আপনার যদি রাতে‌ সহজে ঘুম না আসে অথবা রাতে ঘুমানোর পরেও (ভালো ঘুম হয় না বলে) দিনে ক্লান্তি অনুভব করেন তবে সম্ভবত আপনার অনিদ্রা (Insomnia) হয়েছে। অনিদ্রা খুব কমন একটি ঘুমের সমস্যা যার ফলে রাতে সহজে ঘুম ধরে না অথবা ঘুম ধরার একটু পরেই ঘুম ভেঙ্গে যায়।

অনিদ্রার কারণ, লক্ষণ, কাদের ক্ষেত্রে অনিদ্রায় আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে, কিভাবে অনিদ্রা নির্ণয় করা হয়, কি ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

অনিদ্রার কারণ 

অনিদ্রা স্বল্পকালীন (Acute) অথবা দীর্ঘমেয়াদী (Chronic) হতে পারে। ক্ষণস্থায়ী অনিদ্রার কারণ গুলো হলোঃ

  • মানসিক চাপ
  • ঘুমের অভ্যাস পরিবর্তন
  • শারীরিক ব্যথা বা যন্ত্রণা
  • অসুস্থতার প্রভাব
  • ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
  • অতিরিক্ত চাকফি পান করা

দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রার কারণ গুলো হলোঃ

  • দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা (আর্থ্রাইটিস, পিঠে ব্যথা, বাত ব্যথা ইত্যাদি)
  • মানসিক সমস্যা (বিষন্নতা ও উদ্বিগ্নতা)
  • ঘুমের রোগ (Sleep apnea
  • উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সার।

অনিদ্রার রিস্ক ফ্যাক্টর 

যেকোনো বয়সের মানুষের অনিদ্রা হতে পারে তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে। এছাড়াও অনিদ্রার অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টর (Risks factor) গুলো হলোঃ (Hullett, 2023) 

  • অতিরিক্ত মানসিক চাপ
  • অলস জীবন যাপন করা
  • রাতের শিফটের কাজ করা
  • ঘুমের অনিয়মিত সময়সূচী
  • ঘন ঘন ঘুমানোর অভ্যাস
  • অতিরিক্ত চা ও কফি পান করা
  • মদ্যপান, ধুমপান এবং অন্যান্য নেশা দ্রব্য গ্রহণ করা।

আপনার অনিদ্রা আছে কিনা তা কীভাবে জানবেন? 

নিচে উল্লেখিত সমস্যাগুলো আপনার ক্ষেত্রে ঘটলে বুঝতে হবে যে আপনার অনিদ্রা হয়েছে। যেমনঃ

  • বিছানায় যাওয়ার পরে ঘুমিয়ে পড়তে দীর্ঘক্ষণ দেরি হয়
  • অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকা বা দুশ্চিন্তায় কাটানো হয়
  • ঘুমানোর একটু পরেই ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া এবং পুনরায় ঘুম হয় না
  • রাতে বার বার ঘুম ভেঙ্গে যায়

অনিদ্রার লক্ষণ

রাতে ভালো ঘুম না হলে অর্থাৎ অনিদ্রা রোগীদের ক্ষেত্রে দিনের বেলায় যেসব সমস্যা দেখা যায় তা হলোঃ

  • ক্লান্তি (Fatigue)
  • বিরক্তিবোধ
  • মেজাজ খারাপ হওয়া
  • কাজে মনোযোগ কমে যাওয়া
  • স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া ইত্যাদি

দিনের বেলা ঘুমানো কি অনিদ্রার লক্ষণ?

মানুষ ভেদে ঘুমের অভ্যাসের পার্থক্য দেখা যায়। অর্থাৎ কেউ গভীর রাতে ঘুমায় এবং সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে। আবার কেউ সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পড়ে এবং খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন।

কখন এবং কতক্ষণ সময় ঘুমানো হলো তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ঘুমের কোয়ালিটি। অর্থাৎ ভালো ঘুম হতে হবে। রাতে ঘুম হয় না তবে দিনে ৮ ঘন্টা ঘুম হয়। কিন্তু তাতে যদি শরীরের ক্লান্তি ও অস্থিরতা দূর না হয় তবে দিনের ঘুম অনিদ্রার লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে।

উদ্বেগ আছে কিনা তা কীভাবে জানবেন 

image3 3

আপনি যদি রাতে চিন্তামগ্ন হয়ে জেগে থাকেন তবে আপনার উদ্বেগ আছে কিনা সে বিষয়ে আপনি ভাবতে পারেন। আপনার উদ্বেগ থাকতে পারে যদি-

  • দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনা বা উদ্বিগ্নতা বোধ করেন
  • দ্রুত হার্ট রেট অনুভব করা
  • উচ্চ রক্তচাপ দেখা যায়
  • অত্যধিক ঘাম হয়
  • প্রায়ই মাথা ঘোরানো
  • দুর্বলতা বা অলস বোধ করা
  • উদ্বেগের বিষয়বস্তু ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে মনোনিবেশ করতে না পারা
  • পেটের সমস্যা হওয়া ইত্যাদি

কিভাবে নিদ্রাহীনতা নির্ণয় এবং সনাক্ত করা যায়? 

ঘুমের জন্য উপযুক্ত ভালো পরিবেশে থেকেও যদি আপনার ঘুম না হয় এবং সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন করে একটানা ৩ মাস পর্যন্ত ঘুমের সমস্যা হতে থাকে তবে বুঝতে হবে আপনার দীর্ঘমেয়াদী অনিদ্রা সমস্যা হয়েছে। এমতাবস্থায় একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে যেন প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা এবং যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।

পরীক্ষা সমূহঃ

  • শারীরিক পর্যবেক্ষণ
  • ঘুমের অভ্যাস সম্পর্কে জানা
  • কোনো ওষুধ খাচ্ছেন কিনা সেই ব্যাপারে জানা
  • আপনার জীবনযাপন পদ্ধতি সহ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অবগত হওয়া

আপনার ঘুমের সমস্যার কারণ চিহ্নিত করতে ডাক্তার আপনাকে ডায়েরি ব্যবহার করার পরামর্শ দিতে পারেন। যেখানে আপনার ঘুমের সময়সূচী এবং সমস্যার কারণ সম্পর্কে নোট রাখতে পারেন যা পরবর্তীতে ডাক্তার দেখে রোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাবেন।

চিকিৎসা 

image2 1

স্বল্পকালীন অনিদ্রা সমস্যা দূর করার জন্য যেসব নিয়ম মেনে চলতে হবে তা হলোঃ (Mawer, 2023) 

  • দিনের বেলা কিছুক্ষণ সময় ধরে কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে
  • অতিরিক্ত চা ও কফি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে চা ও কফি পান করা যাবে না
  • ধুমপান ও মদ্যপান করার অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করা উচিত
  • ঘরের তাপমাত্রা, আলো, বালিশ ও বিছানা আরামদায়ক হতে হবে 
  • মশারি টাঙিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে যেন মশার উৎপাতে ঘুমের ব্যঘাত না হয়। এছাড়াও মশারি টাঙিয়ে ঘুমানোর ফলে মশাবাহিত রোগ (Mosquito-Borne Diseases) থেকে বাঁচা যাবে
  • মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের আসক্তি কমাতে হবে। রাতে ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে 
  • দিনের বেলায় সর্বোচ্চ ৩০ মিনিটের চেয়ে বেশি সময় ঘুমানো উচিত নয়। কারণ দিনে বেশি ঘুমালে রাতে সহজে ঘুম পায় না
  • রাতের খাবার অনেক দেরিতে খাওয়া উচিত নয়।‌ বরং ঘুমানোর ৩ থেকে ৪ ঘন্টা আগেই রাতের খাবার খেয়ে নেওয়া উত্তম
  • ঘুমানোর ১ থেকে ২ ঘন্টা পূর্বে অনেক বেশি পরিমাণে পানি পান করা উচিত নয়। কারণ এতে রাতে প্রস্রাবের বেগ তৈরি হবে যা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে
  • ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে কিছুক্ষণ সময় ধরে বই পড়া,‌ মৃদু শব্দে গান শোনা, যোগব্যায়াম করা ইত্যাদি ঘুমের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।

দীর্ঘমেয়াদী ঘুমের সমস্যা নিরাময়ের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘুমের ওষুধ খাওয়া লাগতে পারে। সেই সাথে শারীরিক কোনো রোগের প্রভাবে ঘুমের সমস্যা হলে সেই রোগের চিকিৎসা করতে হবে। আর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য নিয়মিত কাউন্সেলিং গ্রহণ এবং মেডিটেশন করা উপকারী ভূমিকা হবে।

References

Hullett, A. (2023, January 03). Signs You May Have Insomnia. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/insomnia/do-i-have-insomnia

Mawer, R. (2023, February 23). 17 Proven Tips to Sleep Better at Night. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/17-tips-to-sleep-better

Last Updated on June 6, 2023