চুলের যত্নে কেরাটিন ট্রিটমেন্টের (Keratin treatment) নাম হয়তোবা অনেকেই শুনে থাকবেন আবার কেউ কেউ ইতিমধ্যেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন হয়তো। কেরাটিন ট্রিটমেন্ট চুলের যত্নে অনেক উপকারিতা বয়ে আনার পাশাপাশি কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে যা এই ট্রিটমেন্ট নেওয়ার পূর্বে জানা থাকা জরুরী।
এই অনুচ্ছেদে কেরাটিন ট্রিটমেন্ট কি কাজ করে তথা উপকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচতে কি করা যেতে পারে সেই বিষয়ে জানতে শেষ পর্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকুন।
কেরাটিন ট্রিটমেন্ট কি?
কেরাটিন (Keratin) হলো একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন যা প্রাকৃতিকভাবে চুল, নখ ও ত্বক সহ শরীরের অভ্যন্তরীণ কিছু অঙ্গে থাকে। এটি হলো প্রটেকটিভ টাইপ প্রোটিন অর্থাৎ চুল, নখ ও ত্বককে প্রটেকশন দেয়।
ধুলাবালি, রোদ, হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করে চুল শুকানো, চুলে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান বা কালার ব্যবহার করা, চুলের সঠিক যত্ন না নেওয়া ইত্যাদি নানাবিধ কারণে চুলে থাকা প্রাকৃতিক কেরাটিন নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে চুল মসৃণতা হারায়, শুষ্ক হয়ে যায়, চুল কোঁকড়ানো হয়ে যায়, চুল সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না ইত্যাদি সমস্যা গুলো দেখা যায়।
কৃত্রিম উপায়ে চুলে কেরাটিন বেসড প্রডাক্ট (keratin-based product) ব্যবহার করার মাধ্যমে চুলের ড্যামেজ দূর করা সহ চুল মসৃণ করা যায় যা কেরাটিন ট্রিটমেন্ট নামে পরিচিত।
কেরাটিন ট্রিটমেন্ট কি কাজ করে?
কেরাটিন ট্রিটমেন্ট কি কাজ করে তথা চুলের জন্য কি কি উপকারিতা বয়ে আনতে পারে তা নির্ভর করে চুলের প্রকৃতি এবং কেরাটিন বেসড প্রডাক্টের কোয়ালিটি বা ধরনের উপর। কারণ একেকজন মানুষের চুলের গঠন বা প্রকৃতি একেকরকম হয়ে থাকে। আবার কেরাটিন বেসড প্রোডাক্টের অনেকগুলো কোয়ালিটি রয়েছে। কেরাটিন ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে যেসব উপকারিতা আশা করা যায় তা হলোঃ (Iftikhar, 2021)
১. চুল ঝলমলে করে
রোদের তাপে এবং চুলে বিভিন্ন প্রসাধনী ব্যবহার করার ফলে চুল ড্যামেজ হয়ে যায় এবং চুলের ঝলমলে ভাব কমে যায়। কেরাটিন ট্রিটমেন্টের ফলে চুলের ঝলমলে ভাব বেড়ে যায় এবং চুল উজ্জ্বল দেখায়।
২. কোঁকড়ানো চুল স্ট্রেইট করে
কোঁকড়ানো চুল স্ট্রেইট করতে হিট বা তাপ দেওয়া পদ্ধতির চেয়ে কেরাটিন ট্রিটমেন্ট অবলম্বন করা বেশি উপকারী হবে। কারণ তাপের প্রভাবে চুলের কেরাটিন নষ্ট হয়ে যেতে পারে পক্ষান্তরে কেরাটিন ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে চুলের কেরাটিন ভালো থাকবে।
৩. চুল সহজে ম্যানেজ করা যায়
যারা চুলের বিভিন্ন ধরনের স্টাইল করতে চান তাদের জন্য কেরাটিন ট্রিটমেন্ট দারুন উপকারী হবে। কারণ এই পদ্ধতি অবলম্বন করার পর চুলে সহজেই যেকোনো স্টাইল করা যায়।
৪. চুল নরম ও মসৃণ করে
কেরাটিন ট্রিটমেন্ট চুলের ড্যামেজ সারিয়ে তোলে এবং রুক্ষতা দূর করে। এছাড়াও দীর্ঘদিন পর্যন্ত চুল নরম ও মসৃণ রাখতে সাহায্য করে।
৫. চুলকে মজবুত করে
চুলের কেরাটিন নষ্ট হয়ে গেলে সহজেই চুল ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। কেরাটিন ট্রিটমেন্টের ফলে চুলের কেরাটিন ফিরে পায় এবং চুল মজবুত হয়। ফলে চুল সহজেই ভেঙে যায় না।
৬. চুলের পুরুত্ব বাড়ায়
অনেকের চুল থাকে খুব পাতলা ও রুক্ষ প্রকৃতির। এমন চুলের জন্য কেরাটিন ট্রিটমেন্ট করা হলে তা চুলের পুরুত্ব বাড়াতে সাহায্য করবে।
“কেরাটিন ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে আপনি কি ধরনের ফলাফল আশা করেন তা আপনার বিউটিশিয়ানকে আগে থেকে জানাতে হবে যেন যথাযথ প্রডাক্ট ব্যবহার করতে পারেন।”
কেরাটিন ট্রিটমেন্টের পর চুলের যত্ন
কেরাটিন ট্রিটমেন্ট করার পরবর্তী নূন্যতম ২ দিন পর্যন্ত মাথা ধোয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে লবণাক্ত পানিতে (সমুদ্রে) চুল ধোয়া বা গোসল করা যাবে না। সেই সাথে পরবর্তী ২ সপ্তাহ পর্যন্ত চুলে কোনো কালার বা মেহেদী ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং চুল খুব শক্ত করে বেঁধে রাখা যাবে না।
কেরাটিন ট্রিটমেন্টের ফলে চুলের উপকার ১২ সপ্তাহ বা তার বেশি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত কেরাটিন ট্রিটমেন্টের উপকারিতা ধরে রাখার জন্য কেরাটিন ট্রিটমেন্ট নেওয়ার পর কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। যেমনঃ (Sherrell, 2022)
- সাধারণ শ্যাম্পু ব্যবহার না করে বরং কেরাটিন সমৃদ্ধ শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে।
- সালফেট (sulfate) সমৃদ্ধ শ্যাম্পু ও চুলের প্রসাধনী এড়িয়ে চলুন। প্রডাক্টের গায়ে লেখা দেখুন সেটি সালফেট সমৃদ্ধ কিনা। সালফেটের রাসায়নিক সংকেত (SO₄²-) লেখা থাকতে পারে।
- গরম পানি দিয়ে চুল ধোয়া যাবে না। চুলের যত্নে কখনো প্রয়োজন মনে করলে বড়জোর কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে পারেন।
কেরাটিন ট্রিটমেন্ট এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
কেরাটিন মানুষের শরীরে স্বাভাবিক ভাবে উৎপাদন হয় যা প্রাকৃতিক বলা যেতে পারে। তবে তাই বলে কেরাটিন ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কেরাটিন বেসড প্রডাক্টকে ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক বলা যায় না। বরং এগুলো বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান সমৃদ্ধ হয়ে থাকে যা চুল ও ত্বক সহ শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষত কেরাটিন বেসড প্রডাক্টে ফরমালডিহাইড (Formaldehyde) থাকে যা আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি কার্সিনোজেন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কার্সিনোজেন অর্থ হলো এমন বস্তু যা শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
কেরাটিন ট্রিটমেন্ট নেওয়ার ফলে যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে তা হলোঃ
- মাথাব্যথা
- ঝিমুনি ভাব
- গলা ব্যথা
- বমি বমি ভাব
- চোখ জ্বালাপোড়া
- বুকে ব্যথা
- মাথার ত্বকে চুলকানি
গর্ভবতীদের কেরাটিন ট্রিটমেন্ট নেওয়া যাবে কি?
গর্ভকালীন সময়ে নারীর শরীরে হরমোনের পরিবর্তন হয়। যার ফলে চুলের পরিবর্তন হওয়া বা চুল কোঁকড়ানো হয়ে যেতে পারে। তবে এর জন্য কেরাটিন ট্রিটমেন্ট নেওয়ার কথা ভাবার কোনো অবকাশ নেই।
গর্ভবতী নারীদের জন্য কেরাটিন ট্রিটমেন্ট নেওয়া যাবে না। কারণ এতে গর্ভস্থ ভ্রূণের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য কেরাটিন ট্রিটমেন্ট এড়িয়ে চলা উচিত।
এই সময় গুলোতে চুলের যত্নে সাধারণ শ্যাম্পু ও কন্ডিশনারের বাইরে কোনো রাসায়নিক উপাদান সমৃদ্ধ প্রসাধনী ব্যবহার করতে চাইলে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। (Fields, 2013)
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে করণীয়
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়ানোর একমাত্র উপায় হলো কেরাটিন ট্রিটমেন্ট না নেওয়া।
কারণ অনেক সময় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কেরাটিন বেসড প্রডাক্টের গায়ে ফরমালডিহাইড লেখা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বলে নিশ্চিন্ত মনে সেই প্রডাক্ট ব্যবহার করা যাবে না। কারণ কোম্পানি বুদ্ধি খাটিয়ে প্রডাক্টের গায়ে ফরমালডিহাইড না লিখে অন্য নাম লিখে থাকেন যেন মানুষ বুঝতে না পারে।
তাহলে কি কেরাটিন ট্রিটমেন্ট একদমই নেওয়া যাবে না? নেওয়া যাবে। কারণ কারসিনোজেন মানেই ক্যান্সার হবে এমন নয় বরং ক্যান্সার সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়ায়। আর তাছাড়া পৃথিবীতে একমাত্র ফরমালডিহাইড কারসিনোজেন উপাদান তা নয় বরং এমন অনেক বস্তু আছে যা আমরা অহরহ গ্রহণ করছি। যেমনঃ তামাকজাত দ্রব্য (জর্দা ও সিগারেট), ক্রিস্পি (Crispy) ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, অ্যালকোহল, প্রক্রিয়াজাত মাংস ইত্যাদি।
“কেরাটিন ট্রিটমেন্ট ঘন ঘন না নিয়ে বরং যতটা সম্ভব কম নেওয়ার চেষ্টা করুন যেন ক্ষতির সম্ভাবনা কম থাকে।”
প্রাকৃতিক কেরাটিন ড্যামেজ প্রতিরোধ
- চুলের কেরাটিন ভালো রাখার জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
- চুল শুকাতে হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক পদ্ধতি অবলম্বন করা উত্তম। ফ্যানের বাতাসে চুল শুকানো যেতে পারে।
- দীর্ঘসময় পর্যন্ত রোদে থাকা চুলের জন্য ক্ষতিকর। আর তাই যতটা সম্ভব কম সময় রোদে থাকুন অথবা রোদে গেলে স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢেকে রাখুন।
- চুলে প্রতিদিন শ্যাম্পু ব্যবহার করা যাবে না। এতে চুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন বা একদিন পর পর শ্যাম্পু ব্যবহার করুন।
- চুলের যত্নে প্রাকৃতিক পুষ্টিগুণে ভরপুর বিভিন্ন তেল ব্যবহার করতে পারেন। যেমনঃ নারিকেল তেল, অলিভ অয়েল ও সূর্যমুখী তেল।
References
Fields, L. (2013, September 24). Hair Care During Pregnancy. Retrieved from WebMD: https://www.webmd.com/baby/features/pregnancy-hair-care
Iftikhar, N. (2021, December 14). What Are the Side Effects of a Keratin Treatment? Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/what-are-the-side-effects-of-a-keratin-treatment
Sherrell, Z. (2022, May 30). What to know about keratin hair treatments. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/keratin-hair-treatment#care
Last Updated on April 9, 2023
Leave A Comment