ব্রণ (Acne) একটি কমন স্বাস্থ্য সমস্যা যার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম একটি হলো শরীরে হরমোনের প্রভাব। নারী ও পুরুষ উভয়ের শরীরে অনেকগুলো গ্রন্থি রয়েছে যেগুলো থেকে হরমোন নিঃসৃত হয় এবং শরীরের নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। স্বাভাবিকের চেয়ে কম অথবা বেশি পরিমাণে হরমোন নিঃসরণ হলে শরীরে নানাবিধ সমস্যা দেখা যায় যার মধ্যকার একটি হলো ব্রণ হওয়া।
ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ক্ষেত্রে হরমোনঘটিত ব্রণ (Hormonal Acne) হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রতিবার পিরিয়ড ছাড়াও গর্ভকালীন সময় ও মেনোপজের সময় হরমোনের পরিবর্তন ঘটে থাকে। আর তাই মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা ছেলেদের তুলনায় বেশি। |
এই অনুচ্ছেদে হরমোনঘটিত ব্রণের বৈশিষ্ট্য, মেয়েদের ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্রণ হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে কেন, ব্রণের প্রাকৃতিক প্রতিকার এবং ব্রণ নিরাময়ে কেমন ধরনের খাদ্যাভাস মেনে চলতে হবে সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
ব্রণ হওয়ার কারণ
ত্বকের হেয়ার ফলিকল গুলোতে অতিক্ষুদ্র আকৃতির সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড থাকে যা থেকে সেবাম নিঃসৃত হয়। সেবাম হলো বিশেষ একধরনের তৈলাক্ত উপাদান যা ত্বকের শুষ্কতা প্রতিরোধ করে। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে সেবাম নিঃসৃত হলে অথবা মৃত কোষ জমে হেয়ার ফলিকল বন্ধ হয়ে গেলে সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ডের প্রদাহ হয় এবং ফুলে উঠে যাকে ব্রণ বলা হয়।
ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের সংক্রমণ, খাদ্যাভাস, অনিয়মিত জীবন যাপন পদ্ধতি, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতার ফলে ব্রণ হয়ে থাকে।
হরমোনজনিত ব্রণের বৈশিষ্ট্য কী?
শরীরে হরমোনের তারতম্যের ফলে ব্রণ হলে তাকে হরমোনজনিত ব্রণ বলা হয়। এই ধরনের ব্রণের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে এবং টিনেজারদের (১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী) ক্ষেত্রে অনেক বেশি দেখা যায়। কারণ এই সময়ে শরীরে হরমোনের পরিবর্তন বেশি ঘটে।
ছেলেদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন হরমোনের উঠানামা এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড ও PCOS (polycystic ovary syndrome) এর ফলে শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে থাকে। আর হরমোনের পরিবর্তন হলে অতিরিক্ত পরিমাণে সেবাম নিঃসরণ হয় যা ব্রণ সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ।
বয়ঃসন্ধিকালের হরমোনজনিত ব্রণ কপাল, নাক, থুতনি ইত্যাদি স্থানে বেশি হয়ে থাকে। আর টিনেজারদের ক্ষেত্রে গাল ও থুতনিতে বেশি ব্রণ দেখা যায়। তবে মুখমণ্ডল ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থান যেমন- ঘাড়, গলা, বুক ও পিঠে ব্রণ হতে পারে।
ব্রণ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমনঃ (cleveland clinic, 2021)
- হোয়াইট হেডস (whiteheads)
- ব্ল্যাক হেডস (blackheads)
- Papules
- Pustules
- Cysts
হোয়াইট হেডস ও ব্ল্যাক হেডস এর ক্ষেত্রে ফুলে যায় না এবং ব্যথা থাকে না। আর Papules এর ক্ষেত্রে সামান্য ফোলাভাব থাকে, ব্যথা হয় এবং লাল হয়ে যায়। তবে পুঁজ জমা হয় না। কিন্তু Pustules ও Cysts এর বেলায় প্রদাহ হয় এবং সেই সাথে পুঁজ বা একধরনের তরল পদার্থ জমা হয়। |
হরমোনজনিত ব্রণের প্রাকৃতিক প্রতিকার
হরমোনজনিত ব্রণের সমস্যা খুব বেশি না হলে এর জন্য তেমন কোনো চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন নেই। তবে খুব বেশি ব্রণ হলে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্রিম ব্যবহার, জন্ম নিয়ন্ত্রণের পিল সেবন করা সহ লেজার থেরাপির মতো উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে যার জন্য একজন ডার্মাটোলজিস্ট এর শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা ছাড়াও কতিপয় প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলা ব্রণ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। যেমনঃ
টি ট্রি অয়েল (Tea tree oil) ব্যবহার
টি ট্রি অয়েল ত্বকে ব্যবহার করা হলে প্রদাহ কমানোর মাধ্যমে ব্রণ নিরাময়ে সাহায্য করে থাকে। টি ট্রি অয়েল বাজারে কিনতে পাওয়া যায় যা নারিকেল তেল অথবা অলিভ অয়েলের সাথে মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহার করতে হবে।
এক্ষেত্রে নারিকেল তেল অথবা অলিভ অয়েলের সাথে টি ট্রি অয়েলের অনুপাত হবে ৬:১ বা তারও কম।
তবে কারো কারো ক্ষেত্রে ত্বকে টি ট্রি অয়েল ব্যবহার করার ফলে এলার্জিক রিয়েকশন হতে পারে। আর তাই এই ধরনের সমস্যা এড়ানোর জন্য প্রথমেই মুখে না লাগিয়ে হাতের ত্বকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে র্যাশ (Rash) বা চুলকানি হয় কিনা। যদি না হয় তবে তাদের ক্ষেত্রে টি ট্রি অয়েল ব্যবহার করা নিরাপদ হবে।
গ্রিন টি (Green tea) ব্যবহার
গ্রিন টিতে প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ২ থেকে ৩ কাপ গ্রিন টি পান করা হলে ব্রণ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও ত্বকে বাহ্যিকভাবে গ্রিন টি ব্যবহার করা উপকারী হতে পারে।
চিনি ছাড়া গ্রিন টি তৈরি করার পর ঠান্ডা করে নিতে হবে এবং তারপর মুখে লাগানো যাবে।
এলোভেরা (Aloe Vera)
ত্বকের যত্নে বিশেষ করে ত্বকের আদ্রর্তা বজায় রাখতে এবং ব্রণের সমস্যা দূর করতে বাহ্যিকভাবে এলোভেরার ব্যবহার বেশ উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে।
এলোভেরা সংগ্রহ করে এর ভেতরে থাকা থকথকে অর্ধ তরল পদার্থ বের করে ত্বকে লাগিয়ে রাখতে হবে। এলোভেরার সাথে মধু মিশিয়ে ব্যবহার করা আরো ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারে। এছাড়াও বাজারে এলোভেরা সমৃদ্ধ ফেসওয়াশ কিনতে পাওয়া যায় যা ত্বকের যত্নে এবং ব্রণ দূর করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হরমোনজনিত ব্রণ ভালো হয়ে যায়। তবে ব্রণ খুব বেশি হলে এবং ত্বকে দাগ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেলে সেক্ষেত্রে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। |
হরমোনজনিত ব্রণ এবং ডায়েট সম্পর্কিত করণীয়
খাবারের সাথে ব্রণ হওয়ার সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তবে পরোক্ষভাবে অর্থাৎ প্রদাহ ও শরীরে হরমোনের ভারসাম্য রক্ষার সাথে খাবারের যোগসূত্র রয়েছে। উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার গুলো যেমন- ফল, শাকসবজি, বাদাম ইত্যাদি প্রদাহ কমানো এবং শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড ত্বকের প্রদাহ কমায়। আর ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিডের একটি প্রধান উৎস হলো মাছ যা বেশি বেশি খেতে হবে।
পক্ষান্তরে ফাস্টফুড, চিনি, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, লাল মাংস ইত্যাদি খাওয়ার ফলে শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও প্রদাহ সৃষ্টি করে থাকে। আর তাই এই জাতীয় খাবার গুলো যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে। সেই সাথে কোমল পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে শরীরে পানি স্বল্পতা যেন না হয় সেজন্য প্রতিদিন ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হবে।
হরমোনঘটিত ব্রণ দূর করতে আর কী করা যেতে পারে?
হরমোনঘটিত ব্রণ দূর করতে আরো যেসব নিয়ম মেনে চলতে হবে তা নিচে উল্লেখ করা হলোঃ (MacGill, 2018)
- এমন কোনো স্ক্রিন কেয়ার প্রডাক্ট ব্যবহার করা যাবে না যেগুলো ত্বকের জন্য ক্ষতিকর এবং হেয়ার ফলিকল বন্ধ করে দিতে পারে।
- অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও গরম এড়িয়ে চলতে হবে। রোদে যাওয়ার আগে সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে এবং ঘেমে যাওয়ার পর হাত মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে।
- অতিরিক্ত হাত মুখ ধোয়া যাবে না। কারণ এতে করে ত্বকের প্রাকৃতিক তেলতেলে ভাব নষ্ট হয়ে যায় এবং ত্বক রুক্ষ হয়ে যেতে পারে।
- মুখে সাবান ব্যবহার করা যাবে না। ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান মুক্ত ফেসওয়াশ ব্যবহার করতে হবে।
- হাত মুখ ধোয়ার জন্য ঠান্ডা পানি অথবা কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত গরম পানি ব্যবহার করা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
- অপরিষ্কার হাত ব্রণে লাগানো যাবে না। ব্রণে যতটা সম্ভব হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
এছাড়াও ব্রণের সমস্যা নিরাময় এবং শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা হ্রাস করার জন্য নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করতে হবে। যেমনঃ
- রাত জাগার অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করতে হবে এবং প্রতিদিন রাতে ৮ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুমাতে হবে।
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
- ধুমপান ও মদ্যপান করা শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর তাই ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করা জরুরী।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ পরিহার করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য যোগব্যায়াম উপকারী ভূমিকা পালন করে।
- উল্লেখ্য, যৌন সম্পর্ক স্থাপন এবং মাস্টারবেশন করার সাথে ব্রণ হওয়ার কোনো যোগসূত্র নেই।
শরীরে হরমোনের পরিবর্তন এবং এর প্রভাবে ব্রণ হওয়া খুব কমন ঘটনা। তবে এর জন্য বিচলিত না হয়ে বরং স্বাভাবিক জীবন যাপনের চেষ্টা করতে হবে এবং সেই সাথে প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে।
References
cleveland clinic. (2021, 09 10). Hormonal Acne. Retrieved from cleveland clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/21792-hormonal-acne
MacGill, M. (2018, July 23). Hormonal acne: What you need to know. Retrieved from medical news today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/313084
Last Updated on December 18, 2023
Leave A Comment