ভিটামিন বি৯ বা ফোলেটের কৃত্রিম ধরন হলো ফলিক অ্যাসিড (Folic acid) যা শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোষের DNA উৎপাদন ও মেরামত করা, কোষ বিভাজন, লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ফলিক অ্যাসিডের ভূমিকা রয়েছে।  

ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট সাধারণত গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে সেবন করতে দেখা যায়। তবে ছেলেদের জন্য ফলিক অ্যাসিড বিভিন্ন উপকারিতা বয়ে আনতে পারে যা এই অনুচ্ছেদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। এছাড়াও ফলিক অ্যাসিড সেবনের মাত্রা বা ডোজ সম্পর্কিত নির্দেশনা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।  

ছেলেদের জন্য ফলিক অ্যাসিডের উপকারিতা 

বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় ফলিক অ্যাসিড ছেলেদের জন্য যেসব উপকারিতা বয়ে আনতে পারে বলে জানা গেছে তা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো। (Raman, 2021) 

১. বিষন্নতা দূর করে 

A Depressed Man

বিষন্নতা হলো একটি মানসিক সমস্যা যার ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। আমাদের দেশের অনেক মানুষ বিষন্নতায় ভুগছেন এবং দীর্ঘমেয়াদী বিষন্নতার ফলে প্রায়ই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। 

গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা বিষন্নতায় ভুগছেন তাদের রক্তে ফলিক অ্যাসিডের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কম। অর্থাৎ যারা পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলেট সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করেন না তাদের ক্ষেত্রে বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।  

অন্য আরেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিষন্নতা দূর করার জন্য ব্যবহৃত ওষুধের (Antidepressants) পাশাপাশি ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করা হলে তা বিষন্নতা দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া এবং সুনির্দিষ্ট মাত্রায় সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ সম্পর্কিত তথ্যের জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। 

২. হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়  

পৃথিবী জুড়ে অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো হার্টের রোগ বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাকস্ট্রোক। আর হার্টের রোগের একটি রিস্ক ফ্যাক্টর হলো Homocysteine যা প্রোটিন জাতীয় খাবারের বিপাক প্রক্রিয়ায় উপজাত (Byproduct) হিসেবে উৎপন্ন হয়। রক্তে Homocysteine এর পরিমাণ বেশি থাকলে তাদের ক্ষেত্রে হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। 

ফলিক অ্যাসিড রক্তে Homocysteine এর পরিমাণ স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ যাদের রক্তে ফলিক অ্যাসিডের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কম তাদের ক্ষেত্রে রক্তে Homocysteine এর পরিমাণ বেড়ে যায় যাকে মেডিকেলের ভাষায় Hyperhomocysteinemia বলে। 

গবেষণায় দেখা গেছে যে, ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার ফলে রক্তে Homocysteine এর পরিমাণ কমে যায়। এছাড়াও ফলিক অ্যাসিড হার্টে রক্ত চলাচল ভালো রাখতে এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

৩. স্নায়ুতন্ত্রের জন্য উপকারী  

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যাদের রক্তে Homocysteine এর পরিমাণ বেশি থাকে তাদের ক্ষেত্রে ডিমেনশিয়া ও আলজেইমার্স (Alzheimer’s disease) নামক মস্তিষ্কের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। (Harvard T.H. Chan, School of Public Health, 2023) 

তবে ডিমেনশিয়া ও আলজেইমার্স রোগ প্রতিরোধে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে এমন কোনো তথ্য গবেষণায় প্রমাণিত হয়নি। 

৪. চুলের জন্য উপকারী 

বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে চুল পেকে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, অল্প বয়সে চুল পেকে যাচ্ছে যা সৌন্দর্যহানিকর একটি বিষয়। এছাড়াও ছেলেদের আরেকটি কমন সমস্যা হলো অতিরিক্ত চুল পড়ে যাওয়া। অল্প বয়সে চুল পেকে গেছে এমন ব্যক্তিদের নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যে, তাদের রক্তে ফলিক অ্যাসিডের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কম ছিল। 

ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার ফলে অকালে চুল পেকে যাওয়া সমস্যা দূর হয়। এছাড়াও মাথায় নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। চুলের যত্নে ব্যবহৃত অনেক প্রসাধনী সামগ্রীতে ফলিক অ্যাসিড থাকে। তবে চুল পাকা প্রতিরোধে এবং নতুন চুল গজাতে ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট মুখে সেবন করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়ার জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।  

৫. প্রজনন ক্ষমতা বাড়ায়  

ফলিক অ্যাসিড ও জিংক মিশ্রণে সাপ্লিমেন্ট কিনতে পাওয়া যা পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত ফলিক অ্যাসিড ও জিংক সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার ফলে শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণগত মান বেড়ে যায়। অপর আরেকটি গবেষণায় প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে ফলিক অ্যাসিড ও জিংক সাপ্লিমেন্টের কোনো ভূমিকা নেই বলে দাবি করা হয়েছে। অর্থাৎ বিষয়টি নিয়ে এখনো মতপার্থক্য রয়ে গেছে। 

৬. ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে 

Cancer Prevention

গবেষণায় দেখা গেছে যে, ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার ফলে ব্রেস্ট ক্যান্সার ও কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। তবে এই ধরনের গবেষণা করার জন্য দীর্ঘদিন উচ্চ মাত্রায় ফলিক অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়েছে।‌ ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য উচ্চ মাত্রায় ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত হবে কিনা সেই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। 

ওষুধের মাত্রা বা ডোজের নির্দেশাবলী  

একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলেট দরকার যা খাবার থেকে গ্রহণ করা উত্তম। শিম, মটরশুটি, লেটুসপাতা, বাঁধাকপি, পালংশাক, লেবু, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুর, বাদাম, কলিজা, ডিম, মাছ, গরুর মাংস, মুরগির মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, সামুদ্রিক খাবার ইত্যাদি থেকে প্রচুর পরিমাণে ফলেট পাওয়া যায়।  

ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট (ট্যাবলেট) গ্রহণ করার জন্য একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ বয়স ও শরীরের চাহিদা অনুযায়ী ওষুধের ডোজ বা মাত্রা ভিন্নতর হয়ে থাকে।

সাধারণত ৫ মিলিগ্রাম মাত্রায় প্রতিদিন একটি করে ট্যাবলেট সেবনের নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে সপ্তাহে মাত্র একবার ৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে। ওষুধ সেবনের ব্যাপারে কিছু সাধারণ নির্দেশনা হলোঃ 

  • প্রতিদিন একই সময়ে ওষুধ খেতে হবে। 
  • খালিপেটে অথবা ভরাপেটে যখন খুশি ওষুধ খাওয়া যাবে। 
  • ট্যাবলেট ওষুধ চুষে বা কামড়ে না খেয়ে বরং পানি সহকারে সরাসরি গিলে খেতে হবে। 
  • তরল ওষুধের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কাপ ব্যবহার করে সঠিক পরিমাণে ওষুধ সেবন করতে হবে। 
  • কখনো ওষুধ খেতে ভুলে গেলে পরের দিন দুইটি ওষুধ একবারে খাওয়া যাবে না। 

আপনার ক্ষেত্রে কতটুকু পরিমাণে এবং কতদিন পর্যন্ত ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট খেতে হবে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পেতে একজন ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া 

ফলিক অ্যাসিড বা ভিটামিন বি৯ হলো পানিতে দ্রবণীয় একটি ভিটামিন যা শরীরে দীর্ঘসময় পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকে না। আবার পানিতে দ্রবণীয় বলেই অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করা হলে তা প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যেতে পারে। তাই ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের ফলে সাধারণত তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তবে কদাচিৎ নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যেতে পারে। যথাঃ 

  • মুখের স্বাদ পরিবর্তন হওয়া
  • বমি বমি ভাব (Nausea)
  • ক্ষুধার অনুভূতি কমে যাওয়া 
  • খিটখিটে মেজাজ 
  • ঘুমের সমস্যা    

ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ কিছু কিছু ওষুধের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। যেমনঃ খিঁচুনি নিরাময়ের ওষুধ, ক্যান্সারের ওষুধ, ম্যালেরিয়ার ওষুধ ইত্যাদি। ওষুধের কার্যকারিতা ঠিক রাখতে দুই ধরনের ওষুধ সেবনের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান রাখতে হবে অথবা ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে চলুন।

আলোচনায় প্রতীয়মান যে, ফলিক অ্যাসিড শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা বিভিন্ন উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। তবে যেসব গবেষণালব্ধ ফলাফল দেখা গেছে তা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অর্থাৎ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাওয়ার জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। আর তাই ছেলেদের ক্ষেত্রে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরিবর্তে ফলেট সমৃদ্ধ খাবারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। একান্তই প্রয়োজন মনে করলে সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে। 

Bibliography

Harvard T.H. Chan, School of Public Health. (2023, 03). Folate (Folic Acid) – Vitamin B9. Retrieved from Harvard: https://www.hsph.harvard.edu/nutritionsource/folic-acid/

Raman, R. (2021, 01 04). Folic Acid for Men: Benefits, Side Effects, and More. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/folic-acid-for-men

Last Updated on October 31, 2023