বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই উচ্চ কোলেস্টেরলের সমস্যা রয়েছে বলে শোনা যায়। কোলেস্টেরলের বিভিন্ন ধরন রয়েছে যার মধ্যে কোনোটি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী আবার কোনোটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য রক্তে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য (স্বাভাবিক মাত্রা) বজায় রাখা জরুরী। 

কোলেস্টেরলের আদর্শ মাত্রা কত, উচ্চ কোলেস্টরলের কারণ ও লক্ষণ কি কি, কাদের ক্ষেত্রে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে, উচ্চ কোলেস্টেরল স্বাস্থ্যের জন্য কি কি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, কিভাবে কোলেস্টেরল কমানো যায় ইত্যাদি বিষয়ে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

কোলেস্টেরল কি?

কোলেস্টেরল হলো ফ্যাটের মতো উপাদান (লিপিড) যা বিভিন্ন খাবার থেকে পাওয়া যায় আবার শরীরের ভেতরেও (বিশেষ করে লিভার থেকে) উৎপন্ন হয়।

কোষের আবরণ (Cell membrane) তৈরি সহ শরীরে ভিটামিন ডি ও বিভিন্ন হরমোন উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোলেস্টেরলের ভূমিকা রয়েছে। 

ভালো কোলেস্টেরল

HDL (high density lipoprotein) হলো ভালো কোলেস্টেরল যা রক্তনালীর ব্লক দূর করার মাধ্যমে হার্টের রোগের (হার্ট অ্যাটাকস্ট্রোক) ঝুঁকি কমায়। রক্তে HDL এর মাত্রা যতটা সম্ভব বেশি রাখার চেষ্টা করতে হবে। 

খারাপ কোলেস্টেরল

LDL (low density lipoprotein) কে খারাপ কোলেস্টেরল বলা হয়। কারণ রক্তে LDL এর মাত্রা বেশি থাকলে হার্টের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই LDL নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।‌

কোলেস্টেরল এর আদর্শ লেভেল 

কোলেস্টেরল এর আদর্শ লেভেল কত হয় তা নিচের ছকে উল্লেখ করা হলো। (Hoque, 2018) 

উপাদানের নাম আদর্শ লেভেল বর্ডার লাইন বেশি (উচ্চ মাত্রা)
টোটাল কোলেস্টেরল প্রতি ডেসিলিটারে ২০০ মিলিগ্রামের কম ২০০ থেকে ২৩৯ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার  ২৪০ বা তার বেশি
LDL (এলডিএল) প্রতি ডেসিলিটারে ১৩০ মিলিগ্রামের কম ১৩০ থেকে ১৫৯ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার ১৬০ বা তার বেশি
ট্রাইগ্লিসারাইড (TG) প্রতি ডেসিলিটারে ১৫০ মিলিগ্রামের কম ১৫০ থেকে ২০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার ২০০ বা তার বেশি
HDL (এইচডিএল) প্রতি ডেসিলিটারে ৪০ মিলিগ্রামের বেশি ৬০ বা তার বেশি

শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখার জন্য সঠিক মাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইড থাকতে হবে। তবে রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গেলে তা হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।   

টোটাল কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড ও এলডিএল এর মাত্রা বর্ডার লাইনের কম এবং এইচডিএল এর মাত্রা আদর্শ লেভেল থেকে বেশি থাকলে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

হাই কোলেস্টেরল এর লক্ষণ

high cholesterol symptoms

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। যাদের ক্ষেত্রে উচ্চ কোলেস্টেরলের ঝুঁকি রয়েছে তাদের জন্য লিপিড প্রোফাইল টেস্ট (Lipid profile) করতে হবে। 

লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করার জন্য প্রস্তুতি হিসেবে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা উপবাস করতে হয়। অর্থাৎ রাতে খাবার খেয়ে পরদিন সকালে লিপিড প্রোফাইল টেস্টের জন্য স্যাম্পল হিসেবে রক্ত জমা দিতে হবে।  

হাই কোলেস্টেরল এর কারণ

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও অলস জীবন যাপনের ফলে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়।   

খাদ্যাভ্যাস 

কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়ার ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। এই‌ জাতীয় খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো ডিমের কুসুম, কলিজা, গরুর ও খাসির মাংস, চিংড়ি, ঘি ইত্যাদি। 

খাদ্যতালিকায় স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার বেশি থাকলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। বিশেষ করে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, পোড়া তেলে ভাজা খাবার, কলিজা, গরুর মাংস, খাসির মাংস, চিংড়ি, ঘি, ফাস্টফুড ইত্যাদি খাওয়ার ফলে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। 

এছাড়াও ভালো মানের ফ্যাট (আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট) ও ফাইবার জাতীয় খাবার কম খেলে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) কমে যায়। 

অলস জীবন যাপন 

পরিশ্রম ও ব্যায়াম না‌ করার ফলে শরীরে ক্যালরি খরচ কম হয় এবং রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। এছাড়াও অতিরিক্ত মানসিক চাপের প্রভাবে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। 

উচ্চ কোলেস্টেরলের ঝুঁকির কারণ 

  • যাদের শরীরের ওজন বেশি (বিশেষ করে যাদের পেটে অতিরিক্ত চর্বি জমা হয়েছে) তাদের ক্ষেত্রে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে।  
  • মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের ক্ষেত্রে উচ্চ কোলেস্টেরলের ঝুঁকি বেশি থাকে। 
  • যারা ধুমপান ও মদ্যপান করেন তাদের ক্ষেত্রে উচ্চ কোলেস্টেরলের অধিক ঝুঁকি রয়েছে। কারণ ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।‌ 
  • বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে। তাই অল্প বয়সীদের তুলনায় বয়স্কদের ক্ষেত্রে উচ্চ কোলেস্টেরলের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।  
  • বংশগত প্রভাবে (Genetic factor) রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। অর্থাৎ যাদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে উচ্চ কোলেস্টেরলের সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।  
  • ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের রোগ (হাইপোথাইরয়েডিজম) ও কিডনি‌ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে।  

উচ্চ কোলেস্টেরল জনিত সমস্যা

রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন রক্তনালী ব্লক করে দেয়। যার ফলে রক্ত সঞ্চালন ব্যাঘাত ঘটে। হার্টের পেশিতে রক্ত সঞ্চালন ব্যাঘাত ঘটলে তাকে হার্ট অ্যাটাক বলা হয় আর মস্তিষ্কের কোষে রক্ত সঞ্চালন ব্যাঘাত ঘটলে তাকে স্ট্রোক বলা হয়।

উচ্চ কোলেস্টেরল জনিত সবচেয়ে কমন সমস্যা হলো উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেশার) যা‌ অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপের ফলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হয়ে অকাল মৃত্যু ঘটে। 

এছাড়াও কিডনির সমস্যা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে (বিশেষ করে হাত ও পা) রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয়ে অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। (Grey, 2021) 

উচ্চ কোলেস্টেরল কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন? 

exercise

নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার মাধ্যমে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। সেই সাথে উপকারী কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যায়। কোলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিচে উল্লেখিত নিয়মগুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন।

  • ফাইবার সমৃদ্ধ শর্করা (ওটস, লাল আটার রুটি, বাদামী চালের ভাত ও যবের ছাতু), ফলমূল, শাকসবজি, ভালো মানের প্রোটিন (মাছ, ডিম, ডাল ও চামড়া ছাড়া মুরগির মাংস), স্বাস্থ্যকর ফ্যাট জাতীয় খাবার (বাদাম, তিসি, চিয়া বীজ, অলিভ অয়েল, সূর্যমুখী তেল ও সয়াবিন তেল) খেতে হবে।
  • সরল শর্করা (সাদা ভাত, ময়দার তৈরি খাবার, বিস্কুট, পাউরুটি ইত্যাদি), অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার (পাম অয়েল, নারিকেল তেল, পোড়া তেলে ভাজা খাবার, গরু ও খাসির মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার) যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে। 
  • ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করা জরুরী। 
  • মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ইয়োগা ও মেডিটেশন করতে পারেন। 
  • প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। 
  • রাতে ভালো ঘুম হওয়া জরুরী। 

অনিদ্রা সমস্যা দূর করার ৫টি টিপস তথা আরামদায়ক ঘুমের উপায় জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন। 

রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা খুব বেশি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ (Statins জাতীয় ওষুধ যা প্রেসক্রিপশন মেডিসিনের অন্তর্ভুক্ত) সেবন করতে হবে।

Bibliography

Grey, H. (2021, October 12). Everything You Need to Know About High Cholesterol. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/high-cholesterol

Hoque, P. M. (2018). Lipid Profile. In P. M. Hoque, ABC of Medical Biochemistry (p. 587). Dhaka: Parveen Sultana.

Last Updated on January 4, 2024