নামটা শুনতে সুন্দর মনে হলেও রোগটা কিন্তু ততোই বাজে। হ্যাঁ, বলছি পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে ঘা হওয়ার রোগ নিয়ে। আমরা অনেকে বলি, আঙ্গুলের চিপায় ঘা হয়েছে। রোগটা সাধারণত ছেলেদেরই বেশি হয়। অনেক সময় পায়ের তলায় এবং গোড়ালিতেও সংক্রমণ হয়। তখন পায়ের তলা বা গোড়ালি ফেটে মরা চামড়া তৈরি হয়। আজ আমরা এথলেটস ফুটস এর কারণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করবো। 

এথলেটস ফুটস বা টিনিয়া পেডিস কী?

 

আঙ্গুলের ফাকে এথলেটস ফুটস

 

ত্বকের উপরিভাগে, চুলে, বা নখের কোথাও ছত্রাকের সংক্রমণ হলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় টিনিয়া। আর এই সংক্রমণ পায়ে হলে তাকে বলা হয় ‘টিনিয়া পেডিস’। টিনিয়া পেডিস মূলত ট্রাইকোফাইটন রুবরাম (Trichophyton rubrum) নামক এক প্রকার ফাঙ্গাসের কারণে হয়। আর এই টিনিয়া পেডিসের সাধারণ নাম হলো এথলেট’স ফুটস। 

ফাঙ্গাল সংক্রমণ কোথায় হয়েছে তার উপর নির্ভর করে এথলেট ফুটস কয়েক রকম হতে পারেঃ 

১। দুই আঙ্গুলের ফাঁকে (সাধারণত ৩/৪ এবং ৪/৫ নম্বর আঙ্গুলের ফাঁকে বেশি হয়) 

২। পায়ের তলায় এবং গোড়ালিতে (পায়ের তলার চামড়া শক্ত হয়ে শুকিয়ে ফেটে যায়) 

দুই আঙ্গুলের ফাঁকে যখন ঘা হয় তখন শুধু ফাঙ্গাল বা ছত্রাকের সংক্রমণই হয় না। সাথে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণও হয়।

পায়ের তলা এবং গোড়ালিতে এথলেটস ফুটস

কী কারণে এথলেটস ফুটস হয়?

সাধারণত বলা হয় গরমকালে ও আর্দ্র স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় ছত্রাকের সংক্রমণ বেশি হয়। তবে এথলেটস ফুট বছরের যেকোন সময়েই হতে পারে। নিচে এথলেটস ফুটস এর কিছু কারণ দেওয়া হলোঃ 

  • সারা দিন জুতা পরার কারণে পা ঘেমে গেলে 
  • সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি আক্রান্ত হলে (এটি ছোঁয়াচে) 
  • খালি পায়ে হাঁটলে 
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে
  • এলার্জি, ডারমাটাইটিস অথবা একজিমা থেকেও ফাঙ্গাল সংক্রমণের সূচনা হতে পারে 
  • দীর্ঘদিন এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে ব্যকটেরিয়ার নরমাল ফ্লোরা নষ্ট হয়ে ছত্রাকের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে এথলেটস ফুটস হতে পারে। 
  • বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে, ফলে এথলেটস ফুটস হতে পারে। 

আরও পড়ুনঃ পায়ের নখের ফাঙ্গাস থেকে মুক্তির ১৫টি ঘরোয়া চিকিৎসা 

কাদের এথলেটস ফুটস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি?

পুরুষদের ক্ষেত্রে এথলেটস ফুটস হবার সম্ভাবনা নারীদের থেকে বেশি। সাধারণত পুরুষরা বেশি টাইট ফিটিং জুতা পরিধান করে এবং ঘামে। ফলে এথলেটস ফুটস হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পুরুষদের ঘাম থেকে নিঃসৃত টেস্টোস্টেরন হরমোন ফাঙ্গাল গ্রোথের জন্য বেশি উপযোগী। পুরুষদের শরীর থেকে অতিরিক্ত সেবাম নিঃসৃত হয়, ফলে তৈলাক্ত পরিবেশে ফাঙ্গাল সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। 

আপনার ব্লাড সুগার বেশি হলে বা ডায়াবেটিস থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। কেননা এসব ক্ষেত্রে এথলেটস ফুটস থেকে সেকেন্ডারি ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। 

এথলেটস ফুটের উপসর্গগুলো কী কী?

  • আঙ্গুলের ফাকে ঘা

সাধারণত ৩/৪ অথবা ৪/৫ নম্বর আঙ্গুলের ফাঁকে চুলকানি দিয়ে শুরু হয়। তবে অন্য কোন আঙ্গুলের ফাঁকেও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে চুলকানিযুক্ত ফুসকুড়ি বা ফোস্কা তৈরি হয়। ফোসকা বা ফুসকুড়ি ফেটে দিলে সংক্রমণের তীব্রতা আরও বেড়ে যেতে পারে। 

অনেক সময় চামড়া ফেটে গেলে ব্যাথাও হতে পারে। তখন পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে ঘা হতে দেখা যায়। এই অবস্থায় চুলকানো উচিত নয়। অন্যথায় সেকেন্ডারি ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।  

  • পায়ের তলা শুকিয়ে ঝরে পড়া

পায়ের তলায় অথবা পাশে চামড়ার শুষ্কতা এবং স্কেলিং হতে পারে। (Papadakis, M. A. 2019). 

পা ফুলে লাল হয়ে গেলে বুঝতে হবে ব্যকটেরিয়া দ্বারা সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয়েছে। এই অবস্থায় অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। 

এথলেটস ফুটস এর চিকিৎসা কী?

এথলেটস ফুটস এর চিকিৎসার ব্যপারে কথা বলার আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে নেওয়া ভালো। চিকিৎসা করালেও এথলেটস ফুটস বার বার ফিরে আসতে পারে। তাই শুধু চিকিৎসা নয়, প্রতিরোধের জন্যও নিয়ম মেনে চলতে হবে। 

এথলেটস ফুটস এর চিকিৎসা সাধারণত এন্টিফাঙ্গাল বা ছত্রাকরোধী ওষুধ দিয়ে করা হয়। এন্টিফাঙ্গাল ওষুধ দুই ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারেঃ

১। ক্রীম অথবা অয়েন্টমেন্ট হিসেবে

ক্রীম অথবা অয়েন্টমেন্ট প্রিপারেশনের সাথে সাধারণত স্টেরয়েড এবং এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল ওষুধও থাকে। স্টেরয়েড যুক্ত ক্রীম অথবা অয়েন্টমেন্ট দীর্ঘ দিন ব্যবহার করলে চামড়া পাতলা হয়ে যেতে পারে। তাই ক্রীম অথবা অয়েন্টমেন্ট ৪ সপ্তাহের বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। ৪ সপ্তাহের মধ্যে উন্নতি না হলে ডাক্তারের পরমার্শ নিন। 

২। মুখে খাওয়ার ওষুধ হিসেবে

মুখে খাওয়ার ওষুধ সাধারণত ট্যাবলেট এবং ক্যাপসুল আকারে পাওয়া যায়। ক্রীম বা অয়েন্টমেন্টের সাপ্লিমেন্ট হিসেবে মুখে খাওয়ার ওষুধ ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। 

যদি ব্যাকটেরিয়ার কারনে এই রোগ হয়, তাহলে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ওষুধ দেওয়া হয়। পা সবসময় পরিস্কার রাখা উচিৎ। যদি ফাঙ্গাস বা ছত্রাককে সম্পূর্ন নির্মূল না করা যায় তবে পুনরায় এই রোগ হতে পারে।

এথলেটস ফুটস এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের নাম

রোগটি যেহেতু ফাঙ্গাল সংক্রমণ তাই এন্টিফাঙ্গাল ক্রীম বা মুখে খাওয়ার ওষুধ ব্যবহার করা হয়। নিচে কিছু এন্টিফাঙ্গাল ওষুধের নাম এবং ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে সংক্রমণের সাথে চুলকানি থাকলে এন্টিহিস্টামিন ওষুধ ব্যবহার করা যাতে পারে। 

ক্রীম অথবা অয়েন্টমেন্ট 

১। Ciclopirox Olamine

ওষুধটি বাজারে Candirox®, Mycocure®, এবং Terbex® নামে কিনতে পাওয়া যায়। এটি প্রতিদিন ২ বার করে ৪ সপ্তাহের জন্য ব্যবহার করা হয়। 

২। Terbinafine

ওষুধটি বাজারে Derbicil®, Clopirox®, এবং Fungirox® নামে কিনতে পাওয়া যায়। এটি প্রতিদিন ২ বার করে ২ সপ্তাহের জন্য ব্যবহার করা হয়। 

৩। Butenafine

ওষুধটি বাজারে Butefin®, Tenafin®, এবং Fintop® নামে কিনতে পাওয়া যায়। এটি প্রতিদিন ২ বার করে ২ সপ্তাহের জন্য ব্যবহার করা হয়।

৪। Clotrimazole 

ওষুধটি বাজারে Afun®, Clarizole®, এবং Fungin® নামে কিনতে পাওয়া যায়। এটি প্রতিদিন ২ বার করে ২ – ৪ সপ্তাহের জন্য ব্যবহার করা হয়। 

৫। Econazole 

ওষুধটি বাজারে Econate®, এবং Ecoren® নামে কিনতে পাওয়া যায়। এটি প্রতিদিন ২ বার করে ২ – ৪ সপ্তাহের জন্য ব্যবহার করা হয়। 

৬। Miconazole 

ওষুধটি বাজারে Fungidal®, Miconex®, এবং Topicazole® নামে কিনতে পাওয়া যায়। এটি প্রতিদিন ২ বার করে ২ – ৪ সপ্তাহের জন্য ব্যবহার করা হয়। 

৭। Oxiconazole 

ওষুধটি বাজারে Oxifun® নামে কিনতে পাওয়া যায়। এটি প্রতিদিন ২ বার করে ২ – ৪ সপ্তাহের জন্য ব্যবহার করা হয়। 

৮। Tioconazole 

ওষুধটি বাজারে Conasyd®, ও Tycon® নামে কিনতে পাওয়া যায়। এটি প্রতিদিন ২ বার করে ২ – ৪ সপ্তাহের জন্য ব্যবহার করা হয়। 

মুখে খাওয়ার ওষুধ

১। Terbinafine

সংক্রমণের তীব্রতার উপর নির্ভর করে এই ওষুধটি ২৫০ মিগ্রা ট্যাবলেট হিসেবে সাধারণত ২ থেকে ৬ সপ্তাহের জন্য দিনে একবার করে নেওয়া হয়। বাজারে ওষুধটি মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট হিসেবে Derbicil®, Mycocure®, Terbex® ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। 

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াঃ গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল লক্ষণসমূহ যেমন বমি বমি ভাব এবং ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, স্বাদের পরিবর্তন এবং লিভারের সমস্যা হতে পারে। 

২। Itraconazole

এই ওষুধটি সাধারণত ২০০ মিগ্রা ট্যাবলেট অথবা ক্যাপসুল হিসেবে ২ থেকে ৪ সপ্তাহের জন্য দিনে এক বার করে নেওয়া হয়। বাজারে ওষুধটি মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল হিসেবে Azonox®, Itra®, Itrazen® ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। 

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াঃ গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল লক্ষণসমূহ যেমন বমি বমি ভাব এবং ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা এবং লিভারের সমস্যা হতে পারে। 

৩। Fluconazole

এই ওষুধটি ১৫০-৩০০ মিগ্রা ট্যাবলেট এবং ক্যাপসুল হিসেবে সাধারণত ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের জন্য সপ্তাহে একবার নেওয়া হয়। বাজারে ওষুধটি মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল হিসেবে Afluzole®, Canazole®, Conaz® ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। (Freedberg, I. M., 2008). 

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াঃ গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল লক্ষণসমূহ যেমন বমি বমি ভাব এবং ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, ফুসকুড়ি এবং লিভারের সমস্যা হতে পারে। 

৪। Griseofulvin

এই ওষুধটি ৫০০ মিগ্রা ট্যাবলেট হিসেবে সাধারণত ৪ থেকে ৮ সপ্তাহের জন্য দিনে একবার নেওয়া হয়। বাজারে ওষুধটি মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট হিসেবে Afuvin®, Grisozen® ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। 

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াঃ গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল লক্ষণসমূহ যেমন বমি বমি ভাব এবং ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা এবং ত্বকের ফুসকুড়ি হতে পারে। 

এথলেটস ফুটস প্রতিরোধের উপায় কী?

এথলেটস ফুটের প্রতিরোধের উপায় হলো সচেতনতা। নিচে কিছু প্রতিরোধের উপায় দেওয়া হলোঃ 

১। পায়ে জুতা পড়া যাবে না। খোলা স্যান্ডেল পড়া ভালো 

২। নিয়মিত পা ধুয়ে শুকনো রাখতে হবে 

৩। পা খোলামেলা রাখতে হবে যেন সূর্যের আলো পরে। 

৪। নখ দিয়ে চুলকানো যাবে না। 

৫। রোগটি ছোঁয়াচে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। 

 

 

References

Papadakis, M. A., McPhee, S. J., & Rabow, M. W. (2019). Current Medical Diagnosis & Treatment. 58th edition. McGraw-Hill Education. Pages 121-122.

Freedberg, I. M., Eisen, A. Z., Wolff, K., Austen, K. F., Goldsmith, L. A., & Katz, S. I. (2008). Fitzpatrick’s Dermatology in General Medicine. 7th edition. McGraw-Hill Medical. Pages 1815-1818

 

Last Updated on April 10, 2023