলে গুণাগুণ অক্ষুন্ন থাকবে এবং ক্ষতিকর ফ্যাটে (ট্র্যান্স ফ্যাট) রূপান্তরিত হবে না তা বোঝানো হয়। (Link, 2023)
ঘি এর স্মোক পয়েন্ট বেশি হওয়ার ফলে বেশি তাপে রান্না করা হলেও ঘি এর গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায় না এবং ক্ষতিকর ফ্যাটে রূপান্তরিত হয় না।
ভাজাপোড়ার ক্ষেত্রে তেলের পরিবর্তে ঘি ব্যবহার করা উত্তম হবে। যেমনঃ পরোটা ভাজার ক্ষেত্রে তেলের পরিবর্তে ঘি ব্যবহার করা যেতে পারে।
পরিপাকতন্ত্রের জন্য উপকারী
নিয়মিত ঘি খাওয়ার অভ্যাস পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্রম ভালো রাখতে সাহায্য করে। ঘি বিউটারিক অ্যাসিড (butyric acid) সমৃদ্ধ খাবার যা পরিপাকতন্ত্রের প্রদাহ নিরাময় করে এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
আইবিএস (ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম) আক্রান্ত রোগীদের জন্য ঘি খাওয়া উপকারী হতে পারে।
প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে
ঘি এর প্রদাহ নাশক গুণাবলী রয়েছে যা শরীরের বিভিন্ন স্থানের ব্যথা ও প্রদাহ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে আর্থ্রাইটিস জনিত ব্যথা নিরাময়ের ক্ষেত্রে ঘি খাওয়া উপকারী হতে পারে।
প্রদাহ জনিত একটি রোগ হলো আলজেইমার্স (বয়স্কদের ক্ষেত্রে হতে দেখা যায়) যার ফলে স্মৃতিশক্তি কমে যেতে থাকে। নিয়মিত ঘি খাওয়ার অভ্যাস আলজেইমার্স রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
ত্বক ও চুল ভালো রাখে
ঘি হলো এন্টি-অক্সিডেন্ট, ফ্যাটি অ্যাসিড ও ভিটামিন ই সমৃদ্ধ একটি খাবার যা ত্বক ও চুলের জন্য বেশ উপকারী। ঘি খাওয়ার অভ্যাস চুল ও ত্বকের রুক্ষতা দূর করে এবং ত্বককে করে তোলে কোমল ও মসৃণ।
হাড় মজবুত রাখে
ঘি হলো ভিটামিন কে ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ একটি খাবার। এই ভিটামিন দুইটি শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম হলো হাড়ের গঠন মজবুত রাখার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান।
হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে
হরমোন শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় এবং শরীরের বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঘি খাওয়ার অভ্যাস শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে স্বাভাবিক মাত্রায় হরমোন নিঃসরণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বিশেষ করে থাইরয়েড হরমোন যা মেটাবলিসম নিয়ন্ত্রণ করে এবং পুরুষের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন হরমোন যা যৌন স্বাস্থ্য ভালো রাখে। মহিলাদের ক্ষেত্রে হরমোনের মাত্রা ভালো রাখার মাধ্যমে পিরিয়ডের লক্ষণ বা যন্ত্রণা নিবারণে সাহায্য করে। (Toshi, 2023)
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঘি খাওয়ার অভ্যাস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
ঘি খাওয়ার সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি
ঘি উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত একটি খাবার যা শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে যাদের শরীরের ওজন কম বা বেশি ক্যালরি প্রয়োজন হয় তাদের জন্য ঘি খাওয়া যেতে পারে।
ঘি এর বেশির ভাগ অংশ হলো স্যাচুরেটেড ফ্যাট যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সাথে হার্টের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার যোগসূত্র রয়েছে।
তাই যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি এবং হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি রয়েছে তাদের জন্য ঘি খাওয়া উচিত নয়। একান্তই খেতে চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরিমিত মাত্রায় খেতে হবে।
কারো জন্যই অতিরিক্ত মাত্রায় ঘি খাওয়া উচিত হবে না। দৈনিক এক (১ চা চামচ – ৫ মিলিলিটার) থেকে তিন চা চামচের (এক টেবিল চামচ বা ১৫ মিলিলিটার) বেশি ঘি খাওয়া যাবে না।
এছাড়াও যাদের শরীরের ওজন বেশি বা হার্টের রোগের ঝুঁকি রয়েছে তাদের জন্য ঘি পরিহার করাই উত্তম।
ঘি এর স্বাস্থ্যকর বিকল্প
ঘি একটি ফ্যাট জাতীয় খাবার যার পরিবর্তে রান্নার কাজে সয়াবিন তেল বা সূর্যমুখী তেল খাওয়া যেতে পারে। সয়াবিন তেল ও সূর্যমুখী তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ বেশ কম থাকে যা স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও দাম বিবেচনায় ঘি এর তুলনায় সয়াবিন তেল ও সূর্যমুখী তেল বেশ সাশ্রয়ী। অলিভ অয়েল স্বাস্থ্যকর তবে কিছুটা (সয়াবিন তেল ও সূর্যমুখী তেলের তুলনায়) ব্যয়বহুল।
সালাদের সাথে অলিভ অয়েল খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও আমাদের দেশে খাটি সরিষার তেল পাওয়া যায় যার ফ্লেভার ও স্বাদ অনেক ভালো। বিশেষ করে ভর্তা বানাতে এবং সালাদের সাথে সরিষার তেল খাওয়া যেতে পারে। সরিষার তেল স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় যার দাম খুব একটা বেশি নয়।
শেষ কথা
ঘি একটি ফ্যাট জাতীয় খাবার যা রান্নায় ব্যবহার করলে খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি পায়। তবে ঘি প্রচুর স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ যা হার্টের রোগের ঝুঁকি এড়াতে চাইলে না খাওয়াই উত্তম অথবা পরিমিত মাত্রায় খেতে হবে।
Bibliography
Juber, M. (2022, September 13). Ghee: Is It Good for You? Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/diet/ghee-good-for-you
Link, R. (2023, October 10). Ghee: Is It Better Than Butter? Retrieved from Dr Axe: https://draxe.com/nutrition/ghee-benefits/
Toshi, D. N. (2023, October 03). 15 Amazing Health Benefits Of Ghee. Retrieved from PharmEasy: https://pharmeasy.in/blog/15-amazing-health-benefits-of-ghee/
Last Updated on January 7, 2024
Leave A Comment