অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার, ধুমপান করা, অথবা খেলাধুলার প্রতি আসক্তির মতোই একটি সমস্যা হলো খাদ্যের প্রতি অতিরিক্ত লোভ। বিশেষ করে টিনেজারদের ক্ষেত্রে ফাস্টফুড খাওয়ার প্রতি প্রচন্ড ইচ্ছা দেখা যায় যা মোটেও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস নয়। প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করার ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের প্রভাবে বিভিন্ন রোগব্যাধি হতে পারে। 

এই অনুচ্ছেদে খাদ্যের প্রতি লোভ সংবরণ এবং ক্ষুধা নিবারণের ৯টি কার্যকরী উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

১। পর্যাপ্ত ক্যালরি গ্রহণ করুন

খাবার থেকে ক্যালরি (শক্তি) পাওয়া যায় যা শরীরের সব কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজন। শরীরে ক্যালরি ঘাটতি হলে ক্ষুধার অনুভূতি হয়। যার ফলে খাবার খাওয়ার প্রতি ইচ্ছা জাগে। প্রতিনিয়ত শরীরে ক্যালরির অভাব থাকলে তাদের ক্ষেত্রে খাদ্যের প্রতি লোভ অথবা আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি দেখা যায়। (Kubala, 2021) 

শরীরের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি নয় এমন ব্যক্তিদের জন্য দৈনিক ক্যালরি চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত খাবার খেতে হবে। তবে যাদের শরীরের ওজন বেশি এবং ওজন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন তাদের জন্য দৈনিক ক্যালরি চাহিদার তুলনায় কিছুটা কম খাবার খেতে হবে এবং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে।   

সাধারণত একজন পুরুষের জন্য দৈনিক ২০০০ ক্যালরি আর মহিলাদের জন্য ১৬০০ ক্যালরি গ্রহণের প্রয়োজন হয়। তবে বয়স, শরীরের ওজন ও পরিশ্রমের ধরন ভেদে ক্যালরি চাহিদা কম-বেশি হয়ে থাকে।  

২। বেশি ক্ষুধা লাগিয়ে খাবেন না

অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই দেখা যায় শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু সময় না খেয়ে থাকেন। কিন্তু পরবর্তী ক্ষুধা অনেক বেড়ে গেলে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনেক বেশি খাবার খেয়ে ফেলেন। 

বেশি ক্ষুধার্ত হলে অতিরিক্ত খাদ্য খাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। তাই এমন ধরনের খাবার খেতে হবে যেন পেট ভরা থাকে অর্থাৎ ক্ষুধা মিটবে কিন্তু সেই খাবারে ক্যালরির পরিমাণ বেশ কম থাকে।

যেমনঃ আঁশযুক্ত খাবার (যবের ছাতু, বাদামী চালের ভাত, লাল আটার তৈরি খাবার, ওটস ইত্যাদি), ফলমূল (অধিক মিষ্টিজাতীয় নয়), শাকসবজি ইত্যাদি খুব কম ক্যালরি সম্পন্ন খাবার যা খেলে পেট ভরবে কিন্তু ক্যালরি বেশ কম পাওয়া যায়। 

৩। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করুন 

শরীরের পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য এমন খাবার গ্রহণ করতে হবে যেগুলো পুষ্টিগুণ সম্পন্ন তবে কম ক্যালরি সরবরাহ করে। এই জাতীয় খাবারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো আঁশযুক্ত শর্করা, স্বাস্থ্যকর প্রোটিন, বাদাম, বীজ, শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি। 

শাকসবজি থেকে সবচেয়ে কম ক্যালরি তবে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেল ও এন্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়ার জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি (বিভিন্ন বর্ণের) রাখতে হবে। যতটা সম্ভব কাঁচা অবস্থায় (সালাদ হিসেবে) অথবা কম তাপে রান্না করে শাকসবজি খেতে হবে।

স্বাস্থ্যকর প্রোটিন বলতে মাছ, মুরগির মাংস, ডিম, ফ্যাট-ফ্রি দুধ, ডাল ইত্যাদি বোঝানো হয়। প্রোটিন জাতীয় খাবার থেকে তুলনামূলক কম ক্যালরি পাওয়া যায় এবং পেশীর গঠন ঠিক রাখতে সাহায্য করে। 

প্রোটিন হজম ও মেটাবলিসমের ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগে যার ফলে দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা থাকে।   

অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত প্রোটিন খাওয়া যাবে না। যেমনঃ মুরগির চামড়া, গরু ও খাসির মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার ইত্যাদি। ফ্যাট (তেল ও চর্বি) যতটা সম্ভব কম খেতে হবে। কারণ ফ্যাট অনেক বেশি ক্যালরি সম্পন্ন।

৪। পছন্দের খাবার খান 

eat healthy food

প্রিয় খাবার একবারে খাওয়া বাদ দিতে না পারলে যতটা সম্ভব কম খেতে চেষ্টা করুন। শুরুতেই একদম বাদ দিতে গিয়ে অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, সেই খাবারের প্রতি আকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে গেছে। যার ফলে পরবর্তীতে অধিক পরিমাণে খাবার গ্রহণের প্রবণতা দেখা যায়।

আপনার পছন্দের খাবার যদি হয় স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী তবে সেগুলো বাদ দিতে হবে না। যেমনঃ যাদের মৌসুমী ফলমূল খেতে ভালো লাগে তাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে মৌসুমী ফলমূল খাওয়া যাবে। তবে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ভয় থাকলে মিষ্টিজাতীয় ফল পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। 

৫। অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার বাদ দিন 

খুব বেশি সুস্বাদু খাবার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সুস্বাদু খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে খাবার গ্রহণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ অতিরিক্ত পরিমাণে খাবার গ্রহণ করা হয় যা শরীরের ওজন বাড়িয়ে দিতে পারে।  

মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়েছে, ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় সুস্বাদু খাবারের তালিকার শুরুর দিকে স্থান পায়। কিন্তু এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাবার হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

৬। কার্বোহাইড্রেট খাওয়া কমিয়ে দিন

কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার (ভাত ও রুটি) দ্রুত শরীরে ক্যালরি সরবরাহ করে এবং ঘন ঘন ক্ষুধার অনুভূতি জাগ্রত করে।

তাই খাদ্যতালিকায় কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার যতটা সম্ভব কম রাখতে হবে এবং এর পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর প্রোটিন, ফাইবার সমৃদ্ধ শর্করা, ফলমূল ও শাকসবজি রাখতে হবে।

ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এই জাতীয় খাবার দাঁতের ক্ষয় সহ শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই শিশুদের চিনি ও মিষ্টিজাতীয় (যা সরল শর্করা) খাবার বর্জনের জন্য উৎসাহ দিতে হবে।  

৭। স্ট্রেস ম্যানেজ করুন 

yoga

মানসিক চাপের ফলে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে যাকে স্ট্রেস ইটিং (Stress eating) বলা হয়। এছাড়াও মানসিক চাপের ফলে কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ বেড়ে যায় যা ক্ষুধার অনুভুতি ও শরীরের ওজন বাড়িয়ে দিতে পারে। (Cleveland Clinic, 2023)  

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। বিশেষ করে ইয়োগা ও মেডিটেশন করার মাধ্যমে মানসিক চাপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। 

মানসিক চাপ জনিত অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ প্রতিরোধের জন্য সঠিক সময়সূচি মেনে খাবার খেতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে এবং পরিমিত মাত্রায় চা ও কফি পান করা উপকারী হতে পারে। 

এছাড়াও নিজের খাবার নিজেই রান্না করা, দৈনিক ক্যালরি চাহিদা অনুযায়ী খাবার খাওয়া এবং মদ্যপানের অভ্যাস বর্জন করতে হবে। মানসিক চাপ দূর করার জন্য প্রয়োজনে সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে।

৮। পর্যাপ্ত ঘুমান

শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমানো জরুরী। প্রতিদিন ৭ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুমাতে হবে। 

রাতে ভালো ঘুম না হলে ক্ষুধা বেড়ে যায়। অর্থাৎ বেশি খাবার গ্রহণের প্রবণতা সৃষ্টি হয় যার ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। 

ভালো ঘুম নিশ্চিত করার জন্য বিছানা ও ঘরের পরিবেশ আরামদায়ক হতে হবে। চা ও কফি পান সীমিত করতে হবে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর চা ও কফি পান করা যাবে না। আর রাতের খাবার সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ৯ টার মধ্যে খেতে হবে। 

৯। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন 

ক্ষুধা নিবারণ সহ সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী। যাদের শরীরের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি তাদের ক্ষুধাও বেশি থাকে। তাই খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়াম করার মাধ্যমে শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখতে হবে।   

থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা বিশেষ করে হাইপোথাইরয়েডিজম বা শরীরের অন্য কোনো রোগের কারণে ওজন বেড়ে গেলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। 

References

Cleveland Clinic. (2023, March 01). You Guessed It: Long-Term Stress Can Make You Gain Weight. Retrieved from Cleveland Clinic: https://health.clevelandclinic.org/stress-and-weight-gain/

Kubala, J. (2021, June 02). 12 Effective Ways to Manage Food Cravings. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/how-to-stop-food-cravings

Last Updated on January 1, 2024