শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য খাবার খাওয়া ছাড়াও অতিরিক্ত মানসিক চাপের প্রভাবে খাবার গ্রহণের প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে যাকে স্ট্রেস ইটিং বলা হয়। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে মানসিক চাপের প্রভাব জনিত অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের সম্ভাবনা বেশি দেখা যায় আর পুরুষদের ক্ষেত্রে ধুমপান ও মদ্যপান। 

অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের অভ্যাস শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। স্ট্রেস জনিত খাবার গ্রহণ প্রতিরোধের ৮টি উপায় নিয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

১। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন 

ক্ষুধার অনুভূতি থেকে নাকি মানসিক চাপ দূর করার জন্য খাবার খাচ্ছেন তা বুঝতে চেষ্টা করুন। মানসিক চাপ দূর করার জন্য অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে এই বিষয়টি নিজেকে বোঝাতে হবে। 

অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের অভ্যাস থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ। 

নিজের ইচ্ছা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তিশালী মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। ক্ষুধা ব্যতীত অহেতুক খাবার গ্রহণের প্রবণতা দূর করতে হবে। 

ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের সুবিধার জন্য এমন খাবার খেতে হবে যেগুলো দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখতে সাহায্য করবে। 

যেমনঃ ভালো মানের প্রোটিন (সিদ্ধ ডিম, মাছ, মুরগির মাংস, ডাল, শিমের বিচি ইত্যাদি), ফাইবার সমৃদ্ধ শর্করা (বাদামী চালের ভাত, আটার রুটি, ওটস ও যবের ছাতু) বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি।

২। প্রলোভন থেকে দূরে থাকুন 

ঘরে এমন কোনো খাবার রাখবেন না যা দেখলেই খেতে ইচ্ছা করবে। যেমনঃ বিস্কুট, পাউরুটি, চিপস ও চানাচুর সহ সবধরনের ফাস্টফুড থেকে দূরে থাকতে হবে। এগুলো স্বাস্থ্যকর খাবার নয়, বরং শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

অনেকেই আচার বানিয়ে ঘরে রেখে দেয় যা বিভিন্ন সময়ে খাওয়া হয়। সাধারণত আচারে অনেক বেশি পরিমাণে চিনি ও লবণ ব্যবহার করা হয়। তাই আচার খাওয়ার অভ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলা যায় না।

স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমনঃ বিভিন্ন ধরনের বাদাম (চীনাবাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, আখরোট ইত্যাদি), কুমড়ার বিচি, সূর্যমুখী বীজ, মৌসুমী ফলমূল ইত্যাদি। তবে এগুলো অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে।  

বাদামের ক্ষেত্রে দিনে সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম আর বীজের ক্ষেত্রে ৩০ গ্রামের বেশি খাওয়া উচিত হবে না। ফলমূল প্রচুর পরিমাণে খাওয়া যাবে। তবে মিষ্টিজাতীয় ফলগুলো খুব বেশি পরিমাণে খাওয়া উচিত হবে না।

৩। খাবারের সময়সূচী বজায় রাখুন

খাবার গ্রহণের ব্যাপারে নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে চলা সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দিনে ৩ বেলা (সকাল, দুপুর ও রাত) খাবার খেতে হবে এবং সেই সাথে বিকেলে স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস গ্রহণ করা যেতে পারে। 

সকালের খাবার ঘুম থেকে উঠার পরবর্তী ২ ঘন্টার মধ্যে খাওয়া উত্তম। দুপুরের খাবার ১ টা থেকে ২ টার মধ্যে এবং রাতের খাবার যত শিঘ্র খাওয়া যায় স্বাস্থ্যের জন্য ততই ভালো। অর্থাৎ সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ৯ টার মধ্যেই রাতের খাবার গ্রহণ সম্পন্ন করতে হবে। 

নিয়ম মেনে খাবার খেলে যখন তখন ক্ষুধা পাবে না এবং অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের প্রবণতা কমে যাবে।  

অন্যদিকে যারা খাবার খাওয়ার ব্যাপারে কোনো সময়সূচি মেনে চলে না তাদের ক্ষেত্রে কতটুকু খাবার গ্রহণ করা হচ্ছে সেই ব্যাপারে হিসাব থাকে না। যার ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। 

৪। নিজের জন্য নিজেই রান্না করুন 

self cooking

রান্না করার অভ্যাস মানসিক চাপ কাটাতে সাহায্য করবে এবং নিজের খাবার নিজেই স্বাস্থ্যকর উপায়ে রান্না করে খেলে শরীরের জন্য উপকার হবে।  

রান্না একটি আর্ট বা শিল্প যার মাধ্যমে খুব ভালো সময় কাটানো সম্ভব। শখের বসে বাসায় স্বাস্থ্যকর রেসিপি তৈরি করার চেষ্টা করুন যার মাধ্যমে মানসিক চাপ ও একাকী বিরক্তিকর সময় কাটানোর মতো সমস্যা দূর হবে।  

মন ভালো করার জন্য রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খাওয়া বা বাসায় বসে অনলাইনে ফাস্টফুড অর্ডার করা অর্থ ও স্বাস্থ্য দুটোর জন্যই ক্ষতিকর। তাই ফাস্টফুডের পরিবর্তে বাসায় স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরির চেষ্টা করুন।  

৫। নিজেকে হাইড্রেটেড রাখুন  

মানসিক চাপ ও অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের প্রবণতা থেকে বাঁচতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। (Kubala, 2020) 

দৈনিক ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হবে। পানির সাথে কিছু ফলমূল বা মিষ্টি আলু খাওয়া যেতে পারে। এতে খুব বেশি ক্যালরি যোগ হবে না তবে স্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন উপকারিতা বয়ে আনবে।      

পানীয় হিসেবে চা ও কফি খাওয়া যাবে। তবে অবশ্যই অতিরিক্ত পরিমাণে নয়। দিনে ৪/৫ কাপ চা অথবা ২/৩ কাপ কফি খাওয়া যেতে পারে। সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর হলো গ্রিন টি পান করা। তবে চা ও কফিতে চিনি মেশানো উচিত নয়। কারণ চিনি প্রচুর ক্যালরি সম্পন্ন একটি খাবার যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। 

৬। শরীরচর্চা অনুশীলন করুন 

মানসিক চাপ কমানো এবং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য শরীরচর্চা (ব্যায়াম) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ব্যায়াম করার কোনো বিকল্প নেই।  

প্রতিদিন নূন্যতম ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। সবচেয়ে সহজ ব্যায়াম হলো হাঁটাহাঁটি করা। এছাড়াও দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, জগিং, বাইসাইকেল চালানো, দড়ি লাফানো ইত্যাদি ব্যায়াম করা যেতে পারে।   

মানসিক চাপ জনিত অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের অভ্যাস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ইয়োগা ও মেডিটেশন সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। শরীর ও মন সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত ইয়োগা ও মেডিটেশন করতে হবে।‌ 

৭। অ্যালকোহল গ্রহণের বিষয়ে সচেতন হন 

avoid alcohol

মানসিক চাপ জনিত হোক কিংবা শখের বশে কখনোই ধুমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ করা যাবে না। কারণ ধুমপান ও মদ্যপান মানসিক চাপ কমানোর ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। বরং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। (Conatser, 2022) 

বিশেষ করে অ্যালকোহল পান করার ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। কারণ অ্যালকোহল উচ্চ ক্যালরি সম্পন্ন একটি পানীয় যার প্রতি ১ গ্রাম অ্যালকোহলে ৭ ক্যালরি রয়েছে।

এছাড়াও কোমল পানীয় পান করার ফলে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। তাই সবধরনের কোমল পানীয় পান করা থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে বিরত রাখতে হবে।

৮। সামগ্রিক স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রাখুন 

স্বাস্থ্য অত্যন্ত মুল্যবান সম্পদ। তাই স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সবসময় সচেতন থাকতে হবে। যা খাচ্ছেন তা স্বাস্থ্যকর কিনা, যতটুকু খাচ্ছেন তাতে অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে কিনা ইত্যাদি বিষয় সবসময় মাথায় রাখতে হবে। 

শরীরের ওজন ও ক্যালরি চাহিদা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। দৈনিক ক্যালরি চাহিদা অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করতে হবে। শরীরের ওজন বেড়ে যাচ্ছে কিনা সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

খাবার গ্রহণের পরিমাণ ও সঠিক সময়সূচী মেনে চলার সুবিধার্থে নোটবুক ব্যবহার করা যেতে পারে। নোটবুকে খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কিত সকল নির্দেশনা সুস্পষ্টভাবে লেখা থাকবে এবং নিয়ম মেনে চলতে হবে।  

শেষ কথা

মানসিক চাপ জনিত অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের অভ্যাস প্রতিরোধের জন্য সঠিক সময়সূচী মেনে চলতে হবে। অস্বাস্থ্যকর খাবার বর্জন করতে হবে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। ভালো লাগার জন্য চা ও কফি (অতিরিক্ত নয়) পান করা যেতে পারে তবে ধুমপান ও মদ্যপান অবশ্যই বর্জনীয়। 

শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় তেমনি অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হবে। 

References

Conatser, L. (2022, March 28). Do Drinking and Smoking Hurt Your Mental Health? Retrieved from Alcoholics Anonymous: https://alcoholicsanonymous.com/polysubstance-abuse/drinking-and-smoking-mental-health/

Kubala, J. (2020, March 03). 13 Ways to Prevent Stress Eating When You’re Stuck at Home. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/ways-to-prevent-stress-eating-when-youre-stuck-at-home

Last Updated on January 1, 2024