কোলেস্টেরল হলো ফ্যাট (লিপিড) জাতীয় উপাদান যা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করে। যেমনঃ কোষের আবরণ তৈরি এবং ভিটামিন ডি ও হরমোন উৎপাদন। তবে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গেলে হার্টের রোগের (হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক) ঝুঁকি বেড়ে যায়।
কোলেস্টেরল বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে যেন তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। এই অনুচ্ছেদে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধির কারণ সমূহ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া প্রতিরোধে করণীয় বিষয়াবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
কোলেস্টেরলের মাত্রা
রক্তে কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা হলো টোটাল কোলেস্টেরল প্রতি ডেসিলিটারে ২০০ মিলিগ্রামের কম, এলডিএল ১৩০ মিলিগ্রামের কম এবং ট্রাইগ্লিসারাইড ১৫০ মিলিগ্রামের কম। এগুলো হলো ক্ষতিকর কোলেস্টেরল। এইচডিএল হলো উপকারী কোলেস্টেরল যা প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ৪০ মিলিগ্রামের বেশি থাকতে হবে।
লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করার মাধ্যমে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা সম্পর্কে জানা যায়। এই টেস্ট করার জন্য স্যাম্পল হিসেবে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। টেস্ট করার পূর্ববর্তী ১০ থেকে ১২ ঘন্টা উপবাস করতে হবে।
কোলেস্টেরল বৃদ্ধির কারণ
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার (সেই সাথে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যাওয়া) প্রধান কারণ হলো ৩টি যা নিচে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো। (Nunez, 2022)
১. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
- দৈনিক ক্যালরি চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণ খাবার গ্রহণ করা।
- স্যাচুরেটেড ও ট্র্যান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। যেমনঃ ফাস্টফুড, পোড়া তেলে ভাজা খাবার, চিপস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, গরু ও খাসির মাংস, মুরগির চামড়া, চিংড়ি ইত্যাদি।
- সরল শর্করা জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া। যেমনঃ সাদা ভাত, ময়দার তৈরি রুটি, বিস্কুট, পাউরুটি, নুডুলস, পাস্তা ইত্যাদি।
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার (লাল আটা, লাল চালের ভাত, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি) কম খাওয়া।
- স্বাস্থ্যকর প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাবারের প্রতি অনীহা। যেমনঃ মাছ, মুরগির মাংস, ডাল, বাদাম, তিসি, অলিভ অয়েল, শিমের বিচি, মটরশুটি ইত্যাদি।
২. অলস জীবন যাপন
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের জীবন সহজ হয়েছে। তবে এতে স্বাস্থ্যগত সমস্যা বেড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ কম পরিশ্রম করার ফলে মানুষের শরীরে সহজেই অসুস্থতা বা রোগ বাসা বাঁধতে পারে। একজন কর্মক্ষম (শারীরিক পরিশ্রম) মানুষের তুলনায় অলস জীবনযাপনকারীদের ক্ষেত্রে অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
বিশেষ করে মেটাবলিক ডিজিজ যার মধ্যে অন্যতম হলো হার্টের রোগ। শারীরিক পরিশ্রম করেন না (বসে কাজ করেন এবং ব্যায়াম করেন না) এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়। যার ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মতো প্রাণঘাতী রোগ হয়ে থাকে।
৩. শরীরের অতিরিক্ত ওজন
শরীরের অতিরিক্ত ওজনের সাথে কোলেস্টেরলের যোগসূত্র রয়েছে। অর্থাৎ যাদের শরীরের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি এবং ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকে।
আপনার শরীরের ওজন বেশি কিনা তা বোঝার উপায় হলো বিএমআই স্কেল। এর মান নির্ণয়ের সূত্র হলো ওজন÷উচ্চতা^২ অর্থাৎ শরীরের ওজনকে (কেজি) উচ্চতার বর্গ (মিটার একক) দিয়ে ভাগ করতে হবে।
বিএমআই স্কেলের মান ১৮.৫ এর বেশি এবং ২৫ এর কম হলে আপনার ওজন ঠিক আছে। তবে এই মান ২৫ এর বেশি হলে বাড়তি ওজন এবং ৩০ এর বেশি অতিরিক্ত ওজন বা স্থুলতা (Obesity) হিসেবে ধরা হয়।
হঠাৎ কোলেস্টেরল বৃদ্ধির কারণ
গর্ভাবস্থা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সহ কতিপয় বিষয় হঠাৎ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সাথে সম্পর্কিত যা নিচে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। (Davenport, 2023)
১. গর্ভাবস্থা
গর্ভকালীন সময়ে মহিলাদের শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে। যার ফলে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। এটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় Gestational hypercholesterolemia বলা হয় যা গর্ভবতী মা ও গর্ভস্থ সন্তানের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
২. মেনোপজ
৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সে মহিলাদের পিরিয়ড (Menstruation) বন্ধ হয়ে যায় যাকে মেনোপজ বলা হয়। মেনোপজের সময় শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
৩. অতিরিক্ত মানসিক চাপ
মানসিক চাপের ফলে কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ বেড়ে যায় যার ফলে রক্তে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায় এবং ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়।
৪. কফি পান
কফি খুব জনপ্রিয় একটি পানীয় যা ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত পরিমাণ কফি পানের অভ্যাস রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
৫. ধুমপান
ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধুমপান তথা তামাকজাত দ্রব্যে নিকোটিন নামক উপাদান থাকে যা রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
৬. মদ্যপান
মদ্যপানের অভ্যাস লিভারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এছাড়াও মদ্যপান রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
৭. দ্রুত শরীরের ওজন কমানো
দ্রুত শরীরের ওজন অনেক বেশি কমিয়ে ফেলার প্রভাবে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
৮. রোগের প্রভাব
কতিপয় রোগের প্রভাবে রক্তে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। অর্থাৎ ভালো কোলেস্টেরল কমে যায় এবং ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। যেমনঃ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির সমস্যা, লিভারের রোগ, থাইরয়েডের সমস্যা ইত্যাদি।
৯. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কিছু কিছু ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যেতে দেখা যায়। যেমনঃ উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ, খিঁচুনি নিরাময়ের ওষুধ, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, ইস্ট্রোজেন পিল ইত্যাদি।
প্রতিরোধের উপায়
রক্তে উপকারী কোলেস্টেরল ভালো রাখা এবং ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হার্টের রোগ প্রতিরোধ করা যায়। নিচে উল্লেখিত নিয়মগুলো মেনে চলার মাধ্যমে রক্তে কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখা সম্ভব হবে।
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে।
- ক্যালরি চাহিদা অনুযায়ী খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্যালরি গ্রহণ করা যাবে না।
- খাদ্যতালিকায় প্রচুর ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে।
- স্বাস্থ্যকর প্রোটিন ও ফ্যাট খেতে হবে। তবে অবশ্যই অতিরিক্ত পরিমাণে নয়।
- অতিরিক্ত কফি (দিনে সর্বোচ্চ ৫ কাপ) খাওয়া যাবে না।
- ধুমপান ও মদ্যপান করা যাবে না।
- মেনোপজ ও গর্ভকালীন সময়ে গাইনী ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
- কোনো ওষুধ সেবনের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
- সপ্তাহে ০.৫ কেজি থেকে ১ কেজি ওজন কমানো হলো আদর্শ ও নিরাপদ পদ্ধতি।
- নিয়মিত (প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট) ব্যায়াম করতে হবে।
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের টিপস জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
Bibliography
Davenport, S. (2023, March 06). The causes of a sudden cholesterol increase. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/the-causes-of-a-sudden-cholesterol-increase
Nunez, K. (2022, August 10). 6 Factors That May Cause a Sudden Increase in Cholesterol. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/high-cholesterol/what-can-cause-a-sudden-increase-in-cholesterol
Last Updated on January 4, 2024
Leave A Comment