বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রায় ১৯০ মিলিয়ন নারী এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis) রোগে আক্রান্ত। অর্থাৎ এটি মহিলাদের কমন একটি রোগ যার ফলে খুব যন্ত্রণাদায়ক পিরিয়ড (Menstruation) এবং জটিলতা হিসেবে ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব সমস্যা হয়ে থাকে।
এন্ডোমেট্রিওসিস কেন হয়, কাদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, এই রোগের কতগুলো পর্যায় রয়েছে, কিভাবে রোগ নির্ণয় করা হয়, চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন, কি কি জটিলতা হতে পারে ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার জন্য শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
এন্ডোমেট্রিওসিস কি? (Endometriosis meaning in Bengali)
জরায়ুর প্রাচীর তিন স্তর বিশিষ্ট যার ভেতরের স্তরের নাম হলো এন্ডোমেট্রিয়াম। পিরিয়ডের সময় এই স্তর ভেঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়। কোনো কারণবশত জরায়ু ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে এন্ডোমেট্রিয়ামের মতো টিস্যু গঠন হলে তাকে এন্ডোমেট্রিওসিস বলা হয়। সাধারণত জরায়ুর বাইরের দিক, ফ্যালোপিয়ান টিউব, ওভারি, পেরিটোনিয়াম বা পেটের আবরণী পর্দা ইত্যাদিতে এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু গঠন হয়ে থাকে।
এন্ডোমেট্রিওসিসের লক্ষণ
পিরিয়ডের সময় নারীর শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের ফলে এন্ডোমেট্রিয়াম স্তর ভেঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। এন্ডোমেট্রিওসিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে পিরিয়ডের সময় হরমোনের পরিবর্তনের সাথে সাথে জরায়ুর বাইরে থাকা এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যুতে প্রদাহ হয়। তাই এন্ডোমেট্রিওসিসের লক্ষণগুলো পিরিয়ডের সময়ে বেড়ে যেতে দেখা যায়।
এন্ডোমেট্রিওসিসের লক্ষণগুলো হলোঃ
- পিরিয়ডের সময় প্রচুর পেট ব্যথা
- ব্যথা কোমরের দিকে প্রবাহিত হয়
- পিরিয়ডের সময় অনেক রক্তক্ষরণ
- সহবাসের সময় ব্যথা হওয়া
- প্রস্রাব ও মলত্যাগের সময় পেটে ব্যথা অনুভব হওয়া
- প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হওয়া
- বমি বমি ভাব
- ক্লান্তি বোধ
- বিষন্নতা
রোগের প্রারম্ভিক অবস্থায় লক্ষণের তীব্রতা কম থাকে তবে সময়ের সাথে সাথে বেড়ে যায়। শুধু লক্ষণ দেখে এন্ডোমেট্রিওসিস হয়েছে কিনা তা অনেকেই বুঝতে সক্ষম হয় না। কারণ অনেকের ক্ষেত্রেই পিরিয়ডের সময় প্রচুর পেট ব্যথা হয় এবং সেই সাথে কোমর ব্যথা, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, ক্লান্তি, বোধ, বমি বমি ভাব, বিষন্নতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
পিরিয়ডের সময় পেট ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক তবে তীব্র মাত্রায় ব্যথা হলে বা দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা চলতে থাকলে একজন গাইনী ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
এন্ডোমেট্রিওসিস ছাড়াও পেটে ব্যথার আরও অনেক কারণ রয়েছে। পেটে ব্যথার বিভিন্ন কারণ জানা থাকলে আপনি অনেক উপকৃত হবেন।
এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণ কী?
এন্ডোমেট্রিওসিসের প্রকৃত কারণ অজানা। তবে কতিপয় বিষয়কে এই রোগের কারণ হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে যা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো। (Mayo Clinic, 2018)
Retrograde menstruation
পিরিয়ডের সময় রক্ত (এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু সহ) বাইরে বের হওয়ার পরিবর্তে উল্টো দিকে ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পেলভিক এরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিওসিস হয়ে থাকে।
Transformation of peritoneal cells
হরমোনের প্রভাবে অথবা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিকতার দরুণ পেরিটোনিয়াম টিস্যু এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যুর মতো পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার ফলে এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে।
Embryonic cell transformation
হরমোনের প্রভাবে এমব্রায়োনিক টিস্যুর (Embryonic cell) গঠন এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যুর মতো হয়ে যাওয়ার ফলে এই রোগ হতে পারে।
সার্জারি জনিত
সিজারিয়ান ডেলিভারি বা জরায়ুর কোনো সার্জারি করার সময় এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু ছড়িয়ে পড়ার ফলে এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে।
অন্যান্য
রক্তনালী বা লসিকাতন্ত্রের (Lymphatic system) মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এমতাবস্থায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি এই টিস্যু চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে সক্ষম না হয় তবে এন্ডোমেট্রিওসিস হয়ে থাকে।
ঝুঁকির কারণ
সাধারণত ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সের নারীদের ক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিওসিস হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এছাড়াও অন্যান্য ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- যাদের ক্ষেত্রে কম বয়সে প্রথম পিরিয়ড (Menarche) শুরু হয়েছে
- বিএমআই (BMI- Body mass index) অনুযায়ী যাদের শরীরের ওজন বেশ কম
- যাদের মেনোপজ (পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়া) অনেক দেরিতে হয়
- যারা কখনো গর্ভধারণ করেন নাই
- যাদের ক্ষেত্রে ২৭ দিনের কম সময়ের চক্রে পিরিয়ড হয়
- যাদের প্রতিবার পিরিয়ডের সময় অনেক বেশি পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয় অথবা ৭ দিনের বেশি সময় পিরিয়ড থাকে
- যাদের মা অথবা বোনদের ক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিওসিস রোগ রয়েছে।
ঝুঁকির কারণ থাকলে তাদের ক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিওসিস হবেই এমন কোনো কথা নেই। আবার কারো ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকির কারণ না থাকা সত্ত্বেও এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে। অর্থাৎ ঝুঁকির কারণ থাকা মানে হলো এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি রয়েছে।
এন্ডোমেট্রিওসিসের পর্যায়
লক্ষণ ভেদে এন্ডোমেট্রিওসিস মৃদু থেকে তীব্র প্রকৃতির মোট চারটি পর্যায়ের হয়ে থাকে। (Begum, 2023)
- মৃদু প্রকৃতির (প্রথম পর্যায়) ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যুর পরিমাণ বা টিস্যুর স্তরের গভীরতা খুব সামান্য হয়ে থাকে।
- প্রথম পর্যায়ের তুলনায় দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যুর পরিমাণ বা স্তরের গভীরতা বেশি হয়ে থাকে। সেই সাথে লক্ষণের তীব্রতা বেশি অনুভব হয়।
- এভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের ধারাবাহিকতায় অস্বাভাবিক টিস্যুর পরিমাণ বা স্তরের গভীরতা বাড়তে থাকে। চতুর্থ পর্যায়ে সবচেয়ে তীব্র প্রকৃতির লক্ষণ দেখা যায়।
কীভাবে এন্ডোমেট্রিওসিস রোগ নির্ণয় করা হয়?
এন্ডোমেট্রিওসিস নির্ণয়ের জন্য সর্বপ্রথম চিকিৎসক রোগীর শারীরিক পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর কতিপয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যথাঃ
- আল্ট্রাসনোগ্রাফি
- এমআরআই (MRI)
- ল্যাপরোস্কপি (Laparoscopy)
এছাড়াও ক্ষেত্রে বিশেষ বায়োপসি করার প্রয়োজন হয়ে থাকে। ল্যাপরোস্কপি করার সময় এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয় এবং টিস্যুর ধরন পরীক্ষা করে রোগ নিশ্চিত করা হয়।
এন্ডোমেট্রিওসিসের চিকিৎসা
এন্ডোমেট্রিওসিস একদম সারিয়ে ফেলতে পারে এমন কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে ব্যথা নিরাময়, অস্বাভাবিক এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু দূর করা ও গর্ভধারণের চেষ্টা করা হয়। (National Health Service, UK, 2022)
ব্যথা নাশক ওষুধ
ব্যথা নিরাময়ের জন্য ব্যথা নাশক ওষুধ সেবন করতে হবে। যেমনঃ প্যারাসিটামল (Paracetamol) অথবা আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) যা লক্ষণের তীব্রতা অনুযায়ী যেকোনো একটি বা দুইটি ওষুধ একসাথে সেবন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে।
ব্যথা কমাতে গরম সেঁক দেওয়া, গরম পানিতে গোসল, তলপেটে ম্যাসাজ ও ব্যায়াম করা উপকারী হবে।
হরমোন জাতীয় ওষুধ
ব্যথা নাশক ওষুধের মাধ্যমে ব্যথা নিরাময় না হলে সেক্ষেত্রে হরমোন জাতীয় ওষুধ সেবনের প্রয়োজন পড়ে। এছাড়াও এন্ডোমেট্রিওসিসের অন্যান্য লক্ষণগুলো দূর করতে এবং পরবর্তীতে এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু জমা হওয়ার প্রবণতা হ্রাস করতে হরমোন জাতীয় ওষুধ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
হরমোন জাতীয় ওষুধের বিভিন্ন ধরন রয়েছে যা গাইনী ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী সেবন করতে হবে।
সার্জারি
অস্বাভাবিক এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করা হয়ে থাকে এবং এর ফলে গর্ভধারণ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সার্জারির আধুনিক পদ্ধতি হলো ল্যাপরোস্কপি যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম।
এই সবের পাশাপাশি, কিছু ঘরোয়া উপায় এন্ডোমেট্রিওসিসের লক্ষণ উপশমনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এন্ডোমেট্রিওসিস জটিলতা
এন্ডোমেট্রিওসিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে প্রধান জটিলতা হলো ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব। অর্থাৎ এন্ডোমেট্রিওসিসের ফলে একজন নারী সন্তান জন্মদানে সক্ষম হয় না। সাধারণত ফ্যালোপিয়ান টিউবে এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু জমে থাকার কারণে ওভারি থেকে নিঃসরণ হওয়া ডিম্বাণু শুক্রাণুর সাথে মিলিত হতে পারে না তথা গর্ভধারণ হয় না।
এন্ডোমেট্রিওসিস আক্রান্ত নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণ একদম হবেই না তা নয়। তবে বেশিরভাগ এন্ডোমেট্রিওসিস রোগীর ক্ষেত্রেই বন্ধ্যাত্ব সমস্যা দেখা যায়।
যারা দীর্ঘদিন ধরে এন্ডোমেট্রিওসিস রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে ওভারিতে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি থাকে। এছাড়াও অস্বাভাবিক এন্ডোমেট্রিয়াম টিস্যু হরমোনের প্রভাবে পিরিয়ডের সময় ভেঙ্গে রক্তক্ষরণ হলে তা শরীরের বাইরে বের হতে পারে না। এমতাবস্থায় রক্ত জমা হয়ে সিস্ট হয়ে থাকে। সাধারণত ওভারিতে এমন হতে দেখা যায় যাকে চকলেট সিস্টও (Chocolate cysts) বলা হয়।
References
Begum, J. (2023, March 15). Endometriosis. Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/women/endometriosis/endometriosis-causes-symptoms-treatment
Mayo Clinic. (2018, July 24). Endometriosis. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/endometriosis/symptoms-causes/syc-20354656
National Health Service, UK. (2022, September 05). Endometriosis Treatment. Retrieved from NHS: https://www.nhs.uk/conditions/endometriosis/treatment/
Last Updated on November 21, 2023
Leave A Comment