মাথা ব্যাথা খুবই কমন একটি রোগ। প্রত্যেক মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময় মাথাব্যথায় ভুগেন। প্রতিদিন মাথা ব্যথা নিয়ে কাজ করা বেশ অস্বস্তিকর। চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রায় একশোরও বেশি প্রকার মাথা ব্যথা রয়েছে। এ সকল মাথা ব্যাথাকে কয়েক প্রকারে ভাগ করা যায়। 

এই অনুচ্ছেদে আমরা ক্রনিক মাথা ব্যাথার কারণ ও তাদের ওষুধ নিয়ে আলোচনা করবো।  

মাথাব্যথার প্রধান কারণ কি?

মাথা ব্যাথার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। কারণও গুলো ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন হতে পারে। তবে মাথা ব্যাথার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মাংসপেশি ও রক্তনালীর সংকোচন প্রসারণ। বিভিন্ন কারণে মাংসপেশি ও রক্তনালীর সংকোচন প্রসারণ ঘটতে পারে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট স্নায়ুতে যে চাপ তৈরি হয় তার ফলে মাথা ব্যাথা হয়। আবার মাথার খুলির ভেতরে কোন কারণে চাপ বেড়ে গেলেও মাথা ব্যাথা হতে পারে। 

মাথাব্যথা কি বংশগত?

মাথাব্যথা, বিশেষ করে মাইগ্রেন বংশগত হতে পারে। যাদের বাবা-মায়ের মাইগ্রেন আছে তাদের মাইগ্রেন হওয়ার সম্ভাবনা চারগুণ বেশি।

তবে খাবার ও পরিবেশগত ফ্যাক্টরও মাথা ব্যাথার জন্য দায়ী। যেমনঃ 

  • ক্যাফেইন, চকোলেট, কৃত্রিম চিনি ইত্যাদি 
  • দুগ্ধ জাতীয় খাবার যেমন পনির, সয়া সস 
  • সংরক্ষিত আচার 
  • সংরক্ষিত মাংস জাতীয় খাবার যেমন হটডগ 
  • যেকোন খাবার যা এলার্জি তৈরি করে 
  • আবহাওয়া পরিবর্তন যেমন শীত আসার আগে ও পরে 
  • ঘুম কম হলে 
  • সিগারেটের প্যাসিভ বা সেকেন্ডহ্যান্ড ধোঁয়া
  • পারফিউম এর গন্ধ, ইত্যাদি। 

মাথা ব্যথার ধরণগুলো কী কী? 

মাথা ব্যাথাকে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি এই দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে। 

প্রাইমারি মাথা ব্যাথাঃ

যেসকল মাথা ব্যাথা অন্য কোন রোগের উপসর্গ হিসেবে তৈরি হয় না সেগুলোকে প্রাইমারি মাথা ব্যাথা বলে। প্রাইমারি মাথা ব্যাথাকে ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যেমন  

 ১। মাইগ্রেন মাথা ব্যাথা

২। টেনশন এর ফলে মাথা ব্যাথা

৩। ক্লাস্টার মাথা ব্যাথা

মাইগ্রেনক্লাস্টারটেনশনের ব্যাথা
পারিবারিক ইতিহাসহ্যাঁ না হ্যাঁ 
লিঙ্গ মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশি পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশি 
শুরু প্রযোজ্য নয় ঘুমের সময় মানসিক চাপে 
স্থান সাধারণত মাথার একপাশ থেকে শুরু হয়, কিন্তু দুই পাশেও হতে পারে। সাধারণত মাথার একপাশে চোখের দিকে কপাল ও চোখের পাশে (ব্যান্ডের মতো) শুরু হয়ে ঘাড়ে পর্যন্ত ছড়াতে পারে। 
তীব্রতা মাথার ভেতরে দপ দপ বা টন টনে ব্যাথা  তীব্র, তীক্ষ্ণ ব্যাথা ভোতা ব্যাথা 
স্থায়িত্ব ২ ঘণ্টা থেকে শুরু করে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে ১৫-৯০ মিনিট ৩০ মিনিট থেকে শুরু করে ৭ দিন পর্যন্ত হতে পারে। 
অন্যান্য উপসর্গ চোখে ঝাপসা দেখা, বমিভাব, আলো ও শব্দের প্রতি অতিসংবেদনশীলতাচোখ ও একই পাশের নাক দিয়ে পানি পড়া, চোখ লাল হওয়া, কপালে বা মুখে ঘাম হওয়াআলো ও শব্দের প্রতি অতিসংবেদনশীলতা, ক্ষুধা মন্দা

 

সেকেন্ডারি মাথা ব্যাথাঃ

যেসকল মাথা ব্যাথা অন্য কোন রোগের উপসর্গ হিসেবে যেমন সাইনাস ইনফেকশন অথবা উচ্চ রক্ত চাপের কারণে তৈরি হয় সেগুলোকে সেকেন্ডারি মাথা ব্যাথা বলে। 

সাইনাস ইনফেকশনের কারনে মাথা ব্যাথাউচ্চ রক্তচাপের কারনে মাথা ব্যাথা 
লিঙ্গ সমান পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি
স্থান কপাল ও মুখ মাথার সামনে ও পিছনে
তীব্রতা ভোতা ব্যাথামাথার ভেতরে দপ দপ বা টন টনে ব্যাথা 
স্থায়িত্ব কম বেশি 
অন্যান্য উপসর্গ জ্বর, নাক দিয়ে পানি পড়া, নাক বন্ধ হয়ে থাকা চোখে ঝাপসা দেখা, বমিভাব

মাথা ব্যাথার ওষুধ কী কী? 

মাথা ব্যাথার ওষুধকে কয়েকভাগে ভাগ করা হয়ঃ 

উপসর্গ কমানোর ওষুধঃ 

মাথা ব্যাথা হলে ব্যাথা কমানোর জন্য কয়েক ধরণের ওষুধ ব্যবহার করা হয় যেমনঃ 

১। ব্যাথানাশক ওষুধ

  • NSAID: NSAID ওষুধ সকল ধরনের মাথা ব্যাথাতেই ব্যবহার করা যায়। নিচে কিছু NSAID ওষুধের জেনেরিক নাম সহ ব্র্যান্ড নাম দেওয়া হলো। 
    • Ibuprofen (Reumafen®, Profen®, Intaflam®) – এটি সাধারণত ট্যাবলেট (২০০ ও ৪০০ মিগ্রা) আকারে পাওয়া যায়। তবে কিছু প্রস্তুতকারক ক্যাপসুল (৩০০ মিগ্রা) এবং সিরাপ (১০০ মিগ্রা/৫ মিলি) হিসেবেও তৈরি করেন।  
    • Naproxen sodium (Naprox®, Ecless®, Napoxen®) – এই ওষুধটি সাধারণত ট্যাবলেট (২৫০ ও ৫০০ মিগ্রা) ও জেল আকারে পাওয়া যায়। তবে Ecless® ওষুধটি সাসপেনশন (১২৫মিগ্রা/৫ মিলি) আকারেও পাওয়া যায়। 
    • Diclofenac Sodium (Clofenac®, Diclofen®) – এই ওষুধটি ট্যাবলেট (২৫, ৫০ মিগ্রা), ক্যাপসুল (১০০ মিগ্রা), সাপোজিটরি (১২.৫, ২৫, ৫০ মিগ্রা), জেল, এবং ইনজেকশন (৭৫ মিগ্রা/৩ মিলি) আকারে পাওয়া যায়। 
    • Diclofenac Potassium (Diclofen-K®, Intafenac K®) – এটি সাধারণত ট্যাবলেট (৫০ মিগ্রা, এবং ২৫ মিগ্রা) আকারে পাওয়া যায়। 
    • Mefenamic acid (Amifen®, Fenamic®) – এই ওষুধটি সাধারণত ট্যাবলেট (২৫০, ও ৫০০ মিগ্রা) ও সাসপেনশন (৫০ মিগ্রা/৫মিলি) আকারে পাওয়া যায়। 
    • Indomethacin (Indomet®, Reumacid®, Reumacap®) – এই ওষুধটি সাধারণত ক্যাপসুল (২৫ ও ৭৫ মিগ্রা) ও সাপোজিটরি (১০০ মিগ্রা) আকারে পাওয়া যায়। 
  • Paracetamol (Napa®, Ace®) – এই ওষুধটি ট্যাবলেট (৫০০, ৬৬৫, ও ১০০০ মিগ্রা), পেডিয়াট্রিক ড্রপ (৮০মিগ্রা/মিলি), সাসপেনশন (১২০ মিগ্রা/৫ মিলি), সাপোজিটরি (১২৫, ২৫০, ৫০০ মিগ্রা) আকারে পাওয়া যায়। 
  • Paracetamol + Caffeine (Ace Plus®, Napa Extra®) – এই ওষুধটি সাধারণত ট্যাবলেট (৫০০+৬৫ মিগ্রা) হিসেবে পাওয়া যায়। 
  • Paracetamol + Tramadol HCl (Acetram®, Napadol®) – এই ওষুধটি সাধারণত ট্যাবলেট (৩২৫+৩৭.৫ মিগ্রা) হিসেবে পাওয়া যায়। 
  • Aspirin (Ecosprin®, Carva®) – এই ওষুধটি সাধারণত ট্যাবলেট (৭৫, ৮১, ও৩০০ মিগ্রা) হিসেবে পাওয়া যায়। 

২। বমির ওষুধ (Antiemetic) 

মাইগ্রেন টাইপের মাথা ব্যাথাতে বমিভাব বেশি থাকে বলে মাইগ্রেনে এই ওষুধগুলো বেশি ব্যবহার করা হয়। তবে অন্যান্য মাথা ব্যাথাতেও বমির ওষুধ ব্যবহার করা হয়। 

  • Chlorpromazine (Opsonil®, Emectil®) – এই ওষুধটি ট্যাবলেট (৫০ ও ১০০ মিগ্রা), সিরাপ (২৫ মিগ্রা/৫ মিলি) এবং IM ইনজেকশন (৫০ মিগ্রা/২ মিলি) হিসেবে পাওয়া যায়। 
  • Metoclopramide (Parenil®, Metocol®) – এই ওষুধটি ট্যাবলেট (১০ মিগ্রা), পেডিয়াট্রিক ড্রপ (১মিগ্রা/মিলি), এবং সিরাপ (৫ মিগ্রা/৫ মিলি) আকারে পাওয়া যায়। 
  • Prochlorperazine (Promtil®, Vergon®) – এই ওষুধটি ট্যাবলেট (৫ মিগ্রা), এবং ইনজেকশন (১২.৫ মিগ্রা/ মিলি) আকারে পাওয়া যায়। 
  • Diphenhydramine (Adryl®, Pedeamin®) – এই ওষুধটি সিরাপ (১০ মিগ্রা/৫ মিলি) এবং ট্যাবলেট (৫০ মিগ্রা) আকারে পাওয়া যায়। 
  • Meclizine Hydrochloride (Emezin®, Nomosic®) – এই ওষুধটি শুধু ট্যাবলেট (৫০ মিগ্রা) হিসেবে পাওয়া যায়। 

৩। Triptans

Triptan গ্রুপের ওষুধ মাইগ্রেনে বেশি ব্যবহার করা হলেও ক্লাস্টার ও টেনশন টাইপের মাথা ব্যাথাতেও বেশ কার্যকরি। নিচে কিছু Triptans ওষুধের নাম দেওয়া হলো। 

  • Almotriptan (Almitan®, Altrip®) – এই ওষুধটি শুধু ট্যাবলেট (৬.২৫ মিগ্রা) হিসেবে পাওয়া যায়। 
  • Rizatriptan (Rizamig®, Rizat®) – এই ওষুধটি শুধু ট্যাবলেট (৫.০ মিগ্রা) হিসেবে পাওয়া যায়। 
  • Sumatriptan (Nomigran®, Suma®) – এই ওষুধটি ট্যাবলেট (৫০ ও ১০০ মিগ্রা) ও নাসাল স্প্রে আকারে পাওয়া যায়। 
  • Zolmitriptan (Zolmit®, Myguard®, Nomi®) – এই ওষুধটি ট্যাবলেট (২.৫ মিগ্রা) ও নাসাল স্প্রে (2.5mg/spray, 5mg/spray) আকারে পাওয়া যায়। 

যাদের হৃদপিণ্ডের অসুখ (করোনারি আর্টারি) আছে তাদের এই ওষুধগুলো ব্যবহার করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। 

৪। Ergot Alkaloids

এই শ্রেণির একটি ওষুধের নাম হলো Ergotamine Tartrate (Migrin®) । এটি জিহ্বার নিচে অথবা সাপোজিটরি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ওষুধটি মাইগ্রেনে বেশি ব্যবহার করা হলেও ক্লাস্টার ও টেনশন টাইপের মাথা ব্যাথাতেও বেশ কার্যকর। এই ওষুধটি ডাক্তারের পরামর্শে সাবধানতার সাথে ব্যবহার করা উচিত কারণ অযাচিত ব্যবহারে এটি রিবাউন্ড হেডেক তৈরি করতে পারে। নিচে রিবাউন্ড হেডএক সম্পর্কে আরও আলোচনা করা হয়েছে। 

সাইনাস মাথা ব্যাথার ওষুধ

ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং কখনও কখনও ফাঙ্গাল ইনফেকশনের কারণে সাইনুসাইটিস থেকে মাথা ব্যাথা হতে পারে। ভাইরাল ইনফেকশন সাধারণত নিজ থেকেই চলে যায়। কিন্তু যদি ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গালজনিত সংক্রমণ হয় তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। ডাক্তার মাথা ব্যাথা কমানোর জন্য সাথে অন্যান্য ওষুধও দিতে পারেন, যেমন:

মাইগ্রেনের প্রতিরোধ মূলক ওষুধ বা চিকিৎসা 

মাসে দুই বা ততোধিকবার মাইগ্রেন হলে ডাক্তারের পরামর্শে প্রতিরোধমূলক ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। β-ব্লকার গ্রুপের কিছু ওষুধ মাইগ্রেনের প্রতিরোধের জন্য ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে প্রোপ্রানোলল এবং অন্যান্য β-ব্লকার, যেমন মেটোপ্রোলল, অ্যাটেনোলল এবং ন্যাডোলল, মাথা ব্যাথা কমানোর জন্য কার্যকর। 

  • Propranolol: (Indevar®, Propranol®) – এই ওষুধটি সাধারণত ট্যাবলেট (১০ মি. গ্রা., ৪০ মি. গ্রা.) হিসেবে পাওয়া যায়। 
  • Metoprolol (Presonil®, Preloc®) – এই ওষুধটি সাধারণত ট্যাবলেট (২৫ মি. গ্রা., ৫০ মি. গ্রা., ১০০ মি. গ্রা.) ও ইনজেকশন (5mg/ml) হিসেবে পাওয়া যায়। 
  • Atenolol (Lonet®, Betasec®) – এই ওষুধটি সাধারণত ট্যাবলেট (২৫ মি. গ্রা., ৫০ মি. গ্রা. ও ১০০ মি. গ্রা.) হিসেবে পাওয়া যায়। 

তাছাড়া ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার ভেরাপামিলও ব্যবহার করা হয়:

  • Verapamil (Veracal®) – এই ওষুধটি সাধারণত ট্যাবলেট (৪০ মি. গ্রা., ৮০ মি. গ্রা. ও ১৮০ মি. গ্রা., ২৪০ মি. গ্রা.) হিসেবে পাওয়া যায়। 

অ্যান্টিকনভালসেন্টস Divalproex যা valproic acid নামেও পরিচিত মাইগ্রেনের প্রতিরোধে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীদের মাইগ্রেন প্রতিরোধের জন্য Tricyclics অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ যেমন amitriptyline (Tryptin®, Amilin®) বিশেষভাবে কার্যকর। (Dietrich, Carris, & Panavelil, 2015)

রিবাউন্ড হেডেক (rebound headache) কী?

মাথাব্যাথা সারানোর জন্য ঘন ঘন ওষুধ ব্যবহার করলে ওষুধের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। ফলে মাথাব্যাথা সারানোর জন্য অতিরিক্ত ওষুধের প্রয়োজন হয়। ওষুধের ইফেক্ট বন্ধ হয়ে গেলে আবার মাথা ব্যাথা ফিরে আসে। একেই বলে রিবাউন্ড হেডেক। রিবাউন্ড হেডেক বন্ধ করার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ খাওয়া যাবে না। 

মাইগ্রেন কী নিরাময়যোগ্য? 

মাইগ্রেন নিরাময় যোগ্য নয়। তবে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললে এবং নির্দেশিত ওষুধ ব্যবহার করলে মাথাব্যাথা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। 

Reference

Dietrich, E., Carris, N., & Panavelil, T. A. (2015). Anti-inflammatory, Antipyretic, and Analgesic Agents. In K. Whalen (Ed.), Lippincott Illustrated Reviews: Pharmacology, Sixth Edition (pp. 464-467). Wolters Kluwer.

Last Updated on April 8, 2023