প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা ও রূপচর্চার জন্য ক্যাস্টর অয়েল (Castor oil) বেশ জনপ্রিয়তার সাথে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ক্যাস্টর অয়েল স্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন উপকারিতা বয়ে আনতে পারে।
শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহার করা উচিত হবে কিনা সেই সম্পর্কে (বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে) এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর বিভিন্ন টিপস, ক্যাস্টর অয়েলের বিভিন্ন উপকারী ও ক্ষতিকর দিক, ব্যবহারের নিয়ম ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
ক্যাস্টর অয়েল কি?
ক্যাস্টর অয়েল হলো উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত একটি তেল যা আমাদের দেশে রেড়ির তেল অথবা ভেন্নার তেল নামেও পরিচিত।
ক্যাস্টর বা ভেন্না গাছের (বৈজ্ঞানিক নাম Ricinus communis) বীজ থেকে ক্যাস্টর অয়েল উৎপাদন করা হয় যা বিভিন্ন সুপার শপ ও অনলাইন শপে কিনতে পাওয়া যায়।
ওজন নিয়ন্ত্রণ
আগেকার দিনে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য ক্যাস্টর অয়েল সেবনের প্রচলন ছিল। কারণ এতে থাকা Ricinoleic acid অন্ত্রের পেশির কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে সহজে মলত্যাগ হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য ক্যাস্টর অয়েল খাওয়া হলে তা লাক্সাটিভ (Laxative) ওষুধের মতোই কাজ করে।
তবে বর্তমানে কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য ক্যাস্টর অয়েলের ব্যবহার তেমন একটা দেখা যায় না। কারণ ক্যাস্টর অয়েলের তুলনায় লাক্সাটিভ ওষুধ সহজলভ্য এবং কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পন্ন।
ক্যাস্টর অয়েল খাওয়া হলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে পারে এই ধারণা থেকে হয়তো শরীরের ওজন কমাতে ব্যবহার করা যাবে বলে মনে করা হয়ে থাকে।
এযাবৎকালের কোনো গবেষণায় ক্যাস্টর অয়েল শরীরের ওজন কমাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে এমনটা দেখা যায়নি। (Walle, 2021)
শরীরের ওজন কমানোর ক্ষেত্রে ক্যাস্টর অয়েল শরীরের হরমোন পরিবর্তন, ক্ষুধা কমানো বা মেটাবলিসম রেট (বিপাক প্রক্রিয়ার গতি) বাড়ানো বা অন্য কোনোভাবে সাহায্য করতে পারে না।
অন্যান্য সুবিধা
শরীরের ওজন কমাতে ক্যাস্টর অয়েলের কোনো ভূমিকা না থাকলেও স্বাস্থ্যের জন্য অন্যান্য অনেক উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। (Sherrell, 2021)
চুলের যত্নে ক্যাস্টর অয়েল
- ক্যাস্টর অয়েলের প্রদাহ নাশক গুণাবলী চুল পড়া রোধে সাহায্য করে।
- মাথায় ক্যাস্টর অয়েল ম্যাসাজ করার ফলে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায় যা চুল গজাতে সাহায্য করে।
- ক্যাস্টর অয়েলের এন্টিফাংগাল গুণাবলী রয়েছে যা খুশকি দূর করতে সাহায্য করে।
ক্যাস্টর অয়েল খুবই আঠালো ধরনের। তাই ক্যাস্টর অয়েলের সাথে নারিকেলের তেল বা অলিভ অয়েল মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য সপ্তাহে একবার ব্যবহার করাই যথেষ্ট হবে।
প্রদাহ নাশক হিসেবে কাজ করে
ক্যাস্টর অয়েলের প্রদাহ নাশক গুণাবলী রয়েছে যা বিভিন্ন ধরনের ব্যথা ও প্রদাহ নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যাবে।
আর্থ্রাইটিসের (Arthritis) রোগীদের হাঁটু বা শরীরের অন্য কোনো জয়েন্টে ব্যথা হলে ক্যাস্টর অয়েল মালিশ করার ফলে ব্যথা ও প্রদাহ অনেকটাই কমে যায়।
ক্ষত সারাতে সাহায্য করে
ক্যাস্টর অয়েলের এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণাবলী ক্ষত শুকাতে এবং ব্রণ হওয়ার প্রবণতা হ্রাস করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে গভীর ক্ষতস্থানে ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহারের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে উপকারী
আগেকার দিনে প্রসবকালীন সময়ে নরমাল ডেলিভারির জন্য গর্ভবতী মাকে ক্যাস্টর অয়েল খাওয়ানো হতো। ক্যাস্টর অয়েল জরায়ুর পেশির সংকোচন ঘটানোর মাধ্যমে নরমাল ডেলিভারিতে সাহায্য করে।
তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির এই যুগে নরমাল ডেলিভারির জন্য ক্যাস্টর অয়েল ব্যবহার করা যৌক্তিক মনে হয় না।
ক্ষতিকর দিক
ক্যাস্টর অয়েলের যেমন উপকারিতা রয়েছে তেমনিভাবে কিছু ক্ষতিকর দিক বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমনঃ
- গর্ভকালীন সময়ে ক্যাস্টর অয়েল খাওয়ার ফলে গর্ভপাত হতে পারে। তাই গর্ভবতী মায়েদের জন্য ক্যাস্টর অয়েল খাওয়া যাবে না। তবে চুলের যত্নে মাথায় ব্যবহার করা হলে কোনো সমস্যা হবে না।
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য ক্যাস্টর অয়েল খাওয়া হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে পেট ব্যথা, বমি, পেট ফাঁপা, মাথা ঘোরানো ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য ক্যাস্টর অয়েল না খেয়ে বরং লাক্সাটিভ ওষুধ সেবন করা উত্তম হবে।
- অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যাস্টর অয়েল সেবন করার ফলে ইলেকট্রোলাইট (Electrolytes) এর ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং শরীরে পানিস্বল্পতার সৃষ্টি হতে পারে।
- সাধারণত ক্যাস্টর অয়েল সেবন করার ফলে এলার্জিক রিয়াকশন দেখা যায় না। তবে কারো কারো এলার্জি দেখা যেতে পারে। যেমনঃ ত্বকে র্যাশ হওয়া, চুলকানি, মুখ ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।
ক্ষতিকর দিক এড়িয়ে ক্যাস্টর অয়েলের উপকারিতা পাওয়ার জন্য পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে হবে। আর ত্বকে ব্যবহার করার জন্য একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা উত্তম হবে।
ওজন কমানোর টিপস
শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য দৈনিক ক্যালরি চাহিদার তুলনায় কিছুটা কম খাবার খেতে হবে। সেই সাথে নিয়মিত (প্রতিদিন নূন্যতম ৩০ মিনিট) ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ওজন কমানোর জন্য যেসব টিপস মেনে চলতে হবে তা হলোঃ
- খাদ্য তালিকা থেকে সরল শর্করা জাতীয় খাবার (সাদা ভাত ও ময়দার তৈরি খাবার) কমাতে হবে।
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার (ওটস, বাদামী চালের ভাত, আটার রুটি, ফলমূল ও শাকসবজি) খেতে হবে।
- ভালো মানের প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে। যেমনঃ মাছ, ডিম, ডাল, মুরগির মাংস ইত্যাদি।
- ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার যতটা সম্ভব পরিহার করতে হবে। যেমনঃ দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, মুরগির চামড়া, চর্বিযুক্ত মাংস, পোড়া তেলে ভাজা খাবার ইত্যাদি। (লো-ফ্যাট ও ফ্যাট ফ্রি দুধ খাওয়া যাবে)
- স্বাস্থকর চর্বি পরিমিত পরিমাণে খাওয়া যাবে। যেমনঃ অ্যাভোকাডো, মাছ, বাদাম তেল, সূর্যমুখী তেল, অলিভ অয়েল, সয়াবিন তেল ইত্যাদি।
- ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, সস, আচার, পটেটো চিপস ও অ্যালকোহল বর্জন করা জরুরী।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম (Yoga) করতে হবে।
- রাতে ভালো ঘুম (৭ থেকে ৯ ঘন্টা) নিশ্চিত করতে হবে।
- গ্রিন টি (চিনি ছাড়া) পান করা উপকারী হবে।
শরীরের অতিরিক্ত ওজন কোনো রোগ বা হরমোনের পরিবর্তনের ফলে হয়ে থাকলে একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ নির্ণয় পূর্বক যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি টিপস মেনে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
References
Sherrell, Z. (2021, September 28). Castor Oil for Weight Loss: Fact or Fiction? Retrieved from Greatist: https://greatist.com/health/castor-oil-for-weight-loss
Walle, G. V. (2021, May 10). Should You Use Castor Oil to Lose Weight? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/castor-oil-for-weight-loss
Last Updated on December 21, 2023
Leave A Comment