দেশে গরম আবহাওয়ার সাথে যেন বেড়েই চলেছে মশার উৎপাত। সাথে হাসপাতালগুলোতে দিন দিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও। শুধু কী ডেঙ্গু? মশা থেকে ছড়ানো চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, জিকা ভাইরাসের মতো অসুখগুলোর সংক্রমণও আছে সাথে। ভয়ংকর এই মশার হাত থেকে বাঁচতে মশা মারার স্প্রে, কয়েল কত কিছুই না ব্যবহার করছে মানুষ। কিন্তু এগুলোর ক্ষতিকর ক্যামিকালও যে নীরবেই ক্ষতি করে চলেছে আমাদের পরিবারের স্বাস্থের। আর এই জন্যই মশা তাড়াতে এমন কোন প্রাকৃতিক উপাদান সম্বলিত পদ্ধতির খুব প্রয়োজন, যা মশার উৎপাত তো কমাবেই, ক্ষতি করবে না আমাদের স্বাস্থেরও।
টানা ৮ ঘন্টা ঘরে কয়েল জ্বালিয়ে রাখা হলে, সেটা প্রায় ১৪০ টি সিগারেটের সমান ধোয়া উৎপন্ন করতে পারে। যার ফলে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় আমাদের হার্ট, শ্বাসনালী এবং ফুসফুস।
Table of Contents
মশা তাড়ানোর কার্যকরী প্রাকৃতিক উপাদান
এমন কিছু পদ্ধতি আছে, যেগুলো ব্যবহার করলে মশা ঘেঁষবে না আপনার কাছে। পদ্ধতিগুলো সম্পূর্ণ ক্যামিকেল মুক্ত তো বটেই, উপাদানগুলোও পাবেন নিজের ঘরের মধ্যেই। জেনে নেই এমনই কয়েকটি কার্যকরী পদ্ধতি ও তাঁর উপাদানের কথা।
১. পুদিনার ব্যবহার
শুধু মশাই নয়, মশাসহ আরো অনেক ধরণের পোকামাকড়কে দূরে রাখার ক্ষমতা রয়েছে পুদিনা পাতার। কিছু পুদিনা পাতা ছেঁচে নিয়ে পানিতে ফুটিয়ে নিতে হবে। এরপর সেই পানির ভাপ ছড়িয়ে দিতে হবে সারা ঘরে। উল্লেখযোগ্য হারে ঘরে কমে যাবে মশা। জ্বাল দেয়া এই পানি বোতলে ভরে স্প্রে করেও ব্যবহার করা যাবে বেশ কিছুদিন। এর জন্য সেই পানির সাথে সমপরিমান রাবিং এলকোহল মিশিয়ে স্প্রে বোতলে রেখে দিতে পারেন।
এছাড়াও আরেকটি উপায় হলো, কিছু পুদিনা পাতা রোদে শুকিয়ে নিন। তারপর সেই শুকনো পাতাগুলি পাতলা কাপড় বা নেটের ছোট ছোট পুটলিতে বেধে ঝুলিয়ে দিন ঘরের বিভিন্ন কোনায়। পুদিনার গন্ধে দূরে থাকবে মশা।
২. লেবু ও লবঙ্গের ব্যবহার
এই পদ্ধতিতে মশা দূরে রাখতে চাইলে, একটি লেবুকে মাঝ থেকে দুই টুকরো করে কেটে নিতে হবে। তারপর লেবুর মাঝের নরম অংশে কয়েকটি লবঙ্গ গেঁথে দিতে হবে ভালো করে। এখন এই লবঙ্গ গাঁথা লেবুর টুকরোকে রাখতে পারেন ঘরের যেকোনো যায়গায়। চাইলে ঘরের কোনায় বা জানালার গ্রিলেও ঝুলিয়ে রাখতে পারেন। একবার লেবু রাখা হলে বেশ কয়েকদিন এর প্রভাবে ঘরে মশা দেখতে পাবেন না।
৩. নিমের তেলের ব্যবহার
ঘরে মশা ঢুকা হয়তো আটকাতে পারবে না এই নিমের তেল। তবে ঘরে-বাইরে যে কোন যায়গায় আপনার শরীরকে মশার জীবাণুযুক্ত কামড় থেকে সুরক্ষা দিবে নিমের তেলের ব্যবহার। নিমের তেলের সাথে ত্বকে ব্যবহার উপযোগী নারকেল তেল বা অলিভওয়েল কিংবা লোশন সমপরিমাণ মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে শরীরের ত্বকে। তবে নিমের তেলে কারো এলার্জি থাকলে, অথবা ব্যবহারের পর চুলকানি, জ্বালাপোড়া বা অস্বস্তি বোধ হলে নিমের তেলের ব্যবহার বাদ দিতে হবে।
৪. রসুনের স্প্রে
শরীরকে মশার জীবাণু থেকে দূরে রাখার আরেকটি কার্যকরী উপায় হচ্ছে, রসুনের স্প্রে। কয়েকটি রসুনের কোয়া ভালো করে ছেঁচে নিয়ে ত্বকে ব্যবহার উপযোগী নারকেল তেল বা অলিভওয়েলে ভিজিয়ে রাখুন পুরো ২৪ ঘণ্টা। ২৪ ঘণ্টা পর রসুনের নির্জাস সমৃদ্ধ তেলটি ভালো করে ছেঁকে নিন। এর পর এই তেলের সাথে পানি মিশিয়ে একটি স্প্রে বোতলে নিয়ে রাখুন এবং যখন প্রয়োজন শরীরে স্প্রে করে নিন।
তবে মনে রাখতে হবে, এই পদ্ধতি ব্যবহারে শরীরে রসুনের গন্ধ থেকে যেতে পারে। যদি কারো এই গন্ধ ভালো না লাগে, কিংবা রসুনের গন্ধ নিয়ে বাইরে বেরোতে না চান, তবে পদ্ধতিটি এড়িয়ে যেতে পারেন।
৫. চা পাতার ব্যবহার
চা কমবেশি সব বাসায়ই খাওয়া হয়। চা বানিয়ে খাওয়ার পর তার অবশিষ্ট চা পাতা ফেলে না দিয়ে রোদে শুকিয়ে রাখতে পারেন। এর জন্য সেই শুকিয়ে রাখা অবশিষ্ট চা পাতা পুড়িয়ে তাঁর ধোয়া ছড়িয়ে দিতে পারেন ঘরের আনাচে কানাচে।
৬. নারিকেলের আঁশ পোড়ানো
পাকা নারকেলের গায়ে যে আঁশ থাকে, যাকে প্রচলিত বাংলায় নারকেলের ছোবড়াও বলা হয়।
নারকেলের আঁশকে শুকিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে একটি কাঠের পাত্রে নিতে হবে। তারপর সেই পাত্রে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি ধরতে হবে। এর থেকে যে ধোয়া তৈরি হবে, সেই ধোয়া ঘরের বিভিন্ন কোনায় ছড়িয়ে দিতে পারলেই পালাবে মশা।
মশা তাড়ানোর গাছ
অনেকে ভাবেন ঘরে গাছপালা থাকলে মশা বেশি আসে। কথাটি আসলে পুরোটাই ভুল। দোষ গাছের না, বরং মানুষের। গাছের টবে জমাট পানি, অপরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি থেকে মূলত উৎপাত বাড়ে মশার। মজার ব্যপার হচ্ছে, এমন বেশ কিছু গাছ আছে, যেগুলোর উপস্থিতি ঘরে মশার যন্ত্রনাকে ব্যপক হারে কমিয়ে দিতে পারে। জেনে নেই এমনই কয়েকটি গাছের কথা।
১. ল্যাভেন্ডার
ঘরের সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি হালকা বেগুনী রঙা ফুলের ল্যাভেন্ডার গাছ মশা ও বিভিন্ন পোকামাকড় তাড়াতেও বেশ কার্যকরী। যার কারণ হচ্ছে এর তীব্র সুমিষ্ট গন্ধ। এই গন্ধ কিন্তু আসে মূলত ল্যাভেন্ডার গাছের পাতা থেকে। রৌদ্র আসে ঘরের এমন যায়গায় রেখে দিলেই ভালো থাকবে গাছটি। সাথে মশা মুক্ত থাকবে আপনার ঘরও।
২. গাঁদা
গাঁদা ফুল মূলত শীতকালের ফুল। তবে যত্নে রাখলে সারা বছরই অল্প স্বল্প ফুল ফুটতে থাকে এই গাছে। গাঁদা ফুলের গন্ধও দূরে রাখবে মশাকে।
ফুল বা সবজি বাগানে অনেক সময় গাঁদা ফুলের গাছ দিয়ে বাউন্ডারি দিতে দেখা যায়। এতে বাউন্ডারির ভেতরের গাছগুলি কীটপতঙ্গ থেকে নিরাপদে থাকে।
৩. সিট্রোনেলা ঘাস
সিট্রোনেলা নামটি অনেকের কাছে অপরিচিত লাগতে পারে। সিট্রেনেলার অপর নাম লেমন গ্রাস। তীব্র সুগন্ধের জন্য নানারকমের বাহারি রান্নায় ও চায়ে সাধারণত ব্যবহার হয়ে থাকে এই সিট্রেনেলা বা লেমন গ্রাস গাছের পাতা। এর আরও একটি গুণ রয়েছে। আর সেটা হচ্ছে মশার উৎপাত কমানো। ঘরের যে কোন যায়গায় কিছুটা বড় টবে লাগিয়ে রাখলেই হলো। আহামরি তেমন যত্ন ছাড়াই ভালো থাকতে পারে সিট্রোনেলা ঘাস বা লেমন গ্রাস।
৪. রোজমেরী
এই গাছটির নামও বেশি শোনা যায় খাবার দাবারের ক্ষেত্রেই। সুগন্ধিযুক্ত এই গাছের পাতা শুকিয়ে বিভিন্ন বিদেশী খাবারে মসলার মতো ব্যবহার করা হয়। খাবারে ব্যবহারের সাথে মশা ও বিভিন্ন পোকামাকড় তাড়াতেও বেশ কার্যকরী এই রোজমেরী গাছ। এই গাছেও লাগে না খুব বেশি যত্নআত্তি। বরং গরম ও শুকনো পরিবেশেও ভালো বেড়ে উঠে গাছটি। (Yoo, 2022)
তবে সবশেষে এই কথাটি না বললেই নয় যে, এই সব চেষ্টাই বৃথা হতে পারে যদি আপনার ঘরেই মশার বংশবিস্তার হতে থাকে। তাই সবার আগে খেয়াল রাখতে হবে, ঘরে আনাচে কানাচে, ছাদে বা গাছের টবে যেন জমাট বাঁধা পানির অস্তিত্ব না থাকে। এই সচেতনতার সাথে উপরে উল্লিখিত যে কোন ঘরোয়া পদ্ধতি ও মশাবিরোধী গাছ লাগানোর মাধ্যমে আপনার পরিবারকে দিন মশার হাত থেকে ১০০% সুরক্ষা।
References
Yoo C. (2022, January 6) 12 MOSQUITO REPELLENT PLANTS, Retrieved from Garden Design: https://www.gardendesign.com/plants/mosquito-repellent.html
Last Updated on May 30, 2023
Leave A Comment