হাত, পা এবং মুখের রোগ (HFMD) কি? 

হাত, পা এবং মুখের রোগকে মেডিকেলের ভাষায় (HFMD– Hand, foot, and mouth disease) বলা হয় যা জটিল কোনো রোগ না হলেও প্রচন্ড ছোঁয়াচে প্রকৃতির রোগ। সাধারণত Coxsackievirus নামক ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে এই রোগের সৃষ্টি হয়। এটি ছোট বাচ্চাদের রোগ যা ৫ বছরের নিচের বাচ্চাদের হয়ে থাকে তবে কদাচিৎ বড়দের হতে পারে। এই অনুচ্ছেদে হাত, পা এবং মুখের রোগের কারণ, লক্ষণ, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা, ঘরোয়া প্রতিকার এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

হাত, পা এবং মুখের রোগের লক্ষণগুলি কী কী? 

শরীরে HFMD রোগের ভাইরাস আক্রমণ করার সাথে সাথেই লক্ষণ প্রকাশ পায় না বরং লক্ষণ প্রকাশ পেতে ৩ থেকে ৬ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায় যাকে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা সুপ্তিকাল বলা হয়। সর্বপ্রথম লক্ষণ হিসেবে জ্বর ও গলা ব্যথা দেখা যায় এবং পরবর্তী ১ থেকে ২ দিনের মধ্যে শরীরে র‍্যাশ (Rash) ও ছোট ছোট ফোস্কা (Blisters) উঠতে থাকে। র‍্যাশ ও ফোস্কা দেখতে লাল বর্ণের হয় যা শুরুতে হাত ও পায়ের তালুতে দেখা যায় এবং পরবর্তীতে মুখ গহ্বর ও গলার ভেতরে হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় আরো যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ (Selner, 2022)

  • খাওয়ার প্রতি অনীহা 
  • খিটখিটে মেজাজ 
  • মাথাব্যথা 
  • অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ 

হাত, পা এবং মুখের রোগের কারণ কী? 

হাত, পা এবং মুখের রোগের জন্য দায়ী হলো Coxsackievirus A16 ভাইরাস যা একজন রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে সহজেই আরেকজনের দেহে সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির লালা, হাঁচি ও কাশি থেকে নির্গত ড্রপলেট, মলমূত্র, সরাসরি হাতের স্পর্শ, ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং ফোস্কা গলে গিয়ে যে তরল নিঃসৃত হয় তার মাধ্যমে এই ভাইরাস সুস্থ ব্যক্তির দেহে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়। 

তবে পোষাপ্রাণী অথবা গবাদিপশুর পা ও মুখের রোগ (যাকে hoof and mouth disease বলা হয়) থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমণ হয় না। তেমনিভাবে মানুষ থেকেও প্রাণীর দেহে এই রোগ ছড়াতে পারে না।  

হাত, পা এবং মুখের রোগের ঝুঁকিতে কারা? 

হাত, পা এবং মুখের রোগের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ছোট বাচ্চারা। বিশেষ করে স্কুল বা মাদ্রাসা পড়ুয়া ছোট ছোট বাচ্চাদের মধ্যে একটি বাচ্চা আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে খুব সহজেই অন্যান্য শিশুদের মধ্যে এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়।‌ তবে একবার হাত পা এবং মুখের রোগে আক্রান্ত হলে তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এই রোগের ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে শক্তিশালী হয়ে উঠে। সাধারণত ১০ বছরের বেশি বয়স্ক শিশু এবং বড়দের ক্ষেত্রে এই রোগে‌ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম দেখা যায়। তবে কদাচিৎ হতে পারে বিশেষ করে যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল। 

কিভাবে হাত, পা এবং মুখের রোগ নির্ণয় করা হয়? 

হাত ও পায়ের তালু সহ মুখ গহ্বর ও গলার ভেতর লাল বর্ণের র‍্যাশ ও ছোট ছোট ফোস্কার মতো দেখা গেলে HFMD রোগ হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে।‌ এমতাবস্থায় একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তিনি রোগীর বয়স জানার পর হাত পা ও মুখের ভেতর পর্যবেক্ষণ (Physical examination) করে র‍্যাশ ও ফোস্কার ধরন বুঝে রোগ সম্পর্কে জানতে পারবেন। তবে প্রয়োজন সাপেক্ষে গলার ভেতর থেকে নমুনা (Throat swab) এবং রোগীর মল নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার মাধ্যমে ভাইরাস শনাক্ত তথা রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।  

হাত, পা এবং মুখের রোগ কিভাবে চিকিৎসা করা হয়? 

হাত, পা এবং মুখের রোগের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তেমন কোনো চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। বরং ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এমনিতেই রোগ ভালো হয়ে যায়। আর তাছাড়া হাত পা এবং মুখের রোগের জন্য কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা এন্টি ভাইরাল ঔষধ নেই। তবে রোগ যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য কতিপয় ঔষধ সেবন করা যেতে পারে। যেমনঃ 

  • জ্বর ও শরীর ব্যথার জন্য ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন‌ সিরাপ ১ চা চামচ পরিমাণে (৫ মিলিলিটার) দৈনিক ৩ বার খাওয়াতে হবে। 
  • বাহ্যিকভাবে ত্বকে ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সেইজন্য একজন চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত।
  • ব্যথা নিরাময়ের জন্য এসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। কারণ, এর ফলে Reye’s syndrome নামক জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। 

হাত, পা এবং মুখের রোগের ঘরোয়া প্রতিকার

যেহেতু হাত, পা এবং মুখের রোগের জন্য তেমন কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই, সুতরাং কয়েকটি ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমনঃ 

  • দুধ ও আইসক্রিম খাওয়াতে হবে
  • শক্ত খাবার গিলতে সমস্যা হলে শরবত, স্যুপ ও তরল খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে
  • অতিরিক্ত লবণ মিশ্রিত খাবার ও স্পাইসি ফুড বর্জন করতে হবে
  • টক জাতীয় খাবার কম খেতে হবে
  • কুসুম গরম পানিতে অল্প পরিমাণ লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করলে গলা ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে 
  • পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে
  • পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে 

হাত, পা, মুখের রোগ কি প্রতিরোধ করা যায়?

হাত, পা এবং মুখের রোগ প্রতিরোধের জন্য কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। তবে একজন অসুস্থ বাচ্চা থেকে অন্য সুস্থ বাচ্চাদের মধ্যে যেন এই রোগ ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য নিচে উল্লেখিত নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। যেমনঃ

  • অসুস্থ শিশুকে স্কুলে পাঠানো যাবে না
  • অসুস্থ ব্যক্তির সাথে অন্য কারো হাত মেলানো বা শরীরের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে 
  • রোগীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে না
  • বাইরে থেকে ঘরে ফিরে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালো ভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে 

হাত, পা এবং মুখের রোগ সাধারণত তেমন কোনো জটিলতার সৃষ্টি করে না। তবে কারো ক্ষেত্রে রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে সুস্থ না হলে সেক্ষেত্রে জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এই‌ রোগের সম্ভাব্য জটিলতা হিসেবে মেনিনজাইটিস, হাত ও পায়ের নখের সমস্যা, প্যারালাইসিস এবং হার্টের রোগ হতে পারে। 

References

Selner, M. (2022, February 04). What Is Hand, Foot, and Mouth Disease (HFMD)? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/hand-foot-mouth-disease

 

Last Updated on April 15, 2023