শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো ভিটামিন যা ক্যালরি সরবরাহ করে না তবে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। ভিটামিনের অনেকগুলো ধরন রয়েছে যার মধ্যকার একটি হলো ভিটামিন কে। 

সাধারণত শরীরে ভিটামিন কে এর অভাব দেখা যায় না। তবে কারো কারো অভাব হতে পারে। ভিটামিন কে কি, শরীরের কি কি কাজে অংশগ্রহণ করে, কাদের ক্ষেত্রে অভাব হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, ভিটামিন কে এর স্বাস্থ্য উপকারিতা, সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।  

ভিটামিন কে কি?

ভিটামিনের মোট ১৩ টি প্রকরণ রয়েছে যা ইংরেজি বর্ণমালা A থেকে শুরু হয়ে E পর্যন্ত সিরিয়াল অনুযায়ী হয়েছে। অর্থাৎ ভিটামিন এ, বি, সি, ডি, ই যার মধ্যে বি এর ৮ টি প্রকরণ রয়েছে। বাকি আরেকটি হলো ভিটামিন কে যা বর্ণমালার সিরিয়াল থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। 

১৯২৯ সালে ভিটামিন কে আবিষ্কার হয়। ভিটামিন কে শরীরের কেটে যাওয়া স্থানে রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়ক প্রোথ্রোম্বিন (Prothrombin) নামক উপাদান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

জার্মান সায়েন্টিফিক জার্নালে এই ভিটামিনের নাম Koagulation Vitamin লেখা হয়েছে। জার্মান শব্দ Koagulation থেকে K নিয়ে ইংরেজি বর্ণমালার সিরিয়াল ছাড়াই ভিটামিন কে এর নামকরণ করা হয়েছে। Koagulation এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Coagulation যার বাংলা অর্থ জমাট বাঁধা। 

ভিটামিন কে চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন যা প্রতিদিন গ্রহণ না করলেও সমস্যা হবে না। কারণ শরীরের চর্বিতে ভিটামিন কে জমা থাকে এবং পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী জমে থাকা ভিটামিন কে ব্যয় হয়। 

ভিটামিন কে কিভাবে কাজ করে? 

how vitamin k works

ভিটামিন কে শরীরের কেটে যাওয়া স্থানে রক্ত জমাট বাঁধার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও ভিটামিন কে শরীরের আরো যেসব গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে তা নিচে বর্ণনা করা হলো।‌ 

হাড় ও‌ দাঁতের গঠন মজবুত করে 

ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার পর ভিটামিন ডি এর সহায়তায় অন্ত্রের মাধ্যমে শোষণ হয়ে রক্তে পৌঁছায়। অতঃপর ভিটামিন কে এর সহায়তায় ক্যালসিয়াম রক্তনালীতে জমা না হয়ে বরং দাতের এনামেল ঠিক রাখে এবং হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ দাত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে এবং হাড়ের রোগ (অস্টিওপরোসিস) প্রতিরোধে সাহায্য করে।  

হার্টের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে

শরীরে‌‌ পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন কে না থাকলে সেক্ষেত্রে রক্তনালীতে ক্যালসিয়াম জমা হতে থাকে যার ফলে হার্টের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আর যদি শরীরে ভিটামিন কে এর অভাব না‌ হয় তাহলে রক্তনালীতে ক্যালসিয়াম জমা হতে পারে না। অর্থাৎ হার্ট ভালো রাখার ক্ষেত্রে ভিটামিন কে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভিটামিন কে ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। তবে এই বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করা হয়। (Leech, 2023)

মস্তিষ্কের রোগ প্রতিরোধ করে 

সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভিটামিন কে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা (স্মৃতিশক্তি) ভালো রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে আলজেইমার্স রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে। তবে এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো গবেষণা প্রয়োজন। (Cleveland Clinic, 2022) 

ভিটামিন কে এর দৈনিক চাহিদা 

বয়স অনুযায়ী ভিটামিন কে এর দৈনিক চাহিদা কম-বেশি হলেও লিঙ্গ হিসেবে (নারী বনাম পুরুষ) খুব বেশি পার্থক্য দেখা যায় না। নিচের ছকে ভিটামিন কে এর দৈনিক চাহিদা তুলে ধরা হয়েছে। (National Institutes of Health, 2021)  

বয়স পুরুষ মহিলা 
জন্ম থেকে ৬ মাস ২ মাইক্রোগ্রাম ২ মাইক্রোগ্রাম 
৭ থেকে ১২ মাস ২.৫ মাইক্রোগ্রাম ২.৫ মাইক্রোগ্রাম
১ থেকে ৩ বছর ৩০ মাইক্রোগ্রাম৩০ মাইক্রোগ্রাম
৪ থেকে ৮ বছর ৫৫ মাইক্রোগ্রাম৫৫ মাইক্রোগ্রাম
৯ থেকে ১৩ বছর ৬০ মাইক্রোগ্রাম৬০ মাইক্রোগ্রাম
১৪ থেকে ১৮ বছর ৭৫ মাইক্রোগ্রাম৭৫ মাইক্রোগ্রাম
১৯ বছরের বেশি ১২০ মাইক্রোগ্রাম ৯০ মাইক্রোগ্রাম 

গর্ভবতী নারী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন কে দরকার হয় না। বরং বয়স অনুযায়ী সাধারণ নারীদের জন্য নির্দেশিত মাত্রা প্রযোজ্য হবে। 

অর্থাৎ ১৮ বছরের কম বয়সী গর্ভবতী নারী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য দৈনিক ৭৫ মাইক্রোগ্রাম এবং ১৯ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য দৈনিক ৯০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে গ্রহণ করতে হবে। 

কোন কোন উৎস থেকে ভিটামিন কে পাওয়া যায়? 

vitamin k sourch

ভিটামিন কে এর দুইটি ধরন রয়েছে। যথাঃ 

  • ভিটামিন কে১ (Phylloquinone)
  • ভিটামিন কে২ (Menaquinones)

ভিটামিন কে১ 

মূলত উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে পাওয়া যায়। যেমনঃ বাঁধাকপি, ব্রকলি, লেটুসপাতা, শিম, পালংশাক, শালগম, বরবটি ইত্যাদি। এছাড়াও শশা, গাজর, পেঁপে, পেয়ারা, অ্যাভোকাডো, ডালিম, আঙ্গুর ও স্ট্রবেরি থেকে ভিটামিন কে১ পাওয়া যায়।

ভিটামিন কে২

প্রধানত প্রাণীজ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার। যেমনঃ মাংস,‌ ডিম, দই, পনির ইত্যাদি। এছাড়াও পেটের (অন্ত্র) ভেতর বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ভিটামিন কে২ তৈরি হয়। 

ভিটামিন কে কাদের গ্রহণ করা উচিত?

প্রত্যেক মানুষের খাদ্যতালিকায় ভিটামিন কে সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। খাবার থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন কে পাওয়া যায় এবং শরীরে‌ জমা থাকে। তাই সাধারণত শরীরে ভিটামিন কে এর অভাব দেখা যায় না। 

যেসব ক্ষেত্রে ভিটামিন কে এর অভাব হতে দেখা যায় তা হলোঃ 

  • লিভারের ও প্যানক্রিয়াসের রোগ বা অন্ত্রের রোগ (ক্রন’স ডিজিজ আলসারেটিভ কোলাইটিস) রয়েছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ভিটামিন কে এর অভাব হতে পারে। 
  • যাদের নিয়মিত রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধী ওষুধ (Warfarin) সেবন করতে হয়।
  • এন্টি-বায়োটিক সেবনের ফলে পেটের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমে যায় যার ফলে ভিটামিন কে২ উৎপাদন ব্যাহত হয়। 

শরীরে ভিটামিন কে এর অভাব হলে কেটে যাওয়া স্থানে রক্ত জমাট বাঁধতে দেরি হয়, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় এবং হাড় দুর্বল হয়ে যায় অর্থাৎ হাড় ক্ষয় রোগ (অস্টিওপরোসিস) হতে পারে। 

শিশুদের শরীরে ভিটামিন কে এর অভাব হতে পারে। যার জন্য শিশুদের ভিটামিন কে ইনজেকশন দিতে হয়।

ভিটামিন কে সাপ্লিমেন্ট 

আমাদের দেশে যেসব নামে ভিটামিন কে সাপ্লিমেন্ট (ক্যাপসুল) কিনতে পাওয়া যায় তা হলোঃ 

  • Dinakion ® 
  • Kayon® 

এছাড়াও ইনজেকশন ফর্মে নিম্নলিখিত নামে ভিটামিন কে কিনতে পাওয়া যায়।

  • Babykion®
  • Dinakion®
  • Inj. K MM®
  • K-One MM®  
  • Konakion® 

চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ভিটামিন কে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না।

ভিটামিন কে এর স্বাস্থ্য উপকারিতা 

অভাব পুরণ ছাড়াও স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়ার জন্য ভিটামিন কে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে হাড়ের ঘনত্ব ঠিক রাখতে এবং হাড়ের রোগ প্রতিরোধের জন্য একসাথে ভিটামিন ডি ও ভিটামিন কে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। 

আমাদের দেশের একটি স্বনামধন্য ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান (স্কয়ার) ভিটামিন ডি ও ভিটামিন কে এর সমন্বয়ে একটি সাপ্লিমেন্ট বাজারজাত করেছে যার নাম হলো DK ক্যাপসুল যা চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী সেবন করতে হবে।  

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া 

প্রচুর পরিমাণ খাবার খাওয়া হলেও শরীরে ভিটামিন কে এর মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে যায় না। সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের ফলেও শরীরে ভিটামিন কে এর আধিক্য জনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ অতিরিক্ত ভিটামিন কে শরীরে জমা থাকে অথবা প্রস্রাব ও মলের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।

তবে তাই বলেই অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন কে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না।  

References

Cleveland Clinic. (2022, December 07). Top Benefits of Vitamin K. Retrieved from Cleveland Clinic: https://health.clevelandclinic.org/vitamin-k/amp/

Leech, J. (2023, June 26). Vitamin K2: Everything You Need to Know. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/vitamin-k2

National Institutes of Health. (2021, March 29). Vitamin K. Retrieved from National Institutes of Health: https://ods.od.nih.gov/factsheets/VitaminK-HealthProfessional/

Last Updated on January 2, 2024