ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে গেলে তাকে স্লিপ অ্যাপনিয়া (Sleep apnea) বলা হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চলার পথে প্রতিবন্ধকতা অথবা মস্তিষ্ক থেকে সিগন্যাল প্রেরণ ব্যাহত হলে স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়ে থাকে।
শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রমে ব্যঘাত ঘটার ফলে রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। এমতাবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চালু করার জন্য ঘুম ভেঙ্গে যায়। স্লিপ অ্যাপনিয়ার ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। স্লিপ অ্যাপনিয়ার ক্ষেত্রে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলো ঘুমের সময় নাক ডাকা (Snoring), ক্লান্তি বোধ, দিনের বেলায় ঘুম পাওয়া, কাজে মনোযোগ দিতে না পারা, অস্থিরতা, মাথাব্যথা ইত্যাদি।
স্লিপ অ্যাপনিয়া নিরাময়ের জন্য মুখে ওষুধ সেবন, সিপ্যাপ যন্ত্র (CPAP– Continuous positive airway pressure) অথবা ওরাল ডিভাইস ব্যবহার করা সহ সার্জারি অপশন রয়েছে। তবে এগুলো সহজ কোনো পদ্ধতি নয় বরং ব্যায়বহুল হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ঘরোয়া প্রতিকার সহজলভ্য এবং কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে না।
আজকের অনুচ্ছেদে স্লিপ অ্যাপনিয়ার ৬ টি ঘরোয়া প্রতিকার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
স্লিপ অ্যাপনিয়ার ঘরোয়া প্রতিকার
স্লিপ অ্যাপনিয়ার ঘরোয়া উপায়গুলো মৃদু থেকে মাঝারি প্রকৃতির সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। সেই সাথে স্লিপ অ্যাপনিয়া প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তবে তীব্র প্রকৃতির সমস্যার ক্ষেত্রে অথবা দীর্ঘমেয়াদী স্লিপ অ্যাপনিয়ার জন্য একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। (Anthony, 2023)
১। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ
শরীরের অতিরিক্ত ওজন স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। অর্থাৎ যাদের ওজন বেশি তাদের ক্ষেত্রে শরীরে অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি থাকে যা শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ স্লিপ অ্যাপনিয়া নিরাময়ে এতটাই সাহায্য করে যে রোগীকে সিপ্যাপ ব্যবহার অথবা সার্জারি করানোর প্রয়োজন পড়ে না। আর তাই ডাক্তাররা স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগীকে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
এছাড়াও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়। ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার (ওটস, বাদামী চালের ভাত, গমের আটার তৈরি রুটি, শস্যদানা, ফলমূল ও শাকসবজি) গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
২। যোগব্যায়াম (Yoga)
যেকোনো ধরনের ব্যায়াম শরীরের শক্তি বৃদ্ধি, হার্টের কার্যক্ষমতা বাড়ানো সহ স্লিপ অ্যাপনিয়া নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বিশেষ করে যোগব্যায়াম করার মাধ্যমে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বেড়ে যায় এবং রক্তে অক্সিজেনের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখে যা স্লিপ অ্যাপনিয়া দূর করে থাকে। এছাড়াও যারা নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন তাদের ক্ষেত্রে রাতে ভালো ঘুম হয়।
সঠিকভাবে যোগব্যায়াম করার জন্য প্রথমে প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে যা বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অল্প সময়ে এবং স্বল্প খরচে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বাড়িতে নিজে নিজে যোগব্যায়াম প্র্যাকটিস করার মাধ্যমে স্লিপ অ্যাপনিয়া দূর করা সহ শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন উপকারিতা পাওয়া যাবে।
৩। কাত হয়ে শোয়া
গবেষণায় দেখা গেছে যে, চিৎ হয়ে শোয়ার ফলে স্লিপ অ্যাপনিয়ার লক্ষণ বিশেষ করে নাক ডাকা সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আর তাই রাতে ঘুমানোর সময় চিৎ হয়ে না শুয়ে বরং কাত হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে।
স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগীদের জন্য একটু উঁচু বালিশ ব্যবহার করে রাতে ঘুমানোর মাধ্যমে উপকারিতা পাওয়া যেতে পারে। তবে যেন ঘাড়ে ব্যথা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে অর্থাৎ খুব বেশি উঁচু হওয়া যাবে না।
ঘরের আলো ও তাপমাত্রা যেন ঘুমানোর পক্ষে সুবিধাজনক হয় এবং যতটা সম্ভব নীরব পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। এছাড়াও প্রতিদিন রাতে একই সময়ে ঘুমানো এবং ঘুম থেকে উঠতে চেষ্টা করুন।
৪। হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা
বায়ুর আদ্রতা খুব কমে গেলে অর্থাৎ শুষ্ক আবহাওয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রমে সমস্যা হয়। ঘরের বায়ুর আদ্রর্তা স্বাভাবিক রাখতে হিউমিডিফায়ার (Humidifier) ব্যবহার করা হলে তা স্লিপ অ্যাপনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে বসন্ত ঋতুতে আমাদের দেশে বায়ুর আর্দ্রতা খুব কম থাকে। এছাড়াও এসির তাপমাত্রা খুব কম রাখলে ঘরের আদ্রর্তা কমে যায়।
আদ্রর্তা বাড়াতে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করা উচিত। এছাড়াও আদ্রর্তা বৃদ্ধির জন্য ঘরের মধ্যে খোলা পাত্রে পানি রাখা অথবা কিছু ভেজা কাপড় ছড়িয়ে রাখা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
৫। ধুমপান ও মদ্যপান বর্জন
যারা ধূমপান করেন তাদের ক্ষেত্রে স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে। আবার স্লিপ অ্যাপনিয়ার লক্ষণ বৃদ্ধিতেও ধুমপান প্রভাব ফেলে। সুতরাং এই রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য অবশ্যই ধুমপান ত্যাগ করা উচিত।
মদ্যপান করার ফলে নাক ডাকা লক্ষণ সহ স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে। তাই স্লিপ অ্যাপনিয়ার সমস্যা এড়াতে রাতের বেলায় মদ্যপান করতে নিষেধ করা হয়ে থাকে। যেহেতু মদ্যপান স্বাস্থ্যের জন্য (বিশেষ করে লিভার) ক্ষতিকর, তাই মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করা উত্তম।
৬। খাবার ও পানীয়
স্লিপ অ্যাপনিয়া প্রতিকারের জন্য কিছু কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। যেমনঃ চর্বিযুক্ত মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, চিনি ও সরল শর্করা জাতীয় খাবার ইত্যাদি।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতির সাথে স্লিপ অ্যাপনিয়ার যোগসূত্র রয়েছে। তাই শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতিদিন কিছুক্ষণ সময় রোদ পোহাতে হবে। এই সময়ে ত্বকে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা যাবে না এবং যতটা সম্ভব শরীরে কাপড় সরিয়ে অনাবৃত রাখতে হবে।
স্লিপ অ্যাপনিয়ার সমস্যা দূর করতে গ্রিন টি পান করা উপকারী হতে পারে। তবে রাতে গ্রিন টি পান না করে বরং দিনের বেলায় ২/৩ কাপ গ্রিন টি পান করতে হবে। কারণ সন্ধ্যায় বা রাতে গ্রিন টি পান করার ফলে অনিদ্রা সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। (Bhattacharya, 2023)
স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীদের রাতে ভালো ঘুম হয় না। তাই বলে ঘুমের ওষুধ (Sleeping pills) সেবন করা যাবে না। কারণ এতে করে স্লিপ অ্যাপনিয়া জনিত মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে অনিদ্রা সমস্যা থাকলে সেক্ষেত্রে ডাক্তারকে স্লিপ অ্যাপনিয়ার কথা জানিয়ে ডাক্তারের নির্দেশনা মোতাবেক ঘুমের ওষুধ সেবন করা যাবে।
References
Anthony, K. (2023, March 29). 6 Lifestyle Remedies for Sleep Apnea. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/home-remedies-for-sleep-apnea
Bhattacharya, S. (2023, January 30). 7 Home Remedies For Sleep Apnea And Treatment Options. Retrieved from Stylecraze: https://www.stylecraze.com/articles/home-remedies-for-sleep-apnea/
Last Updated on May 28, 2023
Leave A Comment