মাম্পস (Mumps) হলো Paramyxovirus নামক ভাইরাস ঘটিত একটি সংক্রামক রোগ। এই রোগের আক্রমণ স্থান হলো প্যারোটিড গ্ল্যান্ড যা মুখমণ্ডলের দুই পাশে কানের নিচ বরাবর অবস্থান করে। মাম্পস রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস খুব সহজেই একজন অসুস্থ ব্যক্তি থেকে অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি ও কাশি থেকে নির্গত ড্রপলেট বা লালার মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।

মাম্পস ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ বা চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। তবে কতিপয় ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে এই রোগের প্রতিকার এবং ভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো (প্রতিরোধ করা) সম্ভব হয়। 

মাম্পস এর ঘরোয়া চিকিৎসা

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রোগমুক্তি ঘটায়। ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করা রোগ লক্ষণ নিরাময়ে ও ভাইরাস প্রতিহত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। মাম্পস এর ৫টি ঘরোয়া চিকিৎসা নিচে বর্ণনা করা হলো। (Warjri, 2022) 

১। বিশ্রাম

মাম্পস রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর জন্য বিশ্রামে থাকা জরুরী।‌ বিশ্রামের ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো যথেষ্ট শক্তি পায়। 

স্কুলগামী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মাম্পস হলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখতে হবে। সাধারণত বাচ্চাদের তুলনায় বড়দের ক্ষেত্রে মাম্পস হওয়ার প্রবণতা কম দেখা যায়। তবে কারো ক্ষেত্রে হলে কাজ না করে বরং যতটা সম্ভব বিশ্রামে থাকা উচিত। 

সব বয়সের মানুষের জন্য জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে যেন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে।

২। ঠান্ডা বা গরম সেঁক দেওয়া

মাম্পস রোগের ক্ষেত্রে প্যারোটিড গ্ল্যান্ড ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়। ব্যথা কমানোর জন্য আক্রান্ত স্থানে গরম বা ঠান্ডা সেঁক দেওয়া উপকারী হবে। কারো কারো ক্ষেত্রে ঠান্ডা সেঁক দিলে আরাম বোধ হয় আবার কারো ক্ষেত্রে গরম সেঁক ভালো লাগে। যার জন্য যেটা উপকারী সেটাই ব্যবহার করতে হবে।

গরম সেঁক দেওয়ার জন্য একটি কাপড় ইস্ত্রি বা হিটারের সাহায্যে গরম করে নিতে হবে। আর ঠান্ডা সেঁক দেওয়ার জন্য কাপড়ের মধ্যে বরফের টুকরো পেঁচিয়ে নিতে হবে। একটানা দীর্ঘসময় পর্যন্ত সেঁক না দিয়ে বরং বার বার সেঁক দিতে হবে। দিনের মধ্যে কয়েকবার সেঁক দিলে ব্যথা ও ফোলা অনেকটাই কমে যাবে।

৩। আদা

আদার ব্যবহার রান্নার কাজে খাবারের স্বাদ ও গন্ধ বৃদ্ধি করা ছাড়াও বিভিন্ন রোগের ঘরোয়া সমাধান হিসেবে আদা উপকারী ভূমিকা পালন করে। মাম্পস রোগের ক্ষেত্রে ব্যথা নিরাময়ে ও ভাইরাস প্রতিহত করতে আদার প্রদাহ নাশক ও এন্টিমাইক্রোবিয়াল (Antimicrobial) গুণাবলী সহায়তা করে।

সামান্য পরিমাণ আদা কুঁচি করে মুখে নিয়ে চিবানো যেতে পারে। এছাড়াও গরম পানি বা চায়ের সাথে আদা যোগ করে খাওয়া যেতে পারে। ব্যথার স্থানে আদা পিষে পেস্ট বানিয়ে প্রলেপ দেওয়া ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

আদার ১৬টি উপকারিতা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।  

৪। চুইংগাম (Chewing gum) 

মাম্পস আক্রান্ত হলে প্যারোটিড গ্ল্যান্ডের লালা নিঃসরণ কমে যায়। তাই শিশুদেরকে চুইংগাম চিবানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়। কারণ চুইংগাম মুখে নিয়ে চিবানো হলে লালা নিঃসরণ হতে থাকে তথা প্যারোটিড গ্ল্যান্ডের কার্যক্রম বেড়ে যায় যা মাম্পস রোগ সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। 

চুইংগাম শক্ত প্রকৃতির কোনো খাবার নয়। তাই চিবানোর ফলে ব্যথা বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং মাম্পস রোগীদের জন্য উপকারী। তাই মাম্পস আক্রান্ত শিশুকে দিনে কয়েকবার চুইংগাম খেতে দিতে হবে। 

শিশুকে চুইংগাম খেতে দিলে ভুলে গিলে ফেলতে পারে এবং তা পেটের মধ্যে গিয়ে মারাত্মক কোনো ক্ষতি করবে এই ভয়ে অনেক মা বাবা চিন্তিত থাকেন। প্রকৃতপক্ষে চুইংগাম গিলে ফেললে ক্ষতিকর কিছু হয় না। তবে নিঃসন্দেহে চুইংগাম গিলে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারিতা বয়ে আনবে না।

৫। নিমপাতা ও হলুদ

Neem And Turmeric

আমাদের দেশে বিভিন্ন রোগের ঘরোয়া সমাধান হিসেবে নিমপাতার বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মাম্পস রোগের ক্ষেত্রেও নিমপাতা উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে।

নিমপাতা গুঁড়া করে বা পেস্ট বানিয়ে এর সাথে সমপরিমাণ হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে ফোলা স্থানে প্রলেপ দিলে ব্যথা ও ফোলা কমাতে সাহায্য করে। নিমপাতা ও হলুদের প্রদাহ নাশক ও এন্টিমাইক্রোবিয়াল গুণাবলীর জন্য এমন উপকারিতা পাওয়া যায়। 

 কাঁচা হলুদ খাওয়ার ১০টি উপকারিতা ও নিয়ম সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

মাম্পস রোগের ওষুধ

Mumps Medication

মাম্পস ভাইরাস ঘটিত একটি রোগ যার চিকিৎসায় এন্টি বায়োটিক ওষুধ কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না। তবে জ্বর ও ব্যথা নাশক ওষুধ খাওয়া উপকারী হবে। যেমনঃ (Moawad, 09)

প্যারাসিটামল (Paracetamol)

জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামলের (Paracetamol) ভূমিকা অনস্বীকার্য যা Ace®, Fast®, Fea®, Feva®, Fevac®, Napa®, Renova® ইত্যাদি নামে বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।‌ 

আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen)

ব্যথা নিরাময়ের জন্য আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) সেবন করতে হবে যা Advel®, Alflam®, Arafa®, Flamex®, Inflam®, Profen®, Reufen®, Siflam® ইত্যাদি নামে বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। 

ছোট শিশুদের জন্য সিরাপ জাতীয় ওষুধ প্যাকেটের গায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী খাওয়াতে হবে এবং বড়দের জন্য ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। এছাড়াও তীব্র প্রকৃতির জ্বর ও ব্যথা নিরাময়ের জন্য সাপোজিটরি রয়েছে যা পায়ুপথে ব্যবহার করতে হয়। 

প্যারাসিটামল ও আইবুপ্রোফেন ওষুধ দুইটি ওটিসি মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ এগুলো ডাক্তারের নির্দেশনা ছাড়াই সেবন করা যেতে পারে। তবে অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ খাওয়া যাবে না। আর ছোট শিশুদের জন্য ওষুধের ডোজ সম্পর্কিত সঠিক নির্দেশনা পেতে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা উত্তম।

 মাম্পস রোগীর খাবার

  • মাম্পস রোগীর জন্য শক্ত খাবার চিবিয়ে খাওয়া কষ্টকর হবে। তাই তরল জাতীয় বা নরম প্রকৃতির খাবার খেতে হবে। 
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। চা খাওয়া উপকারী হবে তবে কোমল পানীয় পান করা যাবে না। 

মাম্পস রোগ প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন (MMR- Measles, Mumps, Rubella) রয়েছে। মাম্পস রোগে আক্রান্তদের জন্য রোগ নিরাময়ে ভ্যাকসিন কোনো কাজে দেবে না বরং সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য মাম্পসের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে হয়।

মাম্পস সাধারণত ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে এই সময়ে যতটা সম্ভব সুস্থ ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে যেন রোগটি ছড়িয়ে পড়তে না পারে। এছাড়াও ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করে ভালো ফলাফল পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

মাম্পস ও টনসিলাইটিস সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি রোগ কিন্তু লক্ষণ প্রায় একই রকম মনে হয়। পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে মাম্পসের ক্ষেত্রে ফোলাভাব ও ব্যথা কানের নিচে হয়ে থাকে আর টনসিলাইটিসের ফোলাভাব ও ব্যথা গলার নিচের দিকে হয়ে থাকে। 

মাম্পসের জন্য ঘরোয়া পদ্ধতি ব্যতীত সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা (ভাইরাস প্রতিহত করার ওষুধ) না থাকলেও ব্যাকটেরিয়া জনিত টনসিলাইটিসের জন্য শুধু ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন না করে এন্টিবায়োটিক ওষুধ সেবনের প্রয়োজন পড়ে। লক্ষণ দেখে মাম্পস হয়েছে নাকি টনসিলাইটিস সেটা নির্ণয় করতে না পারলে ঘরোয়া চিকিৎসার পরিবর্তে বরং শুরুতেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

References

Moawad, H. (09, November 2022). How Mumps Is Treated. Retrieved from Very Well Health: https://www.verywellhealth.com/mumps-treatment-4163821

Warjri, L. (2022, November 23). Home Remedies for Mumps. Retrieved from MeD INDIA: https://www.medindia.net/homeremedies/mumps.asp

Last Updated on November 21, 2023