ম্যালেরিয়ায় (Malaria)শুধুমাত্র ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রায় ২৪১ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে যার মধ্যেকার ৬ লাখ ২৭ হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করেছেন। (World Health Organization, 2021) এটি রীতিমতো ভয়ঙ্কর একটি পরিসংখ্যান যা ভাবিয়ে তুলবে সবাইকে। তবে আশার কথা হলো এই যে, ম্যালেরিয়া সম্পূর্ণ প্রতিকার ও প্রতিরোধ যোগ্য একটি রোগ যার জন্য প্রয়োজন রোগ সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা।

এই অনুচ্ছেদে ম্যালেরিয়া কি, কিভাবে ছড়ায়, কি কি লক্ষণ দেখা দিতে পারে, কিভাবে রোগ নির্ণয় করা হয়, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ম্যালেরিয়া রোগীর খাদ্য তালিকা কেমন হওয়া উচিত সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কোনো ভ্যাকসিন (Vaccine) রয়েছে কিনা এবং ভ্যাকসিন ব্যতীত অন্য কি কি পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় তা অনুচ্ছেদের শেষের দিকে তুলে ধরা হয়েছে।

ম্যালেরিয়া কি? What is Malaria

ম্যালেরিয়া (Malaria) হলো পরজীবী ঘটিত একটি প্রাণঘাতী ব্যাধি যা মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীদের আক্রান্ত করতে পারে। এটি একটি মশাবাহিত সংক্রামক রোগ যা স্ত্রী এনোফেলিস (Anopheles) গোত্রের মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এছাড়াও প্রাণীদের ক্ষেত্রে ‘কিউলেক্স’ (Culex spp.) মশার কামড়েও এই রোগ হতে পারে।

মূলত এই রোগের জন্য দায়ী জীবাণু হলো প্লাসমোডিয়াম (Plasmodium) নামক পরজীবী যা সাধারণত স্ত্রী এনোফেলিস মশা বহন করে থাকে। অর্থাৎ এই মশা কামড়ালেই ম্যালেরিয়া হবে এমনটি নয়, বরং মশা যখন ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করে সেই সময়ে কামড়ালে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে থাকে।

উল্লেখ্য এনোফেলিস মশা সর্বদাই প্লাসমোডিয়াম বহন করে না, বরং ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে কামড়ানোর মাধ্যমে এই জীবাণু মশার শরীরে প্রবেশের সুযোগ পায়।

ম্যালেরিয়া জ্বরের লক্ষণ

প্লাসমোডিয়াম জীবাণু শরীরে প্রবেশের পর তা রক্তের মাধ্যমে লিভারে (Liver) পৌঁছায়। অতঃপর সেখানে বংশবিস্তার (Multiply) করে এবং পুনরায় আবার লিভার থেকে রক্তে প্রবেশ করে। আর তাই জীবাণু সংক্রমণের পর লক্ষণ প্রকাশ পেতে প্রায় ৭ থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ম্যালেরিয়ার লক্ষণ হিসেবে মূলত প্রচন্ড জ্বর ও শীতবোধ (Fever & Chills) দেখা যায় যা হঠাৎ করে কাঁপুনি দিয়ে শুরু হয়‌। জ্বর ছাড়াও আরো যে সমস্ত লক্ষণ গুলো থাকতে পারে তা হলোঃ

  • মাথা ব্যথা (Headache)
  • বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হয়
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ হয়
  • মাথা ঘোরানো (Vertigo) ও ঝিমুনি ভাব হতে পারে
  • শরীরে প্রচন্ড ঘাম হতে পারে
  • বমি বমি ভাব ও বমি
  • হৃদ কম্পন বেড়ে যায়
  • ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাস ইত্যাদি

ম্যালেরিয়ার জ্বরের ক্ষেত্রে বিশেষত্ব হলো এটি কিছুক্ষণ পরেই ঘাম দিয়ে ছেড়ে যায়। এই রোগের লক্ষণ গুলো সাধারণত ৬ থেকে ১০ ঘন্টা পর্যন্ত প্রবল থাকে এবং তার পরে কমে যায়। পরবর্তীতে ১ দিন পরে (Every second day) পুনরায় আবার জ্বর ও অন্যান্য লক্ষণ ফিরে আসে। (Lam, 2022) এমন পর্যায়ক্রমিক জ্বর দেখা দিলে ম্যালেরিয়া হয়েছে ধারণা করে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

উল্লেখ্য ম্যালেরিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ের কয়েকদিন পর থেকেই রক্তে লোহিত রক্ত কণিকা (RBC) কমতে শুরু করে যার ফলে এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। এছাড়াও জন্ডিস, লিভার ও স্প্লীন (Spleen) ফুলে যাওয়া, খিঁচুনি সহ চরম অবস্থায় রোগী কোমায় (Coma) চলে যেতে পারে।

ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ

Symptoms of malaria

ম্যালেরিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার 

ম্যালেরিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে বিচলিত হওয়া বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ যথাসময়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয়। এক্ষেত্রে রোগীর জন্য করণীয় বিষয়াবলী হলোঃ

✓ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষা (blood test) করে নিশ্চিত হতে হবে যে কোন ধরনের প্লাসমোডিয়ামের সংক্রমণ ঘটেছে। কারণ প্লাসমোডিয়ামের ধরন এবং রোগ লক্ষণের জটিলতার উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্নতর হয়ে থাকে।

✓ খুব বেশি অসুস্থ রোগী, শিশু বাচ্চা, প্রেগন্যান্ট মহিলা, ওষুধ খেতে কষ্ট হয় এমন ধরনের রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

✓ সাধারণ রোগীদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা ডাক্তার এর সন্নিকটে থাকা উচিৎ যেন অবস্থার অবনতি হয় কিনা তা চিকিৎসক বুঝতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী পরবর্তী চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু রাখবেন।

 

ম্যালেরিয়া রোগের ওষুধের নাম কি?

সবচেয়ে কমন ম্যালেরিয়া রোগের ঔষধের নাম গুলো নিচে উল্লেখ করা হলো। তবে কোনো অবস্থাতেই চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়া ওষুধ সেবন করা যাবে না। (Lam, 2022)

  • chloroquine
  • hydroxychloroquine
  • primaquine
  • artemisinin-based therapy
  • atovaquone-proguanil

 

ম্যালেরিয়া রোগীর খাবার

ম্যালেরিয়া রোগীদের জন্য একদম সুনির্দিষ্ট করে কোনো ডায়েট প্ল্যান বা খাদ্য তালিকা নেই। তবে এমন সব খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে কিন্তু পরিপাক তন্ত্র (Digestive system), লিভার ও কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে না। এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একবারে বেশি করে খাওয়া যাবে না বরং অল্প পরিমাণে ঘন ঘন খেতে হবে। (Mishra, 2017)

যা যা খাবেন: 

  • যে সমস্ত খাবার দ্রুত ক্যালরি সরবরাহ করে। যেমনঃ গ্লুকোজ, আখের রস, ফলের রস, ডাবের পানি, সরবত ইত্যাদি
  • দুধ, দই, লাচ্ছি, মাছ, মুরগির মাংস, ডিম ইত্যাদি
  • ভিটামিন এ ও সি সমৃদ্ধ খাবার। কলিজা, গাজর, ব্রোকলি, সরিষার শাক, মিষ্টি কুমড়া, লেটুস, টমেটো, আম, আঙুরের রস ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ রয়েছে। আর লেবু, কমলা, পেঁপে, মাল্টা, আঙ্গুর, স্ট্রবেরি ইত্যাদি থেকে ভিটামিন সি পাওয়া যায়।
  • এছাড়াও পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে।

যেগুলো খাবেন না: 

✓ রান্নায় অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করা যাবে না।

✓ প্রক্রিয়াজাত খাবার ও ফাস্টফুড বর্জন করতে হবে।

✓ অতিরিক্ত চা, কফি পানের অভ্যাস সীমিত করতে হবে এবং কার্বোনেটেড বেভারেজ বর্জন করা উচিত।

 

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের উপায়

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের উপায়

✓ মশার বাসস্থান ধ্বংস করতে হবে। বাড়ির আনাচে-কানাচে যেই সব জায়গায় পানি জমে থাকে (ফুলের টব, টিনের কৌটা, গাড়ীর টায়ার, ড্রেইন, গাছের কোঁটায়) তা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে যেন সেগুলোতে মশা কোনভাবেই ডিম দিয়ে বংশবিস্তার করতে না পারে।

✓ মশার উপদ্রব কমানোর জন্য মশা বেশি রয়েছে এমন জায়গায় ওষুধ, স্প্রে, অথবা কেরোসিন ছিটিয়ে দিতে হবে।

✓ এনোফিলিস গোত্রের মশা সাধারণত রাতের বেলায় কামড়ায়। আর তাই রাতের বেলায় মশারী টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। এছাড়াও আক্রান্ত রোগীর জন্য অবশ্যই আলাদা মশারির ব্যবস্থা করতে হবে।

✓ ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চলে ভ্রমণের পূর্বে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে এন্টিম্যালেরিয়াল (Antimalarial) ওষুধ গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়াও এইসব জায়গা থেকে ভ্রমণ শেষ করে বাড়ি ফেরার পর পরই কাউকে রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

✓গণ সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সরকারি, বেসরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

 

মনে রাখবেন, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। ম্যালেরিয়ার বাহক মশা যেন জন্মাতে না পারে অথবা ছড়াতে না পারে সেজন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে করে ম্যালেরিয়া সহ সব ধরনের মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে যদি ম্যালেরিয়া হয়েই যায়, সেক্ষেত্রে বিচলিত না হয়ে সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

 

ম্যালেরিয়া সম্পর্কিত প্রশ্ন উত্তর

। ম্যালেরিয়া কোন ভাষার শব্দ? 

ম্যালেরিয়া (Malaria) শব্দটি “mala aria” ইতালীয় শব্দ থেকে এসেছে যা দ্বারা বোঝানো হয় bad air বা খারাপ বাতাস। লুই পাস্তুরের জীবাণুবাদ মতবাদ (germ theory) আবিষ্কারের আগে মনে করা হতো যে একধরনের খারাপ বাতাসের প্রভাবে এই রোগ হয়ে থাকে আর তাই ম্যালেরিয়া নামকরণ করা হয়েছে। তবে পরবর্তীতে এটি একটি জীবাণু ঘটিত রোগ হিসেবে আবিষ্কৃত হলেও এর নাম পরিবর্তন করা হয় নি। (Centers for Disease Control and Prevention, 2015)

২। ম্যালেরিয়ার জীবাণু কে আবিষ্কার করেন? 

Alphonse Laveran নামক একজন চিকিৎসক ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কার করেন। সেই সময় তিনি আলজেরিয়ার (Algeria) একটি মিলিটারি হাসপাতালে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। উল্লেখ্য Alphonse Laveran ১৮ জুন, ১৮৪৫ সালে প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন।

৩। ম্যালেরিয়া কাদেরকে বেশি affect করে?

ম্যালেরিয়া যে কোনো বয়সের মানুষকে আক্রমিত করতে পারে। তবে কতিপয় ক্ষেত্রে সম্ভাবনা অনেক বেশি রয়েছে। যেমনঃ

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম
  • ৫ বছর বয়সের নিচের শিশু বাচ্চা
  • গর্ভবতী মহিলা (Pregnant)
  • HIV/AIDS আক্রান্ত রোগী
  • যারা বেশি বেশি ভ্রমণ করেন
  • যাদের আগে কখনো ম্যালেরিয়া হয় নি এমন ব্যক্তি ইত্যাদি

৪। এই রোগ কোন অঞ্চলে বেশী হয়? 

বৃষ্টিপাত, উষ্ণ তাপমাত্রা এবং স্থির পানি হলো মশার ডিমের জন্য আদর্শ আবাসস্থল। তাই উপ‌-গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল, ক্রান্তীয় অঞ্চল, সাহারা অঞ্চল, নিম্ন আফ্রিকা, এশিয়া এবং অ্যামেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এই রোগ ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। বাংলাদেশে বর্ষা এবং গরমকালে, পাহাড়ী অঞ্চলে এই রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে।

৫। ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণুর নাম কি?

মানব দেহে ৫ প্রজাতির প্লাসমোডিয়াম প্রবেশ করতে পারে এবং সংক্রমণ ঘটাতে পারে। যেমনঃ

  1. Plasmodium Falciparum
  2. Plasmodium Vivax
  3. Plasmodium Malariae
  4. Plasmodium Ovale
  5. Plasmodium Knowlesi

বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের মধ্যে ম্যালেরিয়া হয়ে থাকে Plasmidium Vivax এবং Plasmodium Falciparum এর কারণে।

৬। সবচেয়ে মারাত্মক ম্যালেরিয়া হয় কোন প্লাসমোডিয়াম দ্বারা?

Plasmodium Falciparum এর কারণে সবচেয়ে মারাত্মক ম্যালেরিয়া হয়ে থাকে এবং এই ম্যালেরিয়াতে মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। মাঝামাঝি ধরনের ম্যালেরিয়া হয় Plasmodium Vivax এবং Plasmodium Ovale এর কারণে।

৭। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কোনো ভ্যাকসিন রয়েছে কি?

সাম্প্রতিক সময়ে (৬ অক্টোবর,‌ ২০২১) ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে RTS, S নামের একটি ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এটি মূলত Plasmodium falciparum জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম যা সবচেয়ে জটিল প্রকৃতির ম্যালেরিয়ার সৃষ্টি করে থাকে। দুঃখজনক একটি বিষয় হলো, এই ভ্যাকসিনটি এখনো সারাবিশ্বে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি, বরং শুধুমাত্র আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চলের শিশুদের জন্য এটি নির্দেশিত হয়ে থাকে। (World Health Organization, 2021)

 

 

 

References

Centers for Disease Control and Prevention. (2015, september 15). Laveran and the Discovery of the Malaria Parasite. Retrieved from CDC: https://www.cdc.gov/malaria/about/history/laveran.html

Lam, P. (2022, 1 26). What to know about malaria. Retrieved from Medical News Today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/150670

World Health Organization. (2021, 12 6). Malaria. Retrieved from WHO: https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/malaria

 

Last Updated on October 31, 2023