আইবিএস কী? আইবিএস (IBS– irritable bowel syndrome) হলো পরিপাকতন্ত্রের একটি রোগ যা একবার হলে সারাজীবন ব্যাপী ভোগ করতে হয়। তবে নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
এই অনুচ্ছেদে আইবিএস রোগের কারণ, কাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে, আইবিএস কত ধরনের হয়ে থাকে, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, কিভাবে রোগ নির্ণয় করা হয়, আইবিএসের ঘরোয়া প্রতিকার এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
আইবিএস বা পুরাতন আমাশয় এর লক্ষণ বা উপসর্গ
আইবিএস রোগটির ক্ষেত্রে সবসময় লক্ষণ দেখা যাবে বা সমস্যা অনুভব হবে তা নয়। বরং কিছুদিন সুস্থ থাকে আবার মাঝে মধ্যে পরিপাকতন্ত্রে সমস্যা দেখা যায়। বিশেষত জীবন যাপনে কোনো অনিয়মিত করলে অথবা বিশেষ কোনো খাবার খাওয়ার ফলে লক্ষণ দেখা যায়। একবার এই রোগে কেউ আক্রান্ত হলে তাকে সারাজীবন সমস্যা বয়ে বেড়াতে হয়। রোগের ধরন ও রোগী ভেদে লক্ষণের তারতম্য হয়ে থাকে। তবে প্রায় সব রোগীর ক্ষেত্রে যেসব কমন লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ (Cleveland Clinic, 2020 )
- পেটে মোচড়ানো ব্যথা
- পেটে অতিরিক্ত গ্যাস হওয়া
- মলের সাথে মিউকাস নিঃসরণ হয়
- অনিয়মিত মলত্যাগের অভ্যাস
- কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা ডায়রিয়া
মহিলাদের ক্ষেত্রে আইবিএসের লক্ষণগুলো পিরিয়ডের সময় বেড়ে যায় যার ফলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া সহ হতাশা, উদ্বিগ্নতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা যেতে পারে।
আইবিএস রোগের ধরন
আইবিএস রোগটি আমাদের দেশে অনেক মানুষ পুরাতন আমাশয় নামে চিনে থাকেন। আইবিএস রোগীদের ক্ষেত্রে মলের সাথে মিউকাস নিঃসরণ হয় এবং মলত্যাগের প্রকৃতি কখনো ডায়রিয়ার মতো হয় আবার কখনো কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা যায়। লক্ষণের উপর ভিত্তি করে আইবিএস ৩ ধরনের হয়ে থাকে।
IBS-C
C দ্বারা Constipation বা কোষ্ঠকাঠিন্য বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ IBS-C এর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় মল শক্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে এবং সহজে মলত্যাগ হতে চায় না।
IBS-D
D দ্বারা Diarrhea বা ডায়রিয়া বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এই ধরনের আইবিএসের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় মলত্যাগের প্রকৃতি ডায়রিয়ার মতো হয়ে থাকে।
IBS-M
M দ্বারা Mixed বা মিশ্র বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মলত্যাগের প্রকৃতি কখনো ডায়রিয়া আবার পরক্ষণেই (একই দিনে দুই রকমের মলত্যাগ) কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো হয়ে থাকে।
মহিলাদের ক্ষেত্রে IBS-C এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে IBS-D হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
আইবিএসের কারণ
আইবিএস রোগের প্রকৃত কারণ অজানা। তবে ধারণা করা হয় যে, অন্ত্রের (Gut) ভেতর দিয়ে খাবার স্বাভাবিকের তুলনায় ধীর বা দ্রুত গতিতে প্রবাহিত হওয়া, অন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত নার্ভ গুলোর (Nerves) অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপের প্রভাবে আইবিএস হয়ে থাকে।
মানুষের অন্ত্রে একধরনের অণুজীব বসবাস করে যারা শরীরের জন্য উপকারী। অর্থাৎ খাবার হজম প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদেরকে Gut Microbiome বলা হয়। কোনো কারণে অন্ত্রে বসবাসকারী অণুজীবের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নষ্ট হলে তা আইবিএস হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এছাড়াও খাদ্যাভ্যাসের সাথে আইবিএস হওয়া বা লক্ষণ বেড়ে যাওয়ার যোগসূত্র রয়েছে।
কাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে?
যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রে আইবিএস হতে পারে। তবে যাদের ক্ষেত্রে আইবিএস রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে তা হলোঃ (Mayo Clinic, 2022)
- ৫০ বছরের কম বয়সী মানুষ
- পুরুষের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ ঝুঁকি রয়েছে
- শারীরিক অথবা যৌন নির্যাতনের ইতিহাস
- যাদের রাতে ঘুমের সমস্যা (Sleep disorders) হয়
- যারা অতিরিক্ত এন্টি বায়োটিক (Antibiotic) ওষুধ সেবন করেন
- মা বাবা অথবা ভাই বোনদের মধ্যে কারো আইবিএস থাকলে সন্তান ও সহোদরের ক্ষেত্রে আইবিএস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে
- যারা অতিরিক্ত মানসিক চাপ, উদ্বিগ্নতা ও বিষন্নতায় ভোগেন।
আইবিএস কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
আইবিএস নির্ণয়ের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। তাহলে এই রোগ কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
প্রথমত রোগীর মুখ থেকে রোগের লক্ষণ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে চিকিৎসক বোঝার চেষ্টা করেন যে, এটি আইবিএসের লক্ষণের সাথে মিলে যায় কিনা। অতঃপর অন্যান্য যেসব রোগের (ক্রন’স ডিজিজ, ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স, কোলন ক্যান্সার, সিলিয়াক ডিজিজ ইত্যাদি) ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের লক্ষণ দেখা যায় সেগুলোর জন্য নির্ধারিত পরীক্ষা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরীক্ষায় যদি অন্য কোনো রোগ ধরা না পড়ে তবে আইবিএস হয়েছে বলে মনে করা হয়। পরীক্ষা গুলো হলোঃ
- মল পরীক্ষা
- রক্ত পরীক্ষা
- Lactose intolerance tests
- পেটের সিটিস্ক্যান (CT scan)
- কোলোনস্কোপি (Colonoscopy)
আইবিএসের জন্য গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট (Gastroenterologist) ডাক্তার অর্থাৎ যারা পরিপাকতন্ত্রের রোগের চিকিৎসা করেন তাদের শরণাপন্ন হতে হবে।
আইবিএস বা পুরাতন আমাশয় এর ঘরোয়া চিকিৎসা
আইবিএস নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপন করার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করতে হবে।
করণীয়
- নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম করা যেতে পারে।
- একবারে বেশি খাবার না খেয়ে বরং দিনের মধ্যে কয়েকবার অল্প পরিমাণে খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন।
- প্রতিদিন ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হবে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা গেলে ইসবগুলের ভুসি পানিতে গুলিয়ে খেতে পারেন।
- ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইন বা ডাবের পানি পান করতে হবে।
- রাতে ভালো ঘুম (৭ থেকে ৯ ঘন্টা) হওয়া জরুরী। ভালো ঘুমের জন্য রাতের খাবার ঘুমাতে যাওয়ার ৩ ঘন্টা আগে খেতে পারলে ভালো।
নিষেধাজ্ঞা
- প্রতিদিন একই সময়ে খাবার খেতে হবে। কোনো বেলার খাবার দেরি করে খাওয়া বা বাদ দেওয়া যাবে না।
- খাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করা যাবে না। বরং খাবার ধীরে ধীরে চিবিয়ে খেতে হবে।
- দিনে সর্বোচ্চ ৩ কাপের বেশি চা ও কফি পান করা যাবে না।
- ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করা জরুরী।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ এড়িয়ে চলতে হবে।
- মলত্যাগের বেগ হলে কখনোই তা চেপে রাখা যাবে না।
- কোমল পানীয় পান করা যাবে না।
- বাসি খাবার খাওয়া যাবে না।
খাবার
আইবিএস রোগীদের জন্য ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে হবে। যেমনঃ ফলমূল, সবজি, বাদাম, ওটস, বাদামী চালের ভাত ইত্যাদি। প্রোটিনের উৎস হিসেবে ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদি খাওয়া যাবে। উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত তেল রান্নায় ব্যবহার করা যাবে। তবে বিভিন্ন ধরনের শাক কম খেতে হবে। কারণ অনেকের ক্ষেত্রে শাক খেলে সমস্যা হয়।
গ্লুটেন (Gluten) সমৃদ্ধ খাবার খেলে আইবিএস রোগীদের সমস্যা বেড়ে যায়। গম থেকে প্রাপ্ত খাবারে গ্লুটেন থাকে। আর তাই এই ধরনের খাবার (রুটি, বিস্কুট ও চানাচুর) যতটা সম্ভব কম খেতে হবে।
এছাড়াও দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, চিনি, ফাস্টফুড, চকলেট, বাঁধাকপি, কাঁচা পেঁয়াজ, শিমের বিচি ইত্যাদি খাওয়া যাবে না।
আইবিএস রোগীদের মধ্যে একেকজনের ক্ষেত্রে একেক ধরনের খাবার খেলে সমস্যা হয়। আপনার ক্ষেত্রে কোন ধরনের খাবার খাওয়া উপকারী হবে এবং কোন খাবার গুলো বর্জন করে চলা উচিত সেই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পেতে একজন পুষ্টিবিদের (Dietician) পরামর্শ গ্রহণ করুন।
চিকিৎসা
আইবিএস রোগটি একদম সারিয়ে ফেলতে পারে এমন কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। তবে আইবিএস নিয়ন্ত্রণে যেসব চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে হলোঃ (Brazier, 2023)
- পেটে মোচড়ানো ব্যথা দূর করার জন্য Antispasmodic ওষুধ সেবনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
- কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ দেখা গেলে মল নরম করার ওষুধ (Laxative) সেবনের প্রয়োজন পড়ে।
- ডায়রিয়া প্রতিকারে Antimotility ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
- মানসিক সমস্যা জনিত কারণে আইবিএস হলে Antidepressant ওষুধ সেবনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
- এছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাউন্সেলিং বা কগনেটিভ বিহেবিয়ার থেরাপি গ্রহণ করা লাগতে পারে।
প্রশ্ন ও উত্তর
১. আইবিএস প্রতিরোধ করা যায় কি?
আইবিএস প্রতিরোধ করার কোনো উপায় নেই। অর্থাৎ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অথবা বিশেষ কোনো নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায় না। এছাড়াও আইবিএস প্রতিরোধের জন্য কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি।
২. আইবিএস কি ছোঁয়াচে রোগ?
আইবিএস ছোঁয়াচে প্রকৃতির রোগ নয়। অর্থাৎ একজন অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকা, একসাথে খাবার খাওয়া, জিনিসপত্র ব্যবহার করা, একই বিছানায় ঘুমানো, যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা ইত্যাদির মাধ্যমে এই রোগ সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে না।
৩. আইবিএসের ফলে কোলন ক্যান্সার হতে পারে কি?
আইবিএস রোগটি সাধারণত অন্য কোনো জটিল রোগ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। কোলন ক্যান্সারের শুরুর দিকের লক্ষণ অনেকটাই আইবিএসের মতো মনে হলেও এই দুইটি রোগের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই। অর্থাৎ একটি রোগ অন্যটি সৃষ্টির কারণ নয় এবং ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় না।
৩. আইবিএস কি প্রাণঘাতী রোগ?
আইবিএসের ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় এবং কিছু মানসিক সমস্যা হতে পারে। যেমনঃ উদ্বিগ্নতা, বিষন্নতা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া ও ঘুমের সমস্যা। তবে আইবিএস কখনো প্রাণঘাতী হয়ে উঠে না।
Bibliography
Brazier, Y. (2023, February 09). All you need to know about irritable bowel syndrome (IBS). Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/37063
Cleveland Clinic. (2020 , September 24). Irritable Bowel Syndrome (IBS). Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/4342-irritable-bowel-syndrome-ibs
Mayo Clinic. (2022, November 02). Irritable bowel syndrome. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/irritable-bowel-syndrome/symptoms-causes/syc-20360016
Last Updated on June 1, 2023
Leave A Comment