পেটের ডান পাশে নিচের দিকে ব্যথা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনে করা হয় যে, অ্যাপেন্ডিসাইটিস (Appendicitis) হয়েছে। বস্তুত আরো অন্যান্য অনেক কারণেই এমন ব্যথার অনুভূতি হতে পারে। এই অনুচ্ছেদে পেটের ডান পাশে ব্যথা হওয়ার সম্ভাব্য ১৬ টি কারণ, ব্যথা হলে করণীয় কি, কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
নীচের ডান পেটে ব্যথার কারণ কী?
পেট বা উদরগহ্বরের ভেতর অনেক গুলো অঙ্গ রয়েছে। যেমনঃ লিভার বা যকৃত, পিত্তথলি, পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয়, অ্যাডরেনাল গ্ল্যান্ড, স্প্লিন বা প্লীহা, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র, কিডনি, মূত্রনালী এবং মূত্রথলি। এছাড়াও পুরুষদের ক্ষেত্রে রয়েছে প্রস্টেট গ্রন্থি আর মহিলাদের ক্ষেত্রে রয়েছে জরায়ু, ডিম্বাশয়, ফ্যালোপিয়ান টিউব ইত্যাদি। পেটের ডান পাশের নিচের দিকের অংশটা জুড়ে রয়েছে বৃহদান্ত্রের অংশবিশেষ (অ্যাসেন্ডিং কোলন) সহ অ্যাপেনডিক্স, জরায়ু, ডান পাশের ডিম্বাশয় ও ফ্যালোপিয়ান টিউব। নীচের দিকে ডান পেটের অঙ্গগুলো সহ আরো যেসব বিষয় ব্যথা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে তা হলোঃ (Scaccia, 2022)
অ্যাপেন্ডিসাইটিস (Appendicitis)
অ্যাপেনডিক্স হলো বৃহদান্ত্রের সাথে সংযুক্ত ছোট্ট টিউবের মতো একটি অংশ যেখানে প্রদাহের (Inflammation) সৃষ্টি হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় অ্যাপেন্ডিসাইটিস বলা হয়। পেটের ডান পাশে নিচের দিকে ব্যথা হওয়ার সবচেয়ে কমন কারণ হলো অ্যাপেন্ডিসাইটিস যা যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে হতে পারে। তবে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের ক্ষেত্রে অধিক সম্ভাবনা রয়েছে। অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর ক্ষেত্রে ব্যথা ছাড়াও আরো যেসব লক্ষণ থাকতে তা হলো- বমি বমি ভাব, বমি, জ্বর, পেট ফুলে যাওয়া ইত্যাদি।
বদহজম (Indigestion)
খাবার খাওয়ার বা কোনো কিছু পান করার পর পেটের মধ্যে স্বাভাবিক হজম প্রক্রিয়ায় ব্যঘাত ঘটার ফলে অস্বস্তি বোধ, পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব, টক ঢেঁকুর উঠা ইত্যাদি হলো বদহজমের লক্ষণ। অধিক পরিমাণে আহার করা, দ্রুত খাবার খাওয়া, অতিরিক্ত মশলা ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ ইত্যাদির কারণে বদহজম হয়ে থাকে। এছাড়াও পেটে খাবার ঠিকমতো হজম না হলে গ্যাস জমে যায় যার ফলে পেটে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। আবার ঠিকমতো পায়খানা না হলে অর্থাৎ কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থেকেও পেটে ব্যথা হতে পারে।
অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ (Pancreatitis)
ধুমপান ও মদ্যপায়ী ব্যক্তি এবং যাদের শরীরের ওজন অতিরিক্ত বেশি তাদের ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ বা Pancreatitis হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে। সাধারণত অগ্নাশয়ের ব্যথা পেটের উপরের দিকে শুরু হয় এবং পরে পেটের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে ব্যথা ছাড়াও জ্বর, বমি বমি ভাব, বমি, পালস বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
কিডনি ইনফেকশন (Kidney infection)
মানুষের শরীরের ডান ও বাম পাশে দুইটি কিডনি রয়েছে। সাধারণত প্রস্রাবের ইনফেকশন থেকে ব্যাকটেরিয়া কিডনিতে আক্রমণ করার ফলে কিডনি ইনফেকশন হয়ে থাকে। এটি একটি গুরুতর সমস্যা যার ফলস্বরূপ কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পেটের ডান পাশ, কুচকি ও কোমরে ব্যথা সহ জ্বর, শীতবোধ, বমি, ঘন ঘন প্রস্রাব, প্রস্রাবের রং ও গন্ধ অস্বাভাবিক ইত্যাদি লক্ষণ সমূহ কিডনি ইনফেকশনকে ইঙ্গিত করে।
কিডনিতে পাথর (Kidney stones)
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করেন না এমন মানুষদের ক্ষেত্রে কিডনিতে পাথর হওয়া একটি কমন ঘটনা। শরীরের ডান পাশের কিডনিতে পাথর হলে সেক্ষেত্রে ব্যথা সাধারণত ডান পাশে পেটের নিচের দিকে হয়ে থাকে। এছাড়াও পিঠের নিচের দিকে ব্যথা, বমি বমি ভাব, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
হার্নিয়া (Hernia)
পেরিটোনিয়াম নামক পেটের প্রাচীর দুর্বল হয়ে পড়লে তখন পেটের মধ্যকার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রাচীর ভেদ করে বেরিয়ে ফোলাভাব তৈরী করে যাকে মেডিকেলের ভাষায় হার্নিয়া (Hernia) বলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হার্নিয়া পেটে হয়ে থাকে এবং ফোলা স্থানে তীব্র ব্যথা হয়। সাধারণত ভারী বস্তু উত্তোলন করলে অথবা হাঁচি ও কাশি দিলে তখন ফোলাভাব দেখা যায় এবং সেই সাথে ব্যথা বোধ হয়ে থাকে।
আইবিএস (IBS- irritable bowel syndrome)
আইবিএস একটি দীর্ঘমেয়াদী পেটের রোগ যার প্রকৃত কারণ এখনো অজানা। মাঝে মধ্যেই পেটে ব্যথা সহ কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটে গ্যাস জমে যাওয়া, ডায়রিয়া, মলের সাথে মিউকাস নিঃসরণ হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ গুলো আইবিএস রোগ নির্দেশ করে থাকে।
আইবিডি (IBD- Inflammatory bowel disease)
আইবিডি হলো প্রদাহজনিত দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগ যা কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। আইবিডি রোগের লক্ষণ হলো দীর্ঘদিন ধরে পেটে ব্যথা, পেট ফোলাভাব, পাতলা পায়খানা, মলের সাথে রক্ত যাওয়া, শরীরের ওজন কমতে থাকা ইত্যাদি।
পিরিয়ডের ব্যথা (Dysmenorrhea)
প্রজননক্ষম প্রত্যেক নারীর প্রতিমাসে পিরিয়ড হয়ে থাকে যাদের অনেকের ক্ষেত্রেই আবার পিরিয়ডের সময় তীব্র ব্যথা অনুভূত হয় যাকে মেডিকেলের ভাষায় ডিসমেনোরিয়া বলা হয়। ব্যথা সাধারণত তলপেটে হয়ে থাকে। তবে তলপেট ছাড়াও ব্যথা পেটের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, খাওয়ার প্রতি অনীহা ইত্যাদি।
আরও পড়ুনঃ পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর ঘরোয়া উপায় সমূহ
এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis)
জরায়ুর প্রাচীর তিনটি স্তর নিয়ে গঠিত, যার সবচেয়ে ভেতরের স্তরকে বলা হয় এন্ডোমেট্রিয়াম। এন্ডোমেট্রিওসিস হলো একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ যেখানে এন্ডোমেট্রিয়ামের কোষ বা টিস্যু জরায়ুর বাইরে, যেমন ডিম্বাশয়, পেরিটোনিয়াম, লিগামেন্ট, অন্ত্র ইত্যাদিতে বাসা বাঁধে। সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মহিলাদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়। এন্ডোমেট্রিওসিসের প্রধান লক্ষণ হলো মাসিকের সময় তলপেটে তীব্র ব্যথা।
ওভারিতে সিস্ট (Ovarian cyst)
জরায়ুর দুই পাশে দুইটি ওভারি থাকে যেখানে সিস্ট হলে তাকে ওভারিয়ান সিস্ট বলা হয়। সাধারণত ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সের নারীদের ক্ষেত্রে ওভারিতে সিস্ট হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি থাকে। ডান পাশের ওভারিতে সিস্ট হলে পেটের ডানপাশে নীচের দিকে ব্যথা হয়। সেই সাথে আরো যেসব লক্ষণ থাকতে পারে তা হলো- অনিয়মিত পিরিয়ড হওয়া, পিরিয়ডের সময় অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ এবং শরীরের ওজন বাড়তে থাকা।
একটোপিক প্রেগনেন্সি (Ectopic pregnancy)
সদ্য গর্ভধারণ করেছেন এমন মহিলাদের ক্ষেত্রে পেটের ডান পাশে ব্যথা হলে তা একটোপিক প্রেগন্যান্সির ফলে হতে পারে।নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত না হয়ে জরায়ুর বাইরে বা ফ্যালোপিয়ান টিউবে প্রতিস্থাপিত হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় একটোপিক প্রেগন্যান্সি বলা হয়। প্রস্রাব ও মলত্যাগ করার সময় একটোপিক প্রেগন্যান্সির ব্যথা বৃদ্ধি হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, নিষিক্ত ডিম্বাণু বাম পাশের ফ্যালোপিয়ান টিউবে প্রতিস্থাপিত হলে সেক্ষেত্রে পেটের বাম পাশে ব্যথা হয়।
পিআইডি (PID- Pelvic inflammatory disease)
মহিলাদের জননেন্দ্রিয়ে (Female genital organs) ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় PID বলা হয়। এই রোগের ক্ষেত্রে তলপেটে ব্যথা সহ অস্বাভাবিক স্রাব নিঃসৃত হওয়া, জ্বর, বমি বমি ভাব, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, সহবাসের সময় ব্যথা বোধ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
ওভারিয়ান টর্সন (Ovarian torsion)
সহজ ভাষায় ওভারিয়ান টর্সন বলতে ওভারি ও ফ্যালোপিয়ান টিউব অস্বাভাবিক ভাবে প্যাঁচ লেগে যাওয়া বোঝায় যার ফলে ওভারিতে রক্তসঞ্চালন ব্যাহত হয়। শরীরের কোনো অঙ্গে যথাযথ ভাবে রক্ত সঞ্চালনে বিঘ্ন ঘটলে তীব্র ব্যথার অনুভূতি হয়। ওভারিয়ান টর্সনের ফলে তলপেটে ব্যথা সহ বমি, জ্বর, অস্বাভাবিক স্রাব নিঃসৃত হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
ইঙ্গুইনাল হার্নিয়া (Inguinal hernia)
পুরুষের ক্ষেত্রে যে পথ দিয়ে অণ্ডকোষ থলিতে নেমে আসে বা নারীদের ক্ষেত্রে যেখানে জরায়ুর লিগামেন্ট থাকে সেই পথ গুলোকে বলা হয় ইঙ্গুইনাল ক্যানাল। কোনো কারণে ইঙ্গুইনাল ক্যানালের পেশী দুর্বল হয়ে গিয়ে অন্ত্রের কিছু অংশ সেই জায়গা ভেদ করে তলপেট থেকে কুঁচকির দিকে নেমে আসলে তাকে মেডিকেলের ভাষায় ইঙ্গুইনাল হার্নিয়া বলা হয়। এই ধরনের হার্নিয়া সাধারণত মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি হয়ে থাকে।
টেস্টিকুলার টর্সন (Testicular torsion)
Testis মানে হলো অন্ডকোষ আর টেস্টিকুলার টর্সন দ্বারা বোঝানো হয় অন্ডকোষ ও স্পার্মাটিক কর্ড (অন্ডথলিতে থাকে) একসাথে পেঁচিয়ে যাওয়ার ফলে অন্ডকোষে রক্তসঞ্চালন ব্যাহত হওয়া। এক্ষেত্রে অন্ডকোষ লাল হয়ে যাওয়া সহ ব্যথা হয় এবং ব্যথা পেটের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন?
উল্লেখিত ১৬টি কারণের মধ্যে অ্যাপেন্ডিসাইটিস, অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ, কিডনি ইনফেকশন, ইঙ্গুইনাল হার্নিয়া, ওভারিয়ান টর্সন, টেস্টিকুলার টর্সন, একটোপিক প্রেগন্যান্সি ইত্যাদি হলো জরুরী অবস্থা যেক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। আর বাকিগুলো দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা যেগুলোতে কিছুটা সময় নিয়ে পরে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে। বদহজম, পেটে গ্যাস হওয়া, কোষ্টকাঠিন্য, পিরিয়ডের ব্যথা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঘরোয়া পদ্ধতি অবলম্বন করাই যথেষ্ট হবে।
একজন সাধারণ মানুষের জন্য পেটে ব্যথার স্থান নির্দিষ্ট করে বলা এবং ব্যথার কারণ নির্ণয় করা কঠিন। আপনি কিভাবে বুঝবেন যে, আপনার ক্ষেত্রে কোন ধরনের সমস্যা হয়েছে এবং কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে? ব্যথা যদি হঠাৎ আরম্ভ হয় এবং ক্রমাগত তীব্র আকার ধারণ করে তবে বুঝতে হবে জরুরী অবস্থা। আর যদি মৃদু প্রকৃতির ব্যথা হয় অথবা মাঝে মধ্যে ব্যথা হয় তবে সেক্ষেত্রে ততটা জরুরী নয় বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যেকোনো ধরনের ব্যথার ক্ষেত্রে একটু পানি পান করা এবং কিছুক্ষণ ভারী খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
References
Scaccia, A. (2022, May 24). Why Do I Have Lower Right Abdominal Pain? Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/health/pain-in-lower-right-abdomen
Last Updated on November 21, 2023
Leave A Comment