ব্লাড ক্যান্সার প্রধানত তিন ধরনের হয়ে থাকে যার মধ্যে লিউকেমিয়া (Leukemia) হলো কমন একটি ধরন। ২০২০ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, সারা বিশ্বে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৩ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে মৃত্যু হার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। 

এই অনুচ্ছেদে লিউকেমিয়ার কারণ, ধরন, কি কি লক্ষণ দেখা যায়, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

লিউকেমিয়া কি? 

লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কণিকা ও অণুচক্রিকা হলো রক্তের প্রধান তিনটি কোষ। আবার শ্বেত রক্ত কণিকার ৫ টি ধরন রয়েছে। যথাঃ নিউট্রোফিল, লিম্ফোসাইট, মনোসাইট, ইসোনোফিল ও বেসোফিল। 

বোন ম্যারোতে (Bone marrow) কয়েকটি ধাপে পূর্ণাঙ্গ রক্ত কণিকা উৎপাদন হয়। সর্বপ্রথম হেমোপোয়েটিক স্টেম সেল (Hematopoietic stem cells) হিসেবে রক্ত কণিকার যাত্রা শুরু হয়। অতঃপর স্টেম সেল থেকে Myeloid বা Lymphoid কোষ তৈরি হয়। Myeloid থেকে লোহিত রক্ত কণিকা,‌ অণুচক্রিকা, নিউট্রোফিল, ইসোনোফিল ও বেসোফিল উৎপন্ন হয়। আর Lymphoid থেকে লিম্ফোসাইট এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তাকারী অন্যান্য কোষ উৎপন্ন হয়। 

কোষের DNA এর ত্রুটির দরুণ Myeloid বা Lymphoid গঠন পর্যায়ে অস্বাভাবিকভাবে কোষ বিভাজন শুরু হয়ে গেলে তাকে লিউকেমিয়া বলা হয়। লিউকেমিয়ার ফলে রক্তে সুস্থ রক্ত কোষের সংখ্যা কমে যায়। (Cleveland Clinic, 2022) 

লিউকেমিয়া এর ধরন 

ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি কত দ্রুত হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে লিউকেমিয়া দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ 

একিউট লিউকেমিয়া (Acute Leukemia) 

ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি খুব দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। একিউট লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী ক্যান্সার আক্রমণের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং খুব দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। 

ক্রনিক লিউকেমিয়া (Chronic Leukemia) 

ক্রনিক লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি খুব ধীর গতিতে হয়ে থাকে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। যার ফলে এই ধরনের ক্যান্সার আক্রমণের অনেকদিন পরে ধরা পড়ে। 

ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধির গতি এবং কোন‌ ধরনের কোষ আক্রান্ত হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে লিউকেমিয়া চার ধরনের হয়ে থাকে। যথাঃ 

Acute Lymphocytic Leukemia (ALL) 

একিউট প্রকৃতির (খুব দ্রুত হারে বৃদ্ধি হয়) Lymphoid কোষের ক্যান্সার হলে তাকে ALL বলা হয়। সাধারণত ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।  

Acute Myelogenous Leukemia (AML) 

একিউট প্রকৃতির Myeloid কোষের ক্যান্সার হলে তাকে AML বলা হয়। শিশুদের তুলনায় বড়দের ক্ষেত্রে এই ধরনের ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। 

Chronic Lymphocytic Leukemia (CLL) 

ক্রনিক প্রকৃতির (ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি খুব ধীর গতিতে হয়) Lymphoid কোষের ক্যান্সারকে CLL বলা হয়। সাধারণত বড়দের ক্ষেত্রে এই ধরনের ক্যান্সার হয়ে থাকে। ক্যান্সার আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।  

Chronic Myelogenous Leukemia (CML) 

ক্রনিক প্রকৃতির Myeloid কোষের ক্যান্সারকে CML বলা হয়। সাধারণত বড়দের ক্ষেত্রে হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। 

লিউকেমিয়া এর কারণ 

কোষের ভেতরে থাকে DNA যা কোষ বিভাজন ও কোষের স্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে থাকে। DNA এর মিউটেশন বা পরিবর্তনের ফলে সুনির্দিষ্ট সিগন্যাল দিতে ব্যর্থ হয়। যার ফলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কোষ বিভাজন শুরু হয় তথা লিউকেমিয়ার আক্রমণ ঘটে। তবে ঠিক কি কারণে DNA এর এমন পরিবর্তন ঘটে সেই ব্যাপারে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত জানতে সক্ষম হয়নি। অর্থাৎ বলা যায় যে, লিউকেমিয়ার প্রকৃত কারণ অজানা। 

লিউকেমিয়ার ঝুঁকির কারণ 

লিউকেমিয়ার প্রকৃত কারণ জানা না গেলেও যেসব বিষয় এই রোগে‌ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় তা চিহ্নিত করা গেছে। লিউকেমিয়ার ঝুঁকির কারণ (Risk factors) গুলো হলোঃ (Lights, 2023) 

  • পূর্বে অন্য কোনো ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া এবং এর জন্য চিকিৎসা হিসেবে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি ব্যবহার করা 
  • জেনেটিক ডিজঅর্ডার বা Down syndrome রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি 
  • ধুমপানের অভ্যাস 
  • রাসায়নিক উপাদান ও তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব 
  • লিউকেমিয়ার পারিবারিক ইতিহাস 
  • শরীরের অতিরিক্ত ওজন  
  • মহিলাদের তুলনায় পুরুষের ক্ষেত্রে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।  

রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে লিউকেমিয়া হবেই এমন কোনো কথা নেই। আবার রিস্ক ফ্যাক্টর ছাড়াও লিউকেমিয়া হতে পারে। তবে রিস্ক ফ্যাক্টর থাকা মানে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি রয়েছে।

লিউকেমিয়া এর লক্ষণ

image4 1 

লিউকেমিয়ার ধরন ভেদে লক্ষণের ক্ষেত্রে পার্থক্য হয়। তবে সাধারণভাবে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলোঃ 

  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি (সামান্য কাজ করার পরেই প্রচুর ক্লান্তি বোধ হয়) 
  • জ্বর ও শীত বোধ 
  • রাতে অতিরিক্ত ঘাম হয় 
  • ঘন‌ ঘন ইনফেকশনের প্রবণতা 
  • ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যায় (Pale skin)
  • শ্বাসকষ্ট (Shortness of breath)
  • শরীরের ওজন কমে যাওয়া
  • সহজেই রক্তক্ষরণের প্রবণতা 
  • হাড় ও বুকের পাঁজরে‌ ব্যথা হয় 
  • লিম্ফ নোড ফুলে যেতে পারে
  • লিভার ও প্লীহা (Spleen) বড় হয়ে যাওয়ার ফলে পেট ফুলে যায় 
  • বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া 
  • মাথাব্যথা ও ঝিমুনি ভাব ইত্যাদি 

সাধারণ মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণ দেখে লিউকেমিয়া হয়েছে তা বুঝতে সক্ষম হয় না। বিশেষ করে ক্রনিক লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন পর্যন্ত (কয়েক মাস থেকে সর্বোচ্চ কয়েক বছর) এই রোগ অজানাই থেকে যায়। তবে কখনো কোনো কারণবশত রক্ত পরীক্ষা করা হলে সেই সময়ে রিপোর্টে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। অর্থাৎ ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েছে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

লিউকেমিয়া কিভাবে নির্ণয় করা হয়?

image3 8 

দীর্ঘদিন ধরে জ্বর, সহজেই ক্লান্তি, ঘন‌ ঘন ইনফেকশন, সহজেই রক্তক্ষরণের প্রবণতা সহ লিউকেমিয়ার যেকোনো লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই বিলম্ব না করে একজন হেমাটোলজিস্ট (Hematologist) বা রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। 

লিউকেমিয়া নির্ণয়ের জন্য রোগ লক্ষণের বর্ণনা শোনার পর চিকিৎসক রোগীকে শারীরিক পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন তা হলোঃ 

  • রক্ত পরীক্ষা (CBC- Complete blood count)
  • Blood cell examination 
  • Bone marrow biopsy
  • এক্সরে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই 
  • Lumbar puncture (spinal tap)  

চিকিৎসা 

লিউকেমিয়ার ধরন, তীব্রতা, রোগীর বয়স, শারীরিক অবস্থা ও ক্যান্সার শরীরের অন্য কোনো অঙ্গে‌ ছড়িয়ে পড়েছে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনা করে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। লিউকেমিয়ার জন্য যেসব চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে তা হলোঃ

  • প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য কেমোথেরাপি (Chemotherapy) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতি তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল। 
  • কেমোথেরাপির সাহায্যে ক্যান্সার কোষ পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রে রেডিওথেরাপির (Radiation therapy) সহায়তা নেওয়া হয়। 
  • ইমিউনোথেরাপি দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো যেন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজে থেকে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়। 
  • লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হলে বোন ম্যারো ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্টের মাধ্যমে ঠিক করা যায়। এটি খুব ব্যয়বহুল একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। নিজের শরীর থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে অথবা অন্য কারো শরীর থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে বোন ম্যারো ট্র্যান্সপ্লান্ট করা হয়ে থাকে। 

লিউকেমিয়ার চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল হয়ে থাকে। সেই সাথে নানাবিধ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যেমনঃ চুল পড়ে যাওয়া, বমি বমি ভাব, বমি, মুখে ঘা হওয়া, খাবার খাওয়ার প্রতি অনিহা, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি। আশার কথা হলো, চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা লিউকেমিয়ার জন্য আরো উন্নত ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষ্কারের নিমিত্তে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

চিকিৎসার মাধ্যমে লিউকেমিয়া একদম ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হলে রোগ লক্ষণ দূর হয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত রোগী স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকে। বিশেষ করে ক্রনিক লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে পরবর্তী ৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। 

তবে লিউকেমিয়ার রোগীদের জন্য যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন চিকিৎসকের সান্নিধ্যে থাকতে হবে। অর্থাৎ মাঝে মধ্যেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে এবং ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে জীবন যাপন করতে হবে। 

প্রতিরোধ 

লিউকেমিয়া প্রতিরোধ করতে পারে এমন কোনো কার্যকরী পদ্ধতি নেই। তবে কতিপয় নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়। যেমনঃ 

  • যারা ধুমপান করেন না তাদের ক্ষেত্রে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম থাকে। তাই ধুমপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করা জরুরী। 
  • শরীরের অতিরিক্ত ওজনের সাথে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। তাই শরীরের শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। 
  • ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানের সংস্পর্শ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। 

লিউকেমিয়া কোনো ছোঁয়াচে প্রকৃতির রোগ নয়। অর্থাৎ লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত একজন ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকলে সুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে না। তাই লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এড়িয়ে না চলে বরং তাদের পাশে থেকে সেবা শুশ্রূষা ও মানসিক সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করুন।

Bibliography

Cleveland Clinic. (2022, 05 18). Leukemia. Retrieved from Cleveland Clinic: https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/4365-leukemia

Lights, V. (2023, February 03). A Guide to Leukemia. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/leukemia

Last Updated on December 18, 2023