মাম্পস ছোঁয়াচে প্রকৃতির একটি রোগ যা সাধারণত ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হতে দেখা যায়। মাম্পস রোগের চিকিৎসায় কার্যকরী কোনো এন্টিভাইরাল ওষুধ নেই তবে কিছু নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে মাম্পসের লক্ষণ নিরাময় করা সম্ভব। এছাড়াও মাম্পস রোগ প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন রয়েছে।
এই অনুচ্ছেদে মাম্পস রোগের কারণ, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, চিকিৎসা পদ্ধতি, জটিলতা সমূহ, প্রতিরোধের উপায় ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও মাম্পস রোগ সম্পর্কিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর জানতে অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
মাম্পস কি? (Mumps meaning in bengali)
মাম্পস (Mumps) হলো ভাইরাস ঘটিত একটি সংক্রামক রোগ যা প্যারোটিড গ্ল্যান্ডে (Parotid glands) হয়ে থাকে। প্রত্যেক মানুষের মুখমণ্ডলের দুই পাশে কানের নিচ বরাবর প্যারোটিড গ্ল্যান্ড নামক দুইটি লালাগ্রন্থি থাকে যেখান থেকে লালা রস (Saliva) নিঃসরণ হয়।
মাম্পসের কারণ
মাম্পস রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসের নাম হলো Paramyxovirus যা খুব সহজেই একজন অসুস্থ ব্যক্তি থেকে অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি ও কাশি থেকে নির্গত ড্রপলেট অথবা লালার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ মাম্পস রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণগুলো হলোঃ (Cleveland Clinic, 2022)
- অসুস্থ ব্যক্তির হাঁচি ও কাশি
- মুখোমুখি কথা বলার সময় নির্গত থুথু বা ড্রপলেট
- চুম্বন করা (লালা রসের সংস্পর্শ)
- মাম্পস আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র (থালা বাসন, তোয়ালে, পোশাক ইত্যাদি) শেয়ার করা
মাম্পস সাধারণত ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। বিশেষ করে স্কুলগামী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে একজন আক্রান্ত হলে দ্রুত অন্যান্য শিশুদের মাঝে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
মাম্পসের লক্ষণ ও উপসর্গ
মাম্পস রোগের ভাইরাস শরীরে আক্রমণের পর লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১২ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ দিন পর্যন্ত (গড় হিসেবে ১৭ দিন) সময় লেগে যেতে পারে যাকে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা সুপ্তিকাল বলা হয়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে ভাইরাস সংক্রমণের ফলে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। অর্থাৎ শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হয় ঠিকই কিন্তু লক্ষণ এতোই মৃদু প্রকৃতির হয়ে থাকে যা রোগী বুঝতে সক্ষম হয় না।
মাম্পস রোগের প্রধান লক্ষণ হলো প্যারোটিড গ্ল্যান্ড ফুলে যাওয়া (Swelling) এবং সেই সাথে প্রদাহ বা ব্যথা হওয়া। এছাড়াও অন্যান্য লক্ষণগুলো হলোঃ (Roth, 2018)
- জ্বর
- গলাব্যথা
- মাথাব্যথা
- ক্লান্তি বোধ
- পেশীতে ব্যথা
- ক্ষুধা কমে যাওয়া
- খাবার গিলতে কষ্ট হওয়া
যেকোনো একপাশের অথবা উভয় পাশের প্যারোটিড গ্ল্যান্ড আক্রান্ত হতে পারে। তবে সাধারণত একপাশেই হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
প্যারোটিড গ্ল্যান্ডের অবস্থান টনসিলের খুব কাছাকাছি হওয়ায় সাধারণ মানুষ মাম্পস রোগকে টনসিলাইটিস হিসেবে মনে করে থাকেন। মাম্পস ও টনসিলাইটিস সম্পূর্ণ আলাদা দুইটি রোগ এবং লক্ষণের ক্ষেত্রে একটি পার্থক্য হলো মাম্পসের ক্ষেত্রে ফোলাভাব ও ব্যথা কানের নিচে হয়ে থাকে আর টনসিলাইটিসের ক্ষেত্রে ফোলাভাব ও ব্যথা গলার নিচের দিকে হয়ে থাকে। গলার নিচের দিকে দুই পাশে দুইটি টনসিল থাকে।
টনসিলাইটিসের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জানার জন্য এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
মাম্পসের চিকিৎসা
মাম্পস ভাইরাস প্রতিহত করতে পারে এমন কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। অর্থাৎ এই রোগের কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে রোগ লক্ষণ নিরাময়ের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে উল্লেখিত ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমনঃ
- জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল (Paracetamol) ওষুধ যা বাজারে Ace®, Fast®, Fea®, Feva®, Fevac®, Napa®, Renova® ইত্যাদি নামে কিনতে পাওয়া যায়।
- ব্যথা নিরাময়ের জন্য রয়েছে আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) ওষুধ যা Advel®, Alflam®, Arafa®, Flamex®, Inflam®, Profen®, Reufen®, Siflam® ইত্যাদি নামে কিনতে পাওয়া যায়।
প্যারাসিটামল ও আইবুপ্রোফেন ওটিসি মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়াই সেবন করা যেতে পারে। তবে ছোট বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ ডোজ সম্পর্কিত সঠিক নির্দেশনা পেতে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা উত্তম।
মাম্পস একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ যার চিকিৎসায় এন্টি বায়োটিক ওষুধ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না। আর তাই মাম্পসের জন্য অহেতুক এন্টি বায়োটিক ওষুধ সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
মাম্পসের ভ্যাকসিন দেওয়ার পর কিছু ঘরোয়া উপায় মেনে চললে এই রোগ থেকে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়। মাম্পস আক্রান্ত রোগীদের জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত। যেমনঃ
- ব্যথা কমানোর জন্য ফোলা স্থানে ঠান্ডা বা গরম সেঁক দেওয়া যেতে পারে।
- বিশ্রামে থাকতে হবে যেন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রোগমুক্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট এনার্জি বা শক্তি পায়।
- যতটা সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে যেন সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে। বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- শক্ত খাবার চিবিয়ে খাওয়া কষ্টকর হবে। তাই তরল (যেমনঃ স্যুপ) ও নরম প্রকৃতির খাবার খেতে হবে।
- প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। চা খাওয়া যেতে পারে তবে কোমল পানীয় পান করা যাবে না।
চা পান করার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
মাম্পস রোগের জটিলতা
সাধারণত এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই মাম্পস রোগ ভালো হয়ে যায়। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে (খুব বিরল) মাম্পস রোগের ফলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা যায়। যেমনঃ
- আর্থ্রাইটিস (Arthritis)
- শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া
- মেনিনজাইটিস (Meningitis)
- এনসেফালাইটিস (Encephalitis)
- প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ
- ছেলেদের অন্ডকোষে প্রদাহ
- মেয়েদের ডিম্বাশয়ে প্রদাহ
মেনিনজাইটিসের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
কিভাবে মাম্পস রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে?
মাম্পস রোগ প্রতিরোধের জন্য করণীয় বিষয়াবলী হলোঃ
- মাম্পস আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।
- মহামারী আকারে মাম্পস ছড়িয়ে পড়লে সেক্ষেত্রে বাইরে চলাফেরার সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। যেমনঃ মাস্ক পরিধান করা, বাইরে থেকে ঘরে ফিরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ইত্যাদি।
- মাম্পস রোগ প্রতিরোধের জন্য শিশুদের টিকা (MMR- Measles, Mumps, Rubella) দেওয়া হয় যা যথাসময়ে গ্রহণ করতে হবে।
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে স্বাস্থ্যকর খাবার (বিশেষ করে ফলমূল, শাকসবজি, বাদাম, ডিম ও মাছ) খেতে হবে।
১। বড়দের ক্ষেত্রে মাম্পস হতে পারে কি?
যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে মাম্পস হতে পারে। তবে বড়দের ক্ষেত্রে মাম্পস হওয়ার প্রবণতা খুব কম দেখা যায়। কারণ বড়দের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মাম্পস ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী থাকে।
২। একবার মাম্পস হলে কি পরবর্তীতে আবার হতে পারে?
একবার মাম্পস হয়ে সেরে যাওয়ার পর পুনরায় মাম্পস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। কারণ একবার আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয় যা পরবর্তীতে মাম্পস ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত করতে সাহায্য করে।
৩। মাম্পস ভ্যাকসিন কতটা কার্যকরী?
মাম্পসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরে এই রোগের প্রকোপ অনেকটাই কমে গেছে। অর্থাৎ মাম্পস রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। তবে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও মাম্পস হতে পারে। যদিও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বা সম্ভাবনা খুব কম থাকে।
৪। মাম্পস ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি কি?
মাম্পস ভ্যাকসিন (MMR) একদম নিরাপদ এবং এর তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। শিশুদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন দেওয়ার পর ইনজেকশন পুশ করার স্থানে ব্যথা বোধ এবং সেই সাথে জ্বর হতে পারে।
৫। গর্ভাবস্থায় মাম্পস হলে কি কি জটিলতা হতে পারে?
গর্ভাবস্থায় মাম্পস রোগের সংক্রমণ হলে গর্ভবতী নারী ও গর্ভস্থ সন্তানের উপর তেমন কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না। তবে খুব বিরল ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা হতে দেখা যায়। যেমনঃ কম ওজন নিয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করা, নির্ধারিত সময়ের আগেই বাচ্চা প্রসব হওয়া, শিশুর গঠনগত ত্রুটি ইত্যাদি।
References
Cleveland Clinic. (2022, 09 28). Mumps. Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/15007-mumps
Roth, E. (2018, September 29). Mumps: Prevention, Symptoms, and Treatment. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/mumps
Last Updated on November 21, 2023
Leave A Comment