সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি১২ (কোবালামিন) সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। কারণ ভিটামিন বি১২ পানিতে দ্রবণীয় একটি ভিটামিন যা দীর্ঘসময় পর্যন্ত শরীরে সংরক্ষিত থাকে না।
ভিটামিন বি১২ শরীরের যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজে সহায়তা করে তা হলো স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম, কোষের বিপাক প্রক্রিয়া সাধন, লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদন, DNA এর গঠন ইত্যাদি।
এই অনুচ্ছেদে ভিটামিন বি১২ এর দৈনিক চাহিদা, অভাব জনিত লক্ষণ, ভিটামিন বি১২ জাতীয় খাবার, সাপ্লিমেন্ট ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
ভিটামিন বি১২ এর দৈনিক চাহিদা
১৪ বছর ও তার বেশি বয়সী নারী ও পুরুষের জন্য দৈনিক ২.৪ মাইক্রোগ্রাম পরিমাণ ভিটামিন বি১২ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর গর্ভবতী নারীদের জন্য প্রতিদিন ২.৬ মাইক্রোগ্রাম এবং শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মায়েদের জন্য প্রতিদিন ২.৮ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি১২ গ্রহণ করতে হবে। ১৪ বছরের কম বয়সীদের জন্য যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা নিচে ছকে তুলে ধরা হলোঃ (Robinson, 2023)
যেসব শিশু (৬ মাস বয়স পর্যন্ত) শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ পান করে তারা কিভাবে ভিটামিন বি১২ এর চাহিদা পূরণ করবে এই চিন্তায় অস্থির হতে হবে না। কারণ মায়ের বুকের দুধে পর্যাপ্ত ভিটামিন বি১২ রয়েছে।
বয়স | দৈনিক চাহিদার পরিমাণ |
জন্ম থেকে ৬ মাস | ০.৪ মাইক্রোগ্রাম |
৭ থেকে ১২ মাস | ০.৫ মাইক্রোগ্রাম |
১ থেকে ৩ বছর | ০.৯ মাইক্রোগ্রাম |
৪ থেকে ৮ বছর | ১.২ মাইক্রোগ্রাম |
৯ থেকে ১৩ বছর | ১.৮ মাইক্রোগ্রাম |
ভিটামিন বি১২ জাতীয় খাবার
ভিটামিন বি১২ একটি এসেনশিয়াল পুষ্টি উপাদান অর্থাৎ শরীরের ভেতরে উৎপাদন হয় না, বরং বাইরে থেকে (খাবার অথবা সাপ্লিমেন্ট) সরবরাহ করতে হয়। প্রাকৃতিক ভাবেই কতিপয় খাবারের মধ্যে ভিটামিন বি১২ রয়েছে যা খাওয়ার মাধ্যমে দৈনিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। ভিটামিন বি১২ সমৃদ্ধ ১০ টি খাবার এবং কোনটিতে কতটুকু পরিমাণে ভিটামিন বি১২ রয়েছে তা নিচে উপস্থাপন করা হলোঃ (Semeco, 2022)
কলিজা (Liver)
গরু ও মুরগির কলিজা হলো সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ভিটামিন বি১২ সমৃদ্ধ খাবার। ১০০ গ্রাম কলিজা থেকে দৈনিক চাহিদার প্রায় ১০ গুণ বেশি ভিটামিন বি১২ পাওয়া যায়। ভিটামিন বি১২ পানিতে দ্রবণীয় অর্থাৎ খাবার থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করা হলেও বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয় না বরং অতিরিক্ত অংশ শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।
তবে সমস্যা হলো কলিজা খাওয়া সবার জন্য উচিত হবে না। কারণ এতে হার্টের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই বড়দের জন্য কলিজা খাওয়া বর্জন করা উচিত। তবে ছোট বাচ্চাদের জন্য কলিজা খাওয়া যাবে।
গরুর মাংস (Beef)
গরুর মাংস হলো ভিটামিন বি১২ এর একটি দারুন উৎস। ১০০ গ্রাম গরুর মাংস থেকে ২.৬৪ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন বি১২ পাওয়া যায় যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক চাহিদা পূরণ করতে যথেষ্ট। এছাড়াও গরুর মাংসে ভিটামিন বি২, বি৩ ও বি৬ সহ আয়রন, সেলেনিয়াম, জিংক ইত্যাদি রয়েছে।
গরুর মাংস পুষ্টিগুণ সম্পন্ন ও খেতে সুস্বাদু হলেও অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া যাবে না। বিশেষ করে যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের রোগের ঝুঁকি রয়েছে তাদের জন্য পরিমিত পরিমাণে মাংস খেতে হবে।
ডিম (Eggs)
সবার জন্য ভিটামিন বি১২ এর একটি দারুন উৎস হতে পারে ডিম। কারণ ডিম একাধারে সহজলভ্য, খেতে মজাদার এবং সব বয়সের মানুষের জন্য খাওয়া নিরাপদ হবে। একটি সিদ্ধ ডিম ভিটামিন বি১২ এর দৈনিক চাহিদার ২৩ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ করতে পারে।
ডিমে আরো রয়েছে ভালো মানের প্রোটিন, ভিটামিন বি২, ভিটামিন ডি ও কোলাইন যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়া হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় না। তবে যাদের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের জন্য ডিমের কুসুম পরিহার করা উচিত।
দুধ (Milk)
এক গ্লাস পরিমাণ (২৪০ মিলিলিটার) দুধ ভিটামিন বি১২ এর দৈনিক চাহিদার প্রায় অর্ধেক পূরণ করতে পারে। এছাড়াও দুধে ভিটামিন বি২, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও কার্বোহাইড্রেট (ল্যাকটোজ) রয়েছে।
দুধে স্যাচুরেটেড ও ট্র্যান্স ফ্যাট রয়েছে যা হার্টের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। হার্টের রোগের ঝুঁকি এড়াতে ফ্যাট ফ্রি দুধ খেতে হবে। আর যারা ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স (Lactose intolerance) রোগে ভুগছেন তাদের জন্য ল্যাকটোজ ফ্রি দুধ খেতে হবে।
দুগ্ধজাত খাবার
দুধের মতো দুগ্ধজাত খাবার (যেমনঃ পনির, মাখন, ইয়োগার্ট) থেকেও ভিটামিন বি১২ পাওয়া যায়। তবে এসব খাবার সবার জন্য খাওয়া ঠিক হবে না। এগুলো প্রচুর ফ্যাট ও ক্যালরি সম্পন্ন খাবার। তাই যাদের হার্টের রোগ রয়েছে অথবা শরীরের ওজন বেশি তাদের জন্য দুগ্ধজাত খাবার পরিহার করা উত্তম। একান্তই খেতে হলে পরিমিত পরিমাণে অথবা পুষ্টিবিদের পরামর্শ মেনে খেতে হবে।
ঝিনুক (Oysters)
বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ঝিনুকের রেসিপি পাওয়া যায়। আবার অনেকে বাড়িতে তৈরি করেও খেয়ে থাকেন। শুধু খেতে সুস্বাদু তাই নয়, বরং পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি খাবার হলো ঝিনুক। ১০০ গ্রাম ঝিনুক দৈনিক ভিটামিন বি১২ এর চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি পূরণ করতে সক্ষম। এছাড়াও ঝিনুকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ কপার, জিংক, সেলেনিয়াম ইত্যাদি যা শরীরের জন্য অনেক উপকারী।
টুনা মাছ (Tuna fish)
আমাদের দেশে সুপার শপে কৌটাজাত টুনা মাছ কিনতে পাওয়া যায় যা ভিটামিন বি১২ এর দারুন একটি উৎস। ১০০ গ্রাম টুনা মাছে দৈনিক চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে ভিটামিন বি১২ পাওয়া যা। এছাড়াও এতে রয়েছে ভালো মানের প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি৩, ভিটামিন বি৬, ফসফরাস, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড ইত্যাদি।
স্যালমন (Salmon)
স্যালমন মাছে (স্যামন নামেও পরিচিত) প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি১২ এবং ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড রয়েছে। ১০০ গ্রাম মাছে যে পরিমাণ ভিটামিন বি১২ রয়েছে তা দৈনিক চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ।
সুপার শপ এবং অনলাইন শপে কৌটাজাত স্যালমন মাছ কিনতে পাওয়া যায় না।
সার্ডিন (Sardines)
সার্ডিন মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি১২ রয়েছে। ১০০ গ্রাম সার্ডিন মাছে যে পরিমাণ ভিটামিন বি১২ রয়েছে তা দৈনিক চাহিদার প্রায় ৩ গুণ। এছাড়াও এতে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড যা হার্টের জন্য উপকারী।
প্রায় ইলিশ মাছের মতো দেখতে সার্ডিন মাছ বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও সুপার শপ থেকে যেকোনো সময় কৌটাজাত সার্ডিন মাছ সংগ্রহ করা যাবে।
ফর্টিফায়েড খাবার (Fortified foods)
প্রাণিজ উৎসের পরে ভিটামিন বি১২ এর সেরা উৎস হিসেবে রয়েছে ফর্টিফায়েড খাবার। যারা নিরামিষাশী অর্থাৎ প্রাণিজ আমিষ জাতীয় খাবার গ্রহণ করেন না তাদের জন্য এটি বিশেষ উপকারী হবে। ফর্টিফায়েড খাবার বলতে বোঝায় কৃত্রিম উপায়ে পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করা। উদ্ভিজ্জ খাবারে আলাদাভাবে ভিটামিন বি-১২ যোগ করা হয়েছে এমন ফর্টিফায়েড খাবার সুপার শপ এবং অনলাইন শপে কিনতে পাওয়া যায়।
ভিটামিন বি১২ এর অভাব জনিত লক্ষণ
শরীরে ভিটামিন বি১২ এর সামান্য ঘাটতি হলে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে দীর্ঘদিন ধরে চাহিদার তুলনায় কম পরিমাণে সরবরাহ করা হলে অভাব জনিত লক্ষণ দেখা যায়। যেমনঃ
- মাথাব্যথা
- দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ
- ত্বক ফ্যাকাশে বর্ণের হয়ে যায়
- হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়
- ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস
- ক্ষুধা কমে যাওয়া
- জিহ্বায় ও মুখে ঘা
- স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া
- দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া ইত্যাদি
ভিটামিন বি১২ এর ঘাটতি জনিত কারণে কমন যে সমস্যাটি হয় তা হলো রক্তস্বল্পতা। এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষেত্রে জটিল সমস্যা হিসেবে স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যায়।
কাদের ক্ষেত্রে ভিটামিন বি১২ এর ঘাটতি হয়?
স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করেন এমন মানুষের ক্ষেত্রে সাধারণত ভিটামিন বি১২ এর ঘাটতি হয় না। যাদের ক্ষেত্রে ঘাটতি হওয়ার প্রবণতা দেখা যায় তা হলোঃ
- যারা নিরামিষ খাদ্য আহার করেন (যেহেতু উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবারে ভিটামিন বি১২ থাকে না)
- গর্ভবতী নারী ও শিশুকে বুকের দুধ পান করান এমন মা (চাহিদা বেড়ে যায় কিন্তু সেই তুলনায় পর্যাপ্ত খাবার খাওয়া হয় না)
- আলসার, ক্রন’স ডিজিজ, সিলিয়াক ডিজিজ, কৃমি ইত্যাদিতে আক্রান্ত ব্যক্তি (পরিপাকতন্ত্রের রোগের ফলে অন্ত্রে ভিটামিন বি১২ শোষণে ব্যাঘাত ঘটে)
- যারা অ্যালকোহল, গ্যাসের ওষুধ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন করেন (এগুলো শরীরে ভিটামিন বি১২ শোষণে ব্যঘাত ঘটায়)
ভিটামিন বি১২ সাপ্লিমেন্ট
শরীরে ভিটামিন বি১২ এর অতিরিক্ত ঘাটতি পূরণের জন্য শুধুমাত্র খাবারের উপর ভরসা না করে বরং ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে ভিটামিন বি১, বি৬, বি১২ ইত্যাদি একত্রিত করা ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও ইনজেকশন হিসেবে নিম্নলিখিত নামে পাওয়া যায়। যথাঃ
- 3 Bion®
- Alvita®
- Asibion®
- Astra-N®
- Axovit®
- B126®
- B3®
- Myelin®
- Neobin®
- Neubin®
অন্য কোনো ভিটামিনের সাথে একত্রিত করা নয়, বরং শুধুমাত্র ভিটামিন বি১২ (ইনজেকশন ফর্মে) পাওয়া যায় নিম্নলিখিত নামে-
- Cynomin®
- Cynovit®
- G-Vitamin B12®
- Vitamin B12®
ভিটামিন বি১২ ওষুধ ডাক্তারের নির্দেশনা ব্যতীত সেবন করা যাবে না।
Bibliography
Robinson, J. (2023, January 14). Vitamin B12: What to Know. Retrieved from WbMD: https://www.webmd.com/diet/vitamin-b12-deficiency-symptoms-causes
Semeco, A. (2022, January 20). Top 12 Foods That Are High in Vitamin B12. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/vitamin-b12-foods</blockquote
Last Updated on October 31, 2023
Leave A Comment