ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega-3 fatty acid) একটি এসেনশিয়াল পুষ্টি উপাদান অর্থাৎ শরীর তৈরি করতে পারে না বরং খাবারের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয়। শরীরের বিভিন্ন কাজে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে শরীরের কোষের গঠন ও কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
শরীরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর ঘাটতি হলে স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এমতাবস্থায় কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয়। এই অনুচ্ছেদে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর ঘাটতির ৫টি লক্ষণ, কাদের ক্ষেত্রে ঘাটতি হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায় এবং ঘাটতি পূরণের জন্য করণীয় কি তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
১। ত্বকের জ্বালা এবং শুষ্কতা
শরীরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর ঘাটতি হলে সর্বপ্রথম ত্বকে কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমনঃ ত্বকের শুষ্কতা, মসৃণতা হারানো, ব্রণ হওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি।
ওমেগা-৩ ত্বকের আদ্রর্তা বজায় রাখতে এবং কোষের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। তাই শরীরে ওমেগা-৩ এর অভাব হলে ত্বক রুক্ষ প্রকৃতির হয়ে যায় এবং প্রদাহের ফলে ব্রণ হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ত্বকের আদ্রর্তা ঠিক থাকে, প্রদাহ কম হয় অর্থাৎ ব্রণ হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে এবং সূর্যের তাপে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। (Panoff, 2021)
২। বিষন্নতা
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ওমেগা-৩ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, শরীরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর ঘাটতি হওয়ার সাথে বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। আবার বিষন্নতায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ গ্রহণ করা বিষন্নতার লক্ষণ দূর করতে সাহায্য করে।
বিষন্নতার লক্ষণ হলো অহেতুক মন খারাপ থাকা, দৈনন্দিন জীবনের কোনো কিছুতেই আগ্রহ থাকে না, খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের সমস্যা, ক্লান্তি বোধ, মাথাব্যথা ইত্যাদি।
এছাড়াও মস্তিষ্কের (স্নায়ু কোষের) কার্যক্রম ভালো রাখতে ওমেগা-৩ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শরীরে ওমেগা-৩ এর অভাবে ডিমেনশিয়া ও আলজেইমার্স ডিজিজ (মস্তিষ্কের রোগ) হতে পারে যার লক্ষণ হলো কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না অর্থাৎ সহজেই ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
৩। শুষ্ক চোখ
ওমেগা-৩ চোখের আদ্রর্তা বজায় রাখতে এবং রেটিনার (চোখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ) স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। শরীরে ওমেগা-৩ এর ঘাটতির ফলে চোখের ভেতর শুষ্কতা অনুভব হতে পারে এবং দৃষ্টি শক্তি কমে যেতে পারে।
শুষ্ক চোখ এবং দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া অন্য কোনো রোগের কারণেও থাকতে পারে। তাই লক্ষণ দেখা দিলেই শরীরে ওমেগা-৩ এর অভাব হয়েছে ধরে নেওয়া যাবে না। বরং একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে সঠিক কারণ নির্ণয় করার মাধ্যমে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে।
৪। জয়েন্ট পেইন
বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে থাকা কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি ক্ষয় হতে থাকে। যার ফলাফল হিসেবে জয়েন্টে প্রদাহ বা ব্যথা (পেইন) অনুভব হয়।
ওমেগা-৩ জয়েন্ট তথা কার্টিলেজের গঠন ভালো রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই শরীরে ওমেগা-৩ এর অভাব হলে জয়েন্টে ব্যথা দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস নামক অটোইমিউন রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর ভূমিকা রয়েছে। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা-৩ না থাকলে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস জনিত জয়েন্ট ব্যথা বেড়ে যায়।
৫। চুল
চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শরীরে ওমেগা-৩ এর অভাব হলে চুলের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। যেমনঃ অতিরিক্ত চুল পড়া, চুল রুক্ষ প্রকৃতির হয়ে যাওয়া, চুলের পুরুত্ব কমে যাওয়া ইত্যাদি।
আরো অসংখ্য কারণে চুলের সমস্যা হতে পারে। তবে ওমেগা-৩ এর ঘাটতির ফলে চুলের সমস্যা হওয়ার বিষয়টি একদম আনকমন বলা যায় না। বরং অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই শরীরে ওমেগা-৩ এর অভাবের কারণে চুলের সমস্যা হতে দেখা যায়।
কাদের ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ এর অভাব হতে পারে?
পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করে না এমন মানুষের ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ এর ঘাটতি হয়ে থাকে।
সাধারণত মহিলা, বাচ্চা, নিরামিষাশী ব্যক্তি ও যারা মাছ খায় না তাদের শরীরে ওমেগা-৩ এর ঘাটতি হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
এছাড়াও লিভারের সমস্যা ও Cystic fibrosis নামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে। (Kubala, 2021)
কিভাবে ওমেগা- ৩ এর ঘাটতি নিশ্চিত করবেন
শরীরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর ঘাটতি নিশ্চিতভাবে জানার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসক লক্ষণ শুনে এবং সেই লক্ষণগুলো অন্য কোনো রোগের কারণে হয়েছে কিনা তা জানার জন্য কিছু টেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে ওমেগা-৩ এর ঘাটতির ফলে লক্ষণ দেখা দিয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে ওমেগা-৩ এর ঘাটতি নির্ণয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো টেস্ট নেই।
কীভাবে ওমেগা-3 অভাব পূরণ করবেন?
শরীরের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর চাহিদা মেটাতে খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর সবচেয়ে ভালো একটি উৎস হলো মাছ। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ওমেগা-৩ রয়েছে। এছাড়াও ডিম, দুধ, তিসি, বাদাম, সয়াবিন, চিয়া বীজ ও সবুজ শাকসবজি থেকে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়।
সপ্তাহে নূন্যতম ২ দিন মাছ খেতে হবে এবং কেউ চাইলে প্রতিদিনের খাবার তালিকায় মাছ রাখতে পারে।
তবে সামুদ্রিক মাছে শরীরের জন্য ক্ষতিকর মার্কারী থাকতে পারে যার ফলে সামুদ্রিক মাছ সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২ দিনের বেশি খাওয়া উচিত নয়।
ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট
খাবার খাওয়ার মাধ্যমে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর চাহিদা মেটানো হলো আদর্শ উপায়। তবে একান্তই প্রয়োজন মনে হলে ঘাটতি পূরণের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে নিম্নলিখিত নামে ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট কিনতে পাওয়া যায়।
- O3®
- MaxOmega®
- Neomega®
- Omesoft®
- OMG-3®
- Trumega ®
চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত হবে না।
শেষ কথা
শরীরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর অভাব হলে ত্বকের রুক্ষতা, চুলের সমস্যা, শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা, দৃষ্টি শক্তির সমস্যা সহ বিষন্নতার লক্ষণ দেখা যেতে পারে। এছাড়াও হার্টের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, কিডনিতে সমস্যা, ইনফার্টিলিটি (বন্ধ্যাত্ব) ইত্যাদি হতে পারে।
শরীরের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ, ডিম, তিসি, চিয়া বীজ ও বিভিন্ন ধরনের বাদাম (সবচেয়ে সহজলভ্য হলো চীনাবাদাম) সহ প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাকসবজি রাখতে হবে।
চীনাবাদামের ১২টি উপকারিতা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।
References
Kubala, J. (2021, May 12). Signs of Omega-3 Deficiency and How to Prevent It. Retrieved from GREATIST: https://greatist.com/health/omega-3-deficiency
Panoff, L. (2021, January 06). 5 Signs and Symptoms of Omega-3 Deficiency. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/omega-3-deficiency
Last Updated on December 31, 2023
Leave A Comment