নার্ভে ব্যথা (Neuropathic pain) কি? স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অথবা কার্যক্রমে অস্বাভাবিকতার ফলে যে সকল লক্ষণ দেখা যায় তাকে মেডিকেলের ভাষায় নিউরোপ্যাথিক পেইন বলা হয়। মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের দুইটি অংশ রয়েছে। যথাঃ 

  • কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র যা মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ড নিয়ে গঠিত।  ‌
  • মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ড ব্যতীত সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নার্ভ নিয়ে গঠিত হলো প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র যা শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে সিগন্যাল আদান-প্রদান করে। 

স্নায়ুতে ব্যথা বা নিউরোপ্যাথিক পেইন কেন হয়, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। 

নার্ভে ব্যথার (Neuropathic pain) লক্ষণগুলি কী কী? 

নার্ভে ব্যথার প্রকৃতি হলো সুচ ফুটানো ব্যথা, ঝিনঝিন অনুভব, হাত ও পায়ের অবশ ভাব, ত্বকের সংবেদনশীলতা কমে যাওয়া, পেশির দুর্বলতা ইত্যাদি। ব্যথা বা লক্ষণ সাধারণত বাহ্যিক প্রভাব ও আবহাওয়ার প্রভাবে কম বেশি হয়ে থাকে। নার্ভে ব্যথার ক্ষেত্রে আরো যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ 

  • শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা এবং ব্যথার সাথে জ্বালাপোড়া হওয়া 
  • ত্বকের উপর দিয়ে পিঁপড়া বা মাকড়সা হেঁটে যাওয়ার মতো অনুভূতি হয় 
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ
  • হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া 

দীর্ঘদিন ধরে নিউরোপ্যাথিক ব্যথার ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়া সহ ঘুমের সমস্যা, বিষন্নতা (Depression), উদ্বিগ্নতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা যেতে পারে। 

ঘুমের সমস্যা দূর করার টিপস সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।  

নার্ভে ব্যথার (Neuropathic pain) কারণ কি? 

diabetes 1

নানাবিধ কারণে নিউরোপ্যাথিক পেইন বা নার্ভে ব্যথা হতে পারে। যেমনঃ 

  • ডায়াবেটিস 
  • স্ট্রোক (Stroke) 
  • আঘাত বা সার্জারি 
  • ক্যান্সার ও কেমোথেরাপি
  • পারকিনসন ডিজিজ 
  • Multiple Sclerosis 
  • Varicella-zoster virus 
  • Hansen’s disease (Leprosy) 
  • মদ্যপানের ক্ষতিকর প্রভাব  
  • গুলেন‌ ব্যারি সিনড্রোম 
  • কারপাল টানেল সিনড্রোম 
  • শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি 
  • থাইরয়েডের সমস্যা

গুলেন‌ ব্যারি সিনড্রোম কি, কেন হয়, কাদের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকি রয়েছে, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

নিউরোপ্যাথিক পেইনের ধরন 

আক্রান্ত স্নায়ুর প্রকৃতি ও কারণের উপর ভিত্তি করে নিউরোপ্যাথিক পেইন বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ (Sissons, 2023) 

পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি (Peripheral Neuropathy) 

পেরিফেরাল শব্দটির মানে হলো প্রান্তীয় অর্থাৎ শুধুমাত্র প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হলে তাকে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বলা হয়। সাধারণত হাত ও পায়ের স্নায়ুতে এই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। হাত ও পায়ের অবশ ভাব, ঝিনঝিন করা, জ্বালাপোড়া, ব্যথা, দুর্বলতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। 

ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি (Diabetic Neuropathy) 

ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে অতিরিক্ত পরিমাণে গ্লুকোজের উপস্থিতি নার্ভ কোষে অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ব্যঘাত ঘটায়। যার ফলে নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তথা নার্ভের কার্যক্ষমতা কমে যায় যাকে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি বলা হয়। নিউরোপ্যাথিক পেইন বা স্নায়ুতে ব্যাথার সবচেয়ে কমন ধরন হলো ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি যা সাধারণত প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রে হয়ে থাকে।  

অটোনমিক নিউরোপ্যাথি (Autonomic Neuropathy) 

দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের সাথে সম্পর্কিত নার্ভের সমস্যাকে অটোনমিক নিউরোপ্যাথি বলা হয়। এই ধরনের নিউরোপ্যাথির ফলে শ্বাস কার্যক্রম, হজম, হার্টের কার্যক্রম, প্রস্রাব নিঃসরণ ইত্যাদিতে ব্যঘাত ঘটে। তবে এটি বিরল‌ প্রকৃতির সমস্যা অর্থাৎ সচরাচর ঘটতে দেখা যায় না। 

ফোকাল নিউরোপ্যাথি (Focal Neuropathy) 

শরীরের কোনো অঙ্গের একটিমাত্র নার্ভ আক্রান্ত হলে তাকে ফোকাল নিউরোপ্যাথি বলা হয়। হাত, পা, মুখমন্ডল ও মাথা সহ শরীরের যেকোনো অঙ্গে সমস্যা হতে পারে। তবে সবচেয়ে কমন হলো মুখমণ্ডলের স্নায়ু আক্রান্ত হওয়া যা বেলস পালসি (Bell’s palsy) নামে পরিচিত। বেলস পালসির ক্ষেত্রে মুখের একপাশ বেঁকে যাওয়া লক্ষণ (প্যারালাইসিস) দেখা যায়। 

প্রক্সিমাল নিউরোপ্যাথি (Proximal Neuropathy) 

দেহের যেকোনো একপাশের কিছু সংখ্যক নার্ভ আক্রান্ত হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় প্রক্সিমাল নিউরোপ্যাথি বলা হয়। এটি খুব বিরল প্রকৃতির একটি সমস্যা যা কোমরের যেকোনো একপাশে অথবা এক পায়ে হতে দেখা যায়। তীব্র প্রকৃতির ব্যথা হয় এবং চলাফেরা করতে অসুবিধা হয়।     

কমপ্রেশন মোনোনিউরোপ্যাথি (Compression Mononeuropathy) =

শরীরের কোনো অংশে অস্বাভাবিক চাপের ফলে একটি নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে কমপ্রেশন মোনোনিউরোপ্যাথি বলা হয়। সাধারণত কারপাল টানেল সিনড্রোমের ফলে এই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। অর্থাৎ হাতের কব্জিতে থাকা ছোট ছোট হাড়ের (Carpal bones) অস্বাভাবিক চাপের প্রভাবে সেখানে থাকা নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তথা নিউরোপ্যাথিক পেইন হয়ে থাকে। 

কারপাল টানেল সিনড্রোম সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।  

ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া (Trigeminal Neuralgia) 

মস্তিষ্ক থেকে মুখমণ্ডলে প্রবাহিত ৫ম নার্ভের (এক জোড়া নার্ভ) নাম হলো ট্রাইজেমিনাল নার্ভ যেখানে নিউরোপ্যাথিক পেইন হলে ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া বলা হয়। এটি একটি বিরল প্রকৃতির সমস্যা যা স্ট্রোক, Multiple Sclerosis ও মুখমণ্ডলের সার্জারির প্রভাবে হয়ে থাকে। এই ধরনের নিউরোপ্যাথিক পেইনের লক্ষণ হলো মুখ ধোয়া, ব্রাশ করা ও খাবার খাওয়ার সময় মুখমণ্ডলে তীব্র ব্যথা অনুভব হওয়া। 

স্ট্রোক কেন হয় এবং স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।   

রোগ নির্ণয়  

নিউরোপ্যাথিক পেইন সাধারণত শারীরিক পর্যবেক্ষণ (Physical examination) দ্বারা নির্ণয় করা হয়। এছাড়াও ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানার জন্য RBS (Random blood sugar) টেস্ট করতে হবে। সেই সাথে রোগ নির্ণয়ে সহায়তা হিসেবে চিকিৎসক আরো যেসব পরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন তা হলোঃ 

  • X-ray 
  • Ultrasonography
  • CT scan or MRI 
  • EMG (Electromyography) 

নিউরোপ্যাথিক‌ পেইনের জন্য একজন নিউরোলজিস্ট চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

চিকিৎসা 

Medication For Neuropathic Pain

নিউরোপ্যাথিক‌ পেইনের কারণ নির্ণয় করে সেই মোতাবেক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। ডায়াবেটিস জনিত নিউরোপ্যাথিক পেইনের জন্য ঔষধ সেবন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। 

ব্যথা নিরাময়ের জন্য ব্যথা নাশক NSAIDs (non-steroidal anti-inflammatory drugs) ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত একটি ওষুধের নাম হলো আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) যা নিম্নলিখিত নামে বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। (Holland, 2023) 

  • Advel®
  • Deflam®
  • Erofen®
  • Flamex®
  • Profen®
  • Reumafen®
  • Siflam®

আইবুপ্রোফেন সম্পর্কে বিস্তারিত আরো জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন। 

ওটিসি মেডিসিনের (OTC- over the counter) অন্তর্ভুক্ত এই ওষুধটি ৪০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় দিনে ৩ থেকে ৪ বার চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই সেবন করা যেতে পারে। তবে এতে কাজ না হলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী Opioids, Steroids, Anticonvulsants অথবা Antidepressant গ্রুপের ওষুধ সেবন করতে হবে।  

Anticonvulsants খিঁচুনি নিরাময়ের ওষুধ এবং Antidepressant হলো বিষন্নতা দূর করার ওষুধ।‌‌ তবে এই‌ ওষুধগুলো স্নায়ুর ব্যথা তথা নিউরোপ্যাথিক‌ পেইন নিরাময়ের ক্ষেত্রেও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।

নিউরোপ্যাথিক পেইন নিরাময়ের জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা (বিশেষ করে ইয়োগা) ও ফিজিওথেরাপি বেশ উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। ফিজিওথেরাপির জন্য একজন ফিজিওথেরাপিস্টের‌ শরণাপন্ন হতে হবে। 

Bibliography

Holland, K. (2023, May 04). What You Should Know About Neuropathic Pain. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/neuropathic-pain

Sissons, B. (2023, February 15). Types and causes of neuropathic pain. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/neuropathic-pain

Last Updated on October 31, 2023