স্থানীয় খাদ্য বলতে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার খাবার বোঝানো হয়। কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় (McGill University) প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, খাবার উৎপাদন বা তৈরির স্থান হতে পার্শবর্তী ১০০ মাইল দূরত্ব পর্যন্ত সেটা স্থানীয় খাবার হিসেবে বিবেচিত হবে।

এই অনুচ্ছেদে স্থানীয় খাবার বলতে আপনার আশেপাশের বাজারে কিনতে পাওয়া খাদ্য (সুপার শপ, অনলাইন শপ ও প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলো স্থানীয় খাবারের অন্তর্ভুক্ত নয়) বোঝানো হয়েছে। স্থানীয় খাদ্য গ্রহণের ৭টি চমৎকার সুবিধা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।   

১। তরতাজা (Fresh)

স্থানীয় বাজারে কিনতে পাওয়া ফলমূল ও শাকসবজি বেশ তরতাজা বা সতেজ হয়ে থাকে। কারণ সরাসরি ক্ষেত বা গাছ থেকে সংগ্রহ করে কোনো প্রক্রিয়াজাত ছাড়াই অল্প সময়ের মধ্যে সেগুলো বাজারজাত করা হয়। 

মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দীর্ঘসময় ধরে সংরক্ষণ করা হয়েছে এমন খাবারের তুলনায় সতেজ খাবারের স্বাদ ও ফ্লেভার ভালো থাকে। 

বিশেষ করে মৌসুমী ফলমূল যেই নির্দিষ্ট সময়ে পাওয়া যায় সেই সময়ে এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপযোগী থাকে। তাই বিদেশি ফলের পরিবর্তে মৌসুমী ফল বেশি বেশি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

যেমনঃ গ্রীষ্মকালীন সময়ে পাওয়া ফলমূল রসালো প্রকৃতির হয়ে থাকে। এই সময়ে গরম অনেক বেশি থাকে, ঘাম হয় এবং শরীরে পানির চাহিদা পূরণের জন্য রসালো ফল উপকারী ভূমিকা পালন করে। 

২। নির্ভেজাল

সাধারণত স্থানীয় খাবারে কোনো কেমিক্যাল বা প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয় না। খাবারে প্রিজারভেটিভ দেওয়া হলে দীর্ঘসময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায় তবে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। 

স্থানীয় বাজারের পরিচিত বিক্রেতার কাছ থেকে খাবার কেনার সময় খাবারের উৎস সম্পর্কে সহজেই জানা যায়। অর্থাৎ নিরাপদ ও অর্গানিক খাদ্য কেনার সুযোগ রয়েছে।    

বিশেষ করে মাছ ও মাংসের ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজার থেকে কেনা সবচেয়ে নিরাপদ হবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ করা মাছ ও‌ মাংসের ক্ষেত্রে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।‌

ফার্মের মুরগি ও ডিমের তুলনায় দেশি ডিম ও দেশি মুরগির মাংস স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী হবে। 

আর দুধের ক্ষেত্রে সরাসরি ফার্ম থেকে সংগ্রহ করা গাভির দুধ সবচেয়ে নিরাপদ। 

অন্যদিকে প্যাকেটজাত বা কৌটায় দুধ সংরক্ষণের জন্য এন্টি-বায়োটিক সহ বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।   

৩। বেশি পুষ্টিকর 

স্থানীয় খাবার দীর্ঘসময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করার প্রয়োজন হয় না। উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যায়ে সরবারহ অল্প সময়ের মধ্যে হয়ে থাকে। কম সংরক্ষণ করা হয়েছে এমন (সতেজ) খাবারের পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন থাকে। 

বিশেষ করে ফলমূল ও শাকসবজির ক্ষেত্রে যত বেশি সময় সংরক্ষণ করার প্রয়োজন হয় তত বেশি হারে পুষ্টিগুণ (ভিটামিন ও এন্টি-অক্সিডেন্ট) কমে যেতে থাকে। (Streit, 2021) 

উদাহরণ স্বরূপ, সতেজ টমেটো থেকে যতটা পুষ্টিগুণ পাওয়া যাবে রেফ্রিজারেটরে দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ করা হয়েছে এমন টমেটো থেকে সমান অনুপাতে পুষ্টি পাওয়া যায় না। 

দুধ, মাছ ও মাংসের ক্ষেত্রে প্রিজারভেটিভ দিয়ে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন হয়। যার ফলে পুষ্টিগুণ কমে গিয়ে বরং শরীরের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান যোগ হয়।  

কৌটাজাত মাছ ও মাংস খাওয়া উচিত নয়। কারণ এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। 

৪। সহজলভ্য 

easy access

সুপার শপ ও অনলাইন শপের তুলনায় স্থানীয় বাজারের পণ্যসামগ্রী দামের দিকে দিয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী হয়ে থাকে। যেকোনো ধরনের খাদ্যদ্রব্য সহ প্রায় সকল পণ্যের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।  

স্থানীয় বাজারে ঘুরে ঘুরে বৈচিত্র্যময় খাদ্যদ্রব্য দেখে দাম যাচাই করে কেনাকাটা করা যায়। পক্ষান্তরে সুপার শপ বা অনলাইন শপে স্থানীয় বাজারের মতো এতো বেশি পণ্য থাকে না এবং দাম যাচাইয়ের সুযোগ নেই।

বিশেষ করে অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে ছবি দেখে খাবারের গুণগত মান ও সতেজ কিনা তা বোঝার কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু দামের ব্যাপারে ঠিকই অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।  

তাই কেনাকাটার জন্য (বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য) অনলাইনের তুলনায় স্থানীয় বাজার বেছে নেওয়া উত্তম। 

৫। পরিবেশবান্ধব 

স্থানীয় বাজারে কেনাকাটা করার ফলে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ ও স্থানান্তরের প্রয়োজন কম হবে। যার ফলে পরিবেশ দূষণ হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা কমে যাবে। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য নষ্ট হবে কম যা পরিবেশের জন্য উপকারী ভূমিকা রাখবে।

খাদ্যদ্রব্য প্যাকেটজাত করার জন্য প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে। প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পক্ষান্তরে স্থানীয় বাজার থেকে খাদ্যদ্রব্য কেনার জন্য নিজে ব্যাগ (পরিবেশ বান্ধব পাটের ব্যাগ) নিয়ে গেলে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কমে যাবে। 

৬। আঞ্চলিক অর্থনীতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে 

স্থানীয় খাদ্যদ্রব্য কেনার ফলে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। স্থানীয় কৃষকরা ভালো দাম পাবে এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তারা বেশ সচ্ছল হয়ে উঠবে। 

খাদ্যদ্রব্য উৎপন্ন হওয়ার পর যত বেশি দূর ঘুরে ভোক্তার কাছে পৌঁছাবে তত বেশি দাম বেড়ে যাবে। কিন্তু সেই তুলনায় যারা খাদ্য উৎপাদন করেন তারা বেশি টাকা পায় না। বরং মধ্যস্থতাকারীগণ বেশি মুনাফা নিয়ে থাকেন। তাই স্থানীয় বাজার তথা উৎপাদন স্থান থেকে যতটা সম্ভব কম দূরত্বের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য কেনার চেষ্টা করতে হবে।  

৭। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি 

fresh vegetables

কৃষক বা যারা খাদ্য উৎপাদন করেন তারা বেশি লাভবান হলে খাদ্য উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত টাকা ও উৎসাহ পাবে। এতে করে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে যাবে এবং খাবারের কোনো অভাব থাকবে না। বিভিন্ন ধরনের খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলে সবার জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা সহজ হবে।  

বিদেশী খাবারের (প্রক্রিয়াজাত খাবার ও ফলমূল) প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশি খাবার কেনা ও খাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হতে হবে। এতে করে দেশীয় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন হবে। 

স্থানীয় খাবারের অসুবিধা 

  • সাধারণত স্থানীয় বাজারগুলো জনবহুল হয়ে থাকে। যার ফলে কেনাকাটা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। 
  • কিছু কিছু বিক্রেতা বেশ চতুর প্রকৃতির হয়ে থাকে। যার ফলে ধোঁকায় পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 
  • পণ্যের দাম নির্ধারণ করা থাকে না। যার জন্য দামাদামি করার প্রয়োজন পড়ে। যারা দামাদামি করতে পটু নয় তাদের ক্ষেত্রে তুলনামুলক বেশি দাম দিয়ে পণ্য কেনার ঘটনা ঘটে।  
  • ব্র্যান্ড ভ্যালু ঠিক রাখার জন্য সুপার শপে সাধারণত খারাপ কোয়ালিটির খাদ্যদ্রব্য রাখা হয় না। যার জন্য কোয়ালিটি যাচাই করা প্রয়োজন পড়ে না। অন্যদিকে স্থানীয় বাজারে পণ্য কেনার জন্য কোয়ালিটি যাচাই করার মতো দক্ষতা থাকতে হয়।   

শেষ কথা 

খাদ্যদ্রব্য কেনার জন্য স্থানীয় বাজার তুলনামূলক সহজলভ্য, পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন রয়েছে এমন খাবার পাওয়া যায় এবং কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে স্থানীয় বাজারে কেনাকাটা করার জন্য দামাদামি করতে পারা এবং কোয়ালিটি যাচাই করার দক্ষতা থাকতে হবে। 

পক্ষান্তরে সুপার শপ ও অনলাইন শপে নির্ধারিত দামে পণ্য কেনা যায়। তবে পণ্য ততটা সতেজ হয় না এবং পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন থাকে না। এছাড়াও দাম তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। 

তাই বাজার করার দক্ষতা রপ্ত করতে হবে এবং স্থানীয় বাজার থেকে খাদ্য কেনার অভ্যাস করতে হবে। 

বাড়ির পাশে পড়ে থাকা জায়গায়, বাগানে অথবা বাসা বাড়ির ছাদে টবে শাকসবজি ও ফলমূল চাষ‌ করা যেতে পারে। এতে নিজের হাতে উৎপাদিত কীটনাশক মুক্ত ও সতেজ ফলমূল ও শাকসবজি পাওয়া যাবে।

References

McGill University. (n.d.). The benefits of eating local foods. Retrieved from McGill University: https://www.mcgill.ca/foodservices/sustainability/green/local

Streit, L. (2021, May 26). 7 Fantastic Benefits of Eating Local. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/why-eat-local-food

Last Updated on January 1, 2024