প্যানক্রিয়াস থেকে এনজাইম ও ইনসুলিন নিঃসরণ হয় যা খাবার হজম ও বিপাক প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ হলে তাকে প্যানক্রিয়াটাইটিস বলা হয় যার ফলে প্যানক্রিয়াসের কার্যক্ষমতা কমে যায়। তাই প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য সবধরনের খাবার খাওয়া যাবে না। বরং যেসব খাবার খেলে হজমে সমস্যা হবে না এবং প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ বাড়াবে না সেইসব খাবারগুলো খেতে হবে
এই অনুচ্ছেদে প্যানক্রিয়াটাইটিস ডায়েট অর্থাৎ প্যানক্রিয়াটাইটিস হলে কী খেতে হবে এবং কোন কোন খাবারগুলো খাওয়া যাবে না সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
প্যানক্রিয়াটাইটিস ডায়েট
প্যানক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য যে ডায়েট অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয় তাকে প্যানক্রিয়াটাইটিস ডায়েট বলে। প্যানক্রিয়াটাইটিসের সাথে খাবারের বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। খাবারের ব্যাপারে সঠিক নিয়ম মেনে চলা প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্যানক্রিয়াটাইটিস দুই ধরনের হয়ে থাকে এবং ধরন অনুযায়ী খাবার গ্রহণের ব্যাপারে নির্দেশনা ভিন্নতর হয়ে থাকে।
একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের জন্য রিকভারি ডায়েট এবং অনুচ্ছেদের অন্যান্য নির্দেশনাগুলো ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের জন্য প্রযোজ্য।
প্যানক্রিয়াটাইটিস হলে কী খাবেন?
প্রোটিন
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের ফলে প্যানক্রিয়াস থেকে এনজাইম নিঃসরণ কমে যায়। যার ফলে প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাবার হজমে সমস্যা হয়। কিন্তু শরীরের জন্য প্রোটিন হলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আর তাই ভালো মানের প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে। যেমনঃ (Watson, 2023)
- চামড়া ছাড়ানো মুরগির মাংস
- ডিম (কুসুম বাদ দিতে হবে)
- লো-ফ্যাট বা ফ্যাট ফ্রি দুধ
- মটরশুটি ও ডালজাতীয় খাবার
উচ্চ প্রোটিনযুক্ত একটি খাবার হলো গরুর মাংস কিন্তু স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনায় গরুর মাংস খাওয়া উচিত হবে কিনা সেই ব্যাপারে চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
ফ্যাট
ফ্যাট জাতীয় খাবার পুরোপুরি বর্জন করা হলে নানাবিধ সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে ফ্যাটে দ্রবণীয় ভিটামিন (ভিটামিন এ, ডি, ই, কে ইত্যাদি) শরীরে সংরক্ষণের জন্য ফ্যাটের প্রয়োজন। আর তাই এমন প্রকৃতির ফ্যাট গ্রহণ করতে হবে যা সহজেই হজম হবে এবং রোগীর রোগ যন্ত্রণা বাড়াবে না। এই জাতীয় একটি ফ্যাট হলো নারিকেল তেল যা রান্নার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের রোগীদের জন্য মাছ খাওয়া যেতে পারে। কারণ মাছে ভালো মানের প্রোটিন ও অত্যন্ত উপকারী ফ্যাট (ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড) রয়েছে। সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন মাছ খাওয়া যেতে পারে। তবে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাছ খাওয়া যাবে না।
শর্করা
শরীরের ৬০ শতাংশ ক্যালরি সরবরাহ করে শর্করা জাতীয় খাবার। শর্করার চাহিদা মেটাতে পরিমিত পরিমাণে ভাত অথবা রুটি খেতে হবে। তবে অধিক আঁশযুক্ত শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না। কারণ এগুলো হজমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যেমনঃ বাদামী চালের ভাত, লাল আটার রুটি, যব, ওটস ইত্যাদি।
এন্টি অক্সিডেন্ট (Antioxidant) সমৃদ্ধ খাবার
প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ কমানোর ক্ষেত্রে দারুন উপকারী একটি উপাদান হলো এন্টি অক্সিডেন্ট (Antioxidant) সমৃদ্ধ খাবার। যেমনঃ বিভিন্ন ফলমূল ও শাক-সবজি। বিশেষ করে পালংশাক, ব্রকলি, বাঁধাকপি, মিষ্টি আলু, জাম, আঙ্গুর, গাজর, ডালিম ও কাঠবাদাম খাওয়া বেশি উপকারী হবে।
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে শরীরে বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি দেখা যায়। ঘাটতি পূরণের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
প্যানক্রিয়াটাইটিস হলে কী খাবেন না?
খাবার গ্রহণের ব্যাপারে নির্দেশনা মেনে চলার পাশাপাশি ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য কিছু নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা জরুরী।
১. বিশেষ করে মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা অবশ্যই বর্জন করতে হবে। কারণ মদ্যপান প্যানক্রিয়াসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এছাড়াও ধুমপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।
২. অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খেলে হজমে সমস্যা হয় এবং প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন করতে হবে। যেমনঃ
- চর্বিযুক্ত মাংস
- মুরগির চামড়া
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
- ডিমের কুসুম ইত্যাদি
৩. সরল শর্করা জাতীয় খাবার (যেমনঃ ভাত ও রুটি) বেশি পরিমাণে খাওয়া যাবে না। এছাড়াও চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। কোমল পানীয় পান করা শুধু প্যানক্রিয়াস নয়, বরং লিভার সহ পুরো শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই কোমল পানীয় পান করা যাবে না।
৪. কেক, পেস্ট্রি, পটেটো চিপস, আইসক্রিম সহ সবধরনের ফাস্টফুড ও পোড়া তেলে ভাজা খাবার বর্জন করতে হবে। কারণ এই জাতীয় খাবারগুলো প্যানক্রিয়াসের রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ক্ষতিকর হবে।
প্যানক্রিয়াটাইটিস থেকে পুনরুদ্ধারের ডায়েট (Recovery Diet)
একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের ক্ষেত্রে রোগী হাসপাতালে ভর্তি রাখতে হয়। এমতাবস্থায় মুখে কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরে রোগীর জন্য খাবার সম্পর্কিত যে নির্দেশনা দেওয়া হয় তাকে রিকভারি ডায়েট বলা হয়। এই জাতীয় ডায়েটের উদ্দেশ্য হলো যেন প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ বেড়ে না যায় এবং পুনরায় একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের আক্রমণ না হয়। (Cleveland Clinic, 2020)
- ধুমপান ও মদ্যপান করা যাবে না।
- অতিরিক্ত আঁশ ও চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- লো-ফ্যাট খাবার খাওয়া যাবে।
- প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
- চা ও কফি পানের অভ্যাস সীমিত করতে হবে।
- কোমল পানীয় পান করা যাবে না।
- চিপস, ফাস্টফুড ও পোড়া তেলে ভাজা খাবার বর্জন করতে হবে।
- একবারে বেশি পরিমাণে খাবার খাওয়া যাবে না। দিনের মধ্যে ৬ থেকে ৮ বার অল্প পরিমাণে খেতে হবে যেন প্যানক্রিয়াসের পক্ষে খাবার হজম করা সহজ হয়।
- প্রয়োজন সাপেক্ষে ভিটামিন এ, ডি, ই, কে ইত্যাদি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
খাওয়ার পরে পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব, বমি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
প্যানক্রিয়াটাইটিসের কারণ
একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের প্রধান কারণ হলো পিত্তথলির পাথর আর ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস সাধারণত দীর্ঘদিন যাবত মদ্যপানের প্রভাবে হয়ে থাকে। এছাড়াও প্যানক্রিয়াটাইটিসের অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ধুমপানের অভ্যাস, বংশগত প্রভাব, অটোইমিউন ডিজিজ ইত্যাদি।
যেকোনো বয়সের মানুষের প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে অধিক প্রবণতা রয়েছে।
প্যানক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসা
একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস
একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রোগীর অবস্থা বেশি সংকটাপন্ন মনে হলে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা করতে হবে। ব্যথা নিরাময়ের জন্য শিরায় ইনজেকশন এবং শরীরে পানি সরবরাহের জন্য শিরায় স্যালাইন দিতে হয়। এছাড়াও শ্বাস নিতে কষ্ট হলে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হবে। রোগীকে ৫ থেকে ৭ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয় এবং পিত্তথলির পাথর জনিত একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের জন্য সার্জারি করে পাথর অপসারণ করার প্রয়োজন হয়।
পিত্তথলির পাথর কেন হয় সেই সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা সাধারণত তীব্র লক্ষণ সৃষ্টি করে না। তবে সময়ের সাথে সাথে প্যানক্রিয়াস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হার বাড়তে থাকে। তাই লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে যত আগে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া যায় ততই ভালো। ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের জন্য মুখে ওষুধ সেবন করা, নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে। এছাড়াও মাঝে মধ্যেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে শরীরের অবস্থার আপডেট জানতে হবে।
References
Cleveland Clinic. (2020, March 23). The Best (and Worst) Foods for Pancreatitis Pain. Retrieved from Cleveland Clinic: https://health.clevelandclinic.org/best-and-worst-foods-for-pancreatitis-pain/amp/
Watson, K. (2023, March 27). Pancreatitis Diet. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/pancreatitis-diet
Last Updated on November 12, 2023
Leave A Comment