শিশুদের ত্বকের সবচেয়ে কমন ক্যান্সার হলো মেলানোমা (Melanoma) যা কালো গায়ের রংয়ের বাচ্চাদের তুলনায় ফর্সাদের ক্ষেত্রে হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি থাকে। আপনার শিশু মেলানোমায় আক্রান্ত হয়েছে কিনা তা প্রাথমিক পর্যায়ে কিভাবে বুঝবেন সেই বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরী।
মেলানোমা প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে আরোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তবে রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়ে গেলে সারা শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়তে পারে যা রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই অনুচ্ছেদে শিশুদের ত্বকে মেলানোমার লক্ষণ, ফর্সা গায়ের রংয়ের শিশুদের ক্ষেত্রে মেলানোমা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি কেন, মেলানোমা নির্ণয় পদ্ধতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সহ মেলানোমা প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
মেলানোমা কি?
প্রত্যেক মানুষের ত্বকের নিচে (এপিডার্মিসে) মেলানোসাইট (Melanocytes) নামক একধরনের কোষ থাকে যা থেকে মেলানিন উৎপন্ন হয়। আর মেলানিন হলো সেই উপাদান যা ত্বকের বর্ণ নির্ধারণ করে এবং সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি (Ultraviolet ray) থেকে ত্বকের ক্ষতি হওয়া প্রতিরোধ করে।
কোনো কারণ বশত মেলানোসাইটের অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় মেলানোমা (Melanoma) বলা হয় যা এক প্রকার ক্যান্সার।
মেলানোমার প্রকৃত কারণ এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাবে মেলানোমা হয়ে থাকে।
কোন বিষয়গুলো শিশুদের ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়?
যার ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ যত বেশি তার গায়ের রং তত কালো হয়ে থাকে। আর মেলানিন সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতি থেকে ত্বক রক্ষা করে বলে যাদের গায়ের রং কালো তাদের ক্ষেত্রে ত্বকের ক্যান্সার তথা মেলানোমা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে।
পক্ষান্তরে ফর্সা মানুষের ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ খুব কম থাকে। যার ফলে সহজেই সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি দ্বারা ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং মেলানোমা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
মা বাবা অথবা ভাই বোনদের মধ্যে কারো মেলানোমা হওয়ার ইতিহাস থাকলে তাদের ক্ষেত্রে এই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এছাড়াও আরো যেসব বিষয় শিশুদের ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় তা হলোঃ (Fletcher, 2022)
- দীর্ঘসময় পর্যন্ত রোদে থাকা
- অতিরিক্ত তিল (Moles) থাকা
- দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
- Xeroderma pigmentosum
- Hereditary retinoblastoma
শিশুদের ত্বকের ক্যান্সারের লক্ষণ
মেলানোমার লক্ষণ হলো ত্বকে অস্বাভাবিক রকমের তিল (Moles) হওয়া অথবা শরীরে থাকা তিলের পরিবর্তন দেখা যায়। শিশুর শরীরের যেকোনো জায়গায় মেলানোমার লক্ষণ হিসেবে তিল দেখা যেতে পারে। তবে পিঠ, পা, মুখ ও বাহুর ত্বকে সূর্যের তাপ লাগে আর তাই এই অংশগুলোতে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
আবার সূর্যের তাপ লাগার সম্ভাবনা কম এমন স্থানেও মেলানোমা হতে পারে যাকে Hidden melanomas বলা হয়। যেমনঃ নখের নিচের অংশ, হাত ও পায়ের তালু, চোখ, মুখ, খাদ্যনালী, পায়ুপথ ইত্যাদি।
তিল মানেই মেলানোমা নয় বরং শরীরে স্বাভাবিকভাবেই তিল থাকতে পারে। স্বাভাবিক তিলের বৈশিষ্ট্য হলো কালো, বাদামী অথবা ত্বকের বর্ণের হয়ে থাকে। এছাড়াও তিল মসৃণ ও গোলাকৃতির এবং ছোট (৬ মিলিমিটারের কম) হয়ে থাকে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে?
শিশুর শরীরে তিল দেখা মাত্রই মেলানোমা হয়েছে ভেবে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। তবে তিলের যেসব ধরন বা পরিবর্তন দেখা গেলে মেলানোমা ধারণা করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে সেই ব্যাপারে একটি সুন্দর নির্দেশনা রয়েছে।
এটিকে ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম ৫ টি বর্ণ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। (Walter, 2019)
A- asymmetry: অপ্রতিসাম্য তিল অর্থাৎ তিলকে যদি দুইভাগে ভাগ করা হয় তবে দুই পাশে একই রকম দেখা যাবে না।
B- border: তিল দেখতে এবরোথেবরো লাগে অর্থাৎ তিলের চারপাশ সমান ও মসৃণ থাকে না।
C- color: তিল স্বাভাবিক বর্ণের হয় না বরং সাদা, লাল, বেগুনি ও নীল হয়ে থাকে।
D- diameter: ৬ মিলিমিটারের চেয়ে বড় হয়ে থাকে।
E- evolving: সময়ের সাথে সাথে তিলের আকার বা বর্ণ পরিবর্তন হয়।
আপনার শিশুর শরীরে থাকা তিল যদি উপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলোর মতো হয়ে থাকে তবে যত দ্রুত সম্ভব একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
শিশুদের ত্বকের ক্যান্সার নির্ণয়
সর্বপ্রথম চিকিৎসক শিশুর তিলের ধরন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। অতঃপর মেলানোমা সন্দেহ হলে বায়োপসি টেস্ট (Biopsy) করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। একদম নিশ্চিত ভাবে মেলানোমা নির্ণয় ও ক্যান্সারের স্টেজ (stage) সম্পর্কে জানতে আরো যেসব পরীক্ষা করা লাগতে পারে তা হলোঃ (Fletcher, 2022)
- PET Scan
- Lymph node dissection
- X-ray, MRI, CT scan ইত্যাদি
শিশুদের ত্বকের ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি
শিশুদের ত্বকের ক্যান্সার তথা মেলানোমার চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে ক্যান্সারের স্টেজের উপর। ক্যান্সারের তীব্রতা এবং শরীরের অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা অনুযায়ী ০ থেকে ৪ পর্যন্ত স্টেজ রয়েছে। এই স্টেজের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্নতর হয়ে থাকে। যেমনঃ (Roland, 2018)
স্টেজ ০ ও ১ (Stage 0 or 1)
স্টেজ ০ ও ১ মেলানোমা চিকিৎসার মাধ্যমে একদম ভালো হয়ে যায়। এই পর্যায়ে তিল অপসারণ এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশেষ ধরনের ক্রিম (Imiquimod Topical Cream) ব্যবহার করার মাধ্যমে সুস্থ হওয়া যায়।
স্টেজ ২ (Stage 2)
স্টেজ ২ এর ক্ষেত্রে তিল অপসারণের পর বায়োপসি করে দেখতে হবে যে ক্যান্সার লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়েছে কিনা। যদি ছড়িয়ে পড়ে থাকে সেক্ষেত্রে রেডিয়েশন (Radiation) থেরাপির প্রয়োজন পড়ে।
স্টেজ ৩ (Stage 3)
স্টেজ ৩ মেলানোমার জন্য তিল অপসারণ করার পাশাপাশি আক্রান্ত লিম্ফ নোড ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সেই সাথে রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়।
স্টেজ ৪ (Stage 4)
স্টেজ ৪ হলো ক্যান্সারের এডভান্সড স্টেজ যার জন্য জটিল ধরনের চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। সার্জারি, কেমোথেরাপি (Chemotherapy) এবং ইমিউনোথেরাপি (Immunotherapy) হলো এই পর্যায়ের চিকিৎসা।
ছোটদের মতো বড়দের ক্ষেত্রেও মেলানোমা হতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে মেলানোমা ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বড়দের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। ক্যান্সার লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়লে সেক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ শিশু রোগ নির্ণয়ের পরবর্তী ৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে মেলানোমা ভালো হয়ে গেলেও রোগীকে একজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধায়নে রাখতে হবে যেন নিয়মিত চেক আপ (Medical Checkups) করানো সম্ভব হয়। মেলানোমায় আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়া সহ পুনরায় মেলানোমা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
শিশুদের ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়
ক্যান্সারের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং চিকিৎসা কালীন রোগীকে অনেক কষ্টকর সময় পার করতে হয়। খাবার গ্রহণে সমস্যা সহ চুল পড়ে যায় যা শারীরিক ও মানসিক ভাবে রোগীকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। আর তাই ক্যান্সার যদি প্রতিরোধ করা যায় সেটা হবে সবচেয়ে ভালো কাজ।
শিশুদের ত্বকের ক্যান্সার (মেলানোমা) প্রতিরোধের শতভাগ কার্যকরী কোনো পদ্ধতি নেই। তবে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি মেলানোমা হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আর তাই যতটা সম্ভব রোদ থেকে দূরে থাকতে হবে যা মেলানোমা হওয়ার ঝুঁকি কমাবে।
একদম সূর্যের তাপ গায়ে লাগানো যাবে না তা নয়। বরং মাঝে মধ্যে শিশুদের শরীরে রোদ লাগানোর দরকার হবে। বিশেষ করে সূর্যের তাপ গায়ে লাগানোর মাধ্যমে ত্বকে ভিটামিন ডি (Vitamin D) উৎপন্ন হয় যা শরীরের বিভিন্ন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সকাল এবং বিকালে অল্প কিছুক্ষণ সময় রোদ পোহাতে হবে। তবে কড়া রোদ গায়ে মাখানো যাবে না। কারণ কড়া রোদে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বেশি থাকে। বিশেষ করে সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত রোদ পোহানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
একান্তই রোদে যাওয়ার প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে পোশাক পড়ে শরীর ঢেকে নিতে হবে। যেমনঃ টুপি, ফুলহাতা শার্ট অথবা গেঞ্জি, পা ঢেকে রাখে এমন প্যান্ট ইত্যাদি। সানগ্লাস ব্যবহার করা সম্ভব হলে ভালো।
শরীরের যে অংশ পোশাকের বাইরে বেরিয়ে থাকে সেই অংশে সানস্ক্রিন (Sunscreen) ব্যবহার করতে হবে। শিশুদের জন্য SPF 15 (sun protection factor) লেখা দেখে সানস্ক্রিন কিনে ব্যবহার করতে হবে। আর ৬ মাসের চেয়ে বেশি বয়স্ক শিশুদের জন্য SPF 30 ব্যবহার করতে হবে।
এছাড়াও শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ছোট শিশুদের জন্য মায়ের বুকের দুধ আর বড়দের জন্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যত বেশি তার ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তত কম থাকে। সুস্থ সবল ও শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন শিশু জন্ম দেওয়ার জন্য গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
References
Fletcher, J. (2022, June 29). What to know about childhood melanoma. Retrieved from Medical new stoday: https://www.medicalnewstoday.com/articles/childhood-melanoma
Roland, J. (2018, August 30). Skin Cancer in Children (Pediatric Melanoma). Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/skin-cancer-in-children#treatment
Walter, A. W. (2019, January). Melanoma. Retrieved from kids health: https://kidshealth.org/en/parents/melanoma.html
Last Updated on April 12, 2023
Leave A Comment