শরীরের প্রত্যেকটি কোষে অক্সিজেন ও পুষ্টি উপাদান পৌঁছে দেওয়ার কাজে সারা শরীরে রক্তনালীর মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত হয়। কোনো কারণবশত রক্তনালী ভেদ করে শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশে বা বাইরে রক্ত বের হতে থাকলে তাকে রক্তক্ষরণ বা রক্তপাত (Hemorrhage) বলা হয়।
রক্তক্ষরণের কারণ, রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে করণীয়, রক্তপাত কখন জরুরী অবস্থার লক্ষণ নির্দেশ করে অর্থাৎ কোন অবস্থায় রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, যথাসময়ে রক্তপাতের চিকিৎসা করা সম্ভব না হলে পরিণতি কেমন হতে পারে ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
Table of Contents
রক্তপাতের সাধারণ কারণগুলি কী কী?
রক্তক্ষরণের কারণের মধ্যে রয়েছে বাহ্যিক প্রভাব (আঘাত) অথবা অভ্যন্তরীণ বিষয় তথা রোগ বা অসুস্থতা। এছাড়াও কতিপয় ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রক্তক্ষরণ হতে পারে। (Blake, 2019)
আঘাত জনিত রক্তক্ষরণ
রক্তপাতের সবচেয়ে কমন কারণ হলো আঘাত। ধারালো কোনো কিছুর দ্বারা শরীরের অংশ বিশেষ কেটে যাওয়া অথবা সুচালো বস্তু (সুচ বা পেরেক) শরীরে প্রবেশ করার ফলে আক্রান্ত স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হয়।
আঘাতের তীব্রতা অনুযায়ী রক্তক্ষরণের পরিমাণ কম-বেশি হয়ে থাকে। গভীর ক্ষত হলে বেশি রক্তক্ষরণ হয়। আবার পড়ে গিয়ে বা অমসৃণ কোনো কিছুর সাথে ত্বকে ঘসা লাগার ফলে ছিলে গেলে তুলনামূলক কম পরিমাণ রক্তক্ষরণ হতে দেখা যায়।
মাটিতে পড়ে গিয়ে, চোট লেগে অথবা ঘুষি লাগার ফলে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বাইরে রক্ত বের হতে দেখা যায় না বরং ত্বকের নিচে কালশিটে দাগ পড়ে যায়।
রোগের প্রভাবে রক্তক্ষরণ
রোগের প্রভাবে শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশে (পেটের মধ্যে) বা বাইরে (নাক, মুখ, প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে) রক্তক্ষরণ হয়। সাধারণত যেসব রোগের কারণে রক্তক্ষরণ হয় তা হলোঃ
- হিমোফিলিয়া (Hemophilia)
- লিউকেমিয়া (Leukemia) যাকে সহজ ভাষায় ব্লাড ক্যান্সার বলা হয়।
- জরায়ুর রোগ (Endometriosis) যার ফলে পিরিয়ডের সময় বেশি রক্তক্ষরণ হয় বা দীর্ঘসময় (৭ দিনের বেশি) ধরে পিরিয়ড থাকে।
- রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যাওয়া (Thrombocytopenia) যা সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
- ফুসফুসের রোগ (বিশেষ করে ক্যান্সার) যার ফলে কাশির সাথে রক্ত নির্গত হতে দেখা যায়।
- শরীরে ভিটামিন কে (রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে) এর অভাব।
হিমোফিলিয়া একটি বংশগত জটিল রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়ক উপাদানের ঘাটতি থাকে। শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশে অথবা বাইরে কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ রক্তক্ষরণ শুরু হলে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত বলে ধারণা করা যেতে পারে এবং এমতাবস্থায় রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রক্তক্ষরণ
যেসব ওষুধ সেবনের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে রক্তক্ষরণ হয় বা রক্তক্ষরণের ঝুঁকি রয়েছে তা হলোঃ
- এসপিরিন (Aspirin) যা ব্যথা ও প্রদাহ কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়
- রেডিয়েশন থেরাপি
- দীর্ঘমেয়াদী এন্টি-বায়োটিক সেবন
- হার্টের রোগের ঝুঁকি কমাতে রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধী ওষুধ সেবন
ওষুধ সেবন করার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রক্তক্ষরণ শুরু হলে ওষুধ সেবন বন্ধ রেখে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসক অবস্থা বিবেচনায় ওষুধ বা ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন করে দিতে পারবেন।
রক্তপাতের চিকিৎসা কীভাবে করা হয়?
রক্তক্ষরণের প্রাথমিক পর্যায়ে করণীয় হলো রক্তক্ষরণ বন্ধের চেষ্টা করা।
কেটে যাওয়া স্থানে রক্তক্ষরণ
রক্তপাত বন্ধ করার জন্য রক্তক্ষরণের স্থান পরিষ্কার কাপড়, গজ বা হাত (কোনো কিছু না পেলে) দিয়ে চেপে ধরে থাকতে হবে।
অল্প পরিমাণ কেটে গেলে বাড়িতেই ডেটল বা স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে কাপড় বা গজ দিয়ে কেটে যাওয়া স্থান বেঁধে রাখতে হবে। খুব শক্ত করে বাঁধা যাবে না। অর্থাৎ রক্ত চলাচলে যেন বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রেখে বাঁধতে হবে।
রক্তক্ষরণ হলে আতঙ্কিত ও অস্থির হওয়া যাবে না বরং শান্ত থাকতে হবে। কেটে যাওয়া স্থান হার্টের অবস্থান (বুক) থেকে যতটা সম্ভব উঁচুতে রাখতে হবে।
নাক থেকে রক্তক্ষরণ
নাক থেকে রক্তক্ষরণের ক্ষেত্রে নাক চেপে (১০ থেকে ১৫ মিনিট) ধরে থাকতে হবে এবং মুখ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে হবে। এমতাবস্থায় শুয়ে থাকা যাবে না বরং বসে (মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে) থাকতে হবে।
কালশিটে দাগ
আঘাত জনিত কারণে ত্বকে কালশিটে হয়ে গেলে বরফ দিলে উপকার পাওয়া যাবে। কালশিটের পরিমাণ খুব সামান্য হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কয়েক দিন পর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে বেশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন বা সার্জারি করার প্রয়োজন হতে পারে।
ত্বকে সুচালো বস্তু প্রবেশ
ত্বকের ভেতর সুচালো কিছু প্রবেশ করে রক্তক্ষরণ হলে সেক্ষেত্রে সুচালো বস্তু টেনে বের করার চেষ্টা করতে হবে। বের করতে সমর্থ না হলে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য আক্রান্ত স্থানে কাপড় চেপে ধরে নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে।
ধাতব বস্তু ও ময়লা মিশ্রিত বস্তু বিঁধে ক্ষত সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রে টিটেনাস ইনজেকশন গ্রহণ করতে হবে।
অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ
শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশে রক্তক্ষরণ হলে বুঝতে পারা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। বমি, কফ, প্রস্রাব বা মলের সাথে রক্তক্ষরণ বা কালো বর্ণের মলত্যাগ (পেটের ভেতর রক্তক্ষরণের ফলে এমন হয়) হলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
রক্তক্ষরণ জনিত ব্যথা
সামান্য রক্তক্ষরণের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে ব্যথা থাকলে প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে।
Paracetamol 500 mg ট্যাবলেট দিনে ২ থেকে সর্বোচ্চ ২ বার (ভরাপেটে) সেবন করা যথেষ্ট হবে।
মেডিকেল ইমার্জেন্সি লক্ষণ কি কি?
যেসব ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে-
- রক্তক্ষরণের পরিমাণ বেশি হলে (রোগী নিস্তেজ ও শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলে)
- রক্তক্ষরণ বন্ধ করা সম্ভব না হলে
- শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশে রক্তক্ষরণ হলে
বেশি পরিমাণ কেটে গেলে সেক্ষেত্রে কেটে যাওয়া স্থানে সেলাই দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এছাড়াও আঘাত ও রক্তক্ষরণের ধরন অনুযায়ী সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। সেই সাথে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধ (ব্যথা নাশক ওষুধ ও এন্টিবায়োটিক) সেবন করতে হবে।
রক্তপাতের চিকিৎসা না করার পরিণতি কী?
যেকোনো ধরনের রক্তপাতের ক্ষেত্রে প্রধান কাজ হলো রক্তপাত বন্ধ করা। রক্তপাতের পরিমাণ যত বেশি হবে রোগী তত দুর্বল হয়ে পড়বে এবং একসময় মৃত্যু হতে পারে।
শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশে রক্তক্ষরণের ক্ষেত্রে যথাযথ কারণ খুঁজে পাওয়ার জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে এবং যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি সহ মৃত্যু হতে পারে। (Holland, 2023)
Bibliography
Blake, K. (2019, September 18). What You Need to Know About Hemorrhage. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/bleeding
Holland, K. (2023, March 14). Internal Bleeding: Causes, Treatments, and More. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/internal-bleeding
Last Updated on January 4, 2024
Leave A Comment