মানব শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হলো ফুসফুস (Lung) যা শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রমে নিয়োজিত। ধুমপান, বায়ু দূষণ এবং বিভিন্ন রোগের কারণে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যায়। বিশেষ করে হাঁপানি, COPD (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ) এবং পালমোনারি ফাইব্রোসিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্যক্রম সব সময়ের জন্যই বেশ কষ্টকর হয়ে থাকে।
ফুসফুস ভালো রাখার জন্য ধুমপান বর্জন, নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা জরুরী। ফুসফুস ভালো রাখার ২০টি খাবার নিয়ে এই অনুচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে।
Table of Contents
ফুসফুসের জন্য ২০টি সেরা খাবার
আমরা প্রতিনিয়ত যে খাবারগুলো খেয়ে থাকি তার প্রভাব (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে) শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গের উপর পড়ে। স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে তা সুস্থ থাকার পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পক্ষান্তরে অস্বাস্থ্যকর খাবার শরীরের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ফুসফুস ভালো রাখতে সাহায্য করে এমন ২০টি সেরা খাবার নিচে তুলে ধরা হলো। (Kubala, 2020)
১. আপেল
গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত আপেল খাওয়ার অভ্যাস ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো রাখতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ১টি করে আপেল খাওয়া হলে ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। আপেলের এন্টি-অক্সিডেন্ট (Antioxidant) গুণাবলীর ফলে এমন উপকারিতা পাওয়া যায় বলে ধারণা করা হয়।
২. ব্লুবেরি (Blueberries)
ব্লুবেরিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্থোসায়ানিন (Anthocyanins) নামক এন্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান রয়েছে। ব্লুবেরি খাওয়ার মাধ্যমে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো রাখা যায়।
ব্লুবেরি একটি বিদেশী ফল যা আমাদের দেশে তেমন একটা পাওয়া যায় না। তবে এর পরিবর্তে জাম খেতে পারেন। জামে অ্যান্থোসায়ানিন রয়েছে এবং এটি খুব কম শর্করা যুক্ত একটি ফল যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিশ্চিন্তে খাওয়া যাবে।
৩. আঙ্গুর
অ্যান্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ আরেকটি বিদেশি ফল হলো আঙ্গুর। তবে সবুজ আঙ্গুর নয়, বরং কালো আঙ্গুরে অ্যান্থোসায়ানিন থাকে। বিদেশি ফল হলেও আমাদের দেশে আঙ্গুর সহজলভ্য। তাছাড়া জাম সারাবছর পাওয়া যায় না। তবে আঙ্গুর পাওয়া যায় যা খাওয়া হলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো থাকে।
৪. মিষ্টি কুমড়া
ফুসফুস ভালো রাখতে সহায়তা করে এমন অনেক উপাদান (Beta carotene, Lutein ও Zeaxanthin) মিষ্টি কুমড়ায় রয়েছে। বিশেষ করে মিষ্টি কুমড়ার এন্টি-অক্সিডেন্ট ও প্রদাহ নাশক গুণাবলী ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো রাখতে সহায়তা করে। মিষ্টি কুমড়া সহজলভ্য একটি সবজি। ভর্তা বানিয়ে বা তরকারি হিসেবে মিষ্টি কুমড়া খাওয়া যায়। তবে কেউ চাইলে রান্না ছাড়াও কাঁচা অবস্থায় মিষ্টি কুমড়া খেতে পারেন।
৫. গাজর
মিষ্টি কুমড়ার মতো গাজর থেকেও প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিনয়েডস (Carotenoids) পাওয়া যায়। নিয়মিত গাজর খাওয়া তথা ক্যারোটিনয়েডস সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার ফলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো থাকে। তরকারি বা সালাদ হিসেবে গাজর খাওয়া যায়। তবে সালাদ হিসেবে খেলে পুষ্টিগুণ ভালো থাকে। কারণ আগুনের তাপে রান্না করার ফলে অনেক পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়।
৬. টমেটো
টমেটোতে প্রচুর পরিমাণে লাইকোপেন (Lycopene) রয়েছে যা প্রদাহ কমানোর মাধ্যমে ফুসফুস ভালো রাখে। টমেটো একটি সহজলভ্য সবজি যা রান্না করে অথবা সালাদ হিসেবে খাওয়া যায়। রান্না করলে আগুনের তাপে টমেটোতে থাকা লাইকোপেন নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় নেই।
তবে টমেটো সস খাওয়া যাবে না। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে লবণ থাকে যা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিকর।
৭. বেগুনী বাঁধাকপি
অ্যান্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ একটি সবজি হলো বেগুনী বাঁধাকপি। সবুজ বাঁধাকপি, ব্রকলি ও বেগুনী বাঁধাকপি একই রকম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হলেও অ্যান্থোসায়ানিনের বিষয়টি বিবেচনায় একমাত্র বেগুনী বাঁধাকপি সেরা।
এছাড়াও বেগুনী বাঁধাকপি ফুসফুস ভালো রাখতে সহায়তা করে এমন অনেক পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। বেগুনী বাঁধাকপি খাওয়া ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৮. মসুর ডাল
যারা নিরামিষ আহার করেন তাদের জন্য মসুর ডাল দারুন একটি খাবার হতে পারে। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কপার, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি রয়েছে যা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো রাখে। মসুর ডাল খাওয়া COPD, ফুসফুস ক্যান্সার ইত্যাদি প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৯. গ্রিন টি
অন্য সবধরনের চায়ের তুলনায় গ্রিন টিতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান রয়েছে। নিয়মিত গ্রিন টি পান করা ফুসফুসের জন্য বেশ উপকারিতা বয়ে আনতে পারে।
প্রতিদিন দুই থেকে তিন কাপ গ্রিন টি পান করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হবে। ফ্লেভার, স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করতে চায়ের সাথে লেবু, আদা, লবঙ্গ ইত্যাদি যোগ করা যেতে পারে।
১০. কফি
কফিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যাফেইন রয়েছে যা শরীরের এনার্জি লেবেল ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও কফিতে থাকা এন্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে থাকে।
রাতে যাদের ঘুমের সমস্যা হয় তাদের জন্য (বিশেষ করে সন্ধ্যার পর) কফি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
১১. ব্রাজিল নাট (Brazil nuts)
ব্রাজিল নাট থেকে অনেক বেশি পরিমাণে সেলেনিয়াম পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্রাজিল নাট খাওয়া ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। তিসি, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, মসুর ডাল ইত্যাদিতে কিছুটা পরিমাণে সেলেনিয়াম পাওয়া যায়।
১২. ভিটামিন ডি
ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন ডি এর গুরুত্ব অপরিসীম। সূর্য রশ্মি ত্বকে লাগলে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয়।
এছাড়াও কতিপয় খাবার থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। যেমনঃ ডিম, মাশরুম, কমলা, মাছ, মাশরুম, ফর্টিফায়েড দুধ ইত্যাদি।
১৩. হলুদ
হলুদে থাকা কারকিউমিনের (Curcumin) প্রদাহ নাশক ও এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো রাখে। রান্নার কাজে হলুদ ব্যবহার করা ছাড়াও প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস পানিতে এক চা চামচ হলুদের গুঁড়া গুলিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
১৪. রসুন
রসুনে থাকা এন্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান এলিসিনের (Allicin) প্রভাবে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো থাকে। প্রতিদিন এক কোয়া কাঁচা রসুন খাওয়া ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
১৫. বীট রুট (Beetroot)
বীট রুটে নাইট্রেট (Nitrates), পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যারোটিনয়েডস, ভিটামিন সি ইত্যাদি রয়েছে যা ফুসফুস ভালো রাখে।
সালাদ হিসেবে অথবা জুস বানিয়ে বীট রুট খাওয়া যায়। এছাড়াও সবজি হিসেবে রান্না করে খেতে পারেন। বীট রুট খাওয়ার ফলে প্রস্রাব ও পায়খানা লাল বা পিংক কালারের হয়ে যেতে পারে যা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
১৬. অলিভ অয়েল
অলিভ অয়েলে পলিফেনল (Polyphenol) ও ভিটামিন ই রয়েছে যার প্রদাহ নাশক ও এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী ফুসফুসের জন্য উপকারী। অলিভ অয়েল খাওয়ার ফলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো থাকে এবং হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
১৭. শাকসবজি
শাকসবজি হলো কম ক্যালোরিযুক্ত অথচ বেশি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার। শাকসবজি এন্টি-অক্সিডেন্ট ও প্রদাহ নাশক গুণাবলী সম্পন্ন হয়ে থাকে যা ফুসফুস ভালো রাখতে সাহায্য করে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই বিভিন্ন ধরনের (সবুজ, হলুদ, লাল ও বেগুনী বর্ণ বিশিষ্ট) শাকসবজি রাখতে হবে।
১৮. ঝিনুক (Oysters)
আমাদের দেশে বর্তমানে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ঝিনুকের রেসিপি পাওয়া যায়। পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি খাবার হলো ঝিনুক যার ভেতরে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি, কপার, জিংক, সেলেনিয়াম ইত্যাদি রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, সেলেনিয়াম ও কপার যুক্ত খাবার ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও ভিটামিন বি ও জিংক ধুমপায়ী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে COPD রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
১৯. ইয়োগার্ট (Yogurt)
ইয়োগার্ট থেকে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও সেলেনিয়াম পাওয়া যায়। ইয়োগার্ট খাওয়া ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো রাখতে এবং COPD রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির ইয়োগার্ট কিনতে পাওয়া যায়। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য চিনি মুক্ত অথবা কম চিনি রয়েছে এমন ইয়োগার্ট সংগ্রহ করতে হবে।
২০. ডার্ক চকোলেট
ডার্ক চকোলেটে ৭০ শতাংশ বা তার বেশি পরিমাণে কোকোয়া (Cocoa) থাকে। এতে বিদ্যমান ফ্ল্যাভোনয়েডের এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভালো রাখতে এবং ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
চিনির পরিমাণ কম রয়েছে এমন ধরনের ডার্ক চকোলেট কিনতে হবে। অনেক বেশি পরিমাণে ডার্ক চকোলেট খাওয়া যাবে না। কারণ এটি উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার যা শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
টিপস
ফুসফুস ভালো রাখার জন্য খাবারের পাশাপাশি যেসব নিয়ম মেনে চলা জরুরী। (Wadhwa, 2023)
- নিজে ধুমপান করা যাবে না এবং ধুমপান করেন এমন মানুষজনের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।
- মশার কয়েল ও এরোসল স্প্রে (ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর) ব্যবহার করা যাবে না।
- অতিরিক্ত ধুলাবালি এড়াতে বাইরে গেলে মাস্ক পরিধান করতে হবে।
- শরীরের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী।
- প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম (বিশেষ করে ব্রিদিং এক্সারসাইজ) করতে হবে।
খাবার কখনো ওষুধের পরিপূরক হতে পারে না। তাই ফুসফুসের কোনো রোগে আক্রান্ত হলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। ডাক্তারের নির্দেশনা মোতাবেক ওষুধ সেবন করার পাশাপাশি পথ্য হিসেবে খাবার খাওয়া উপকারী হতে পারে।
Bibliography
Kubala, J. (2020, June 24). The 20 Best Foods for Lung Health. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/lung-cleansing-foods
Wadhwa, D. S. (2023, 02 16). 9 Tips To Keep Your Lungs Strong And Healthy. Retrieved from lybrate: https://www.lybrate.com/topic/9-tips-to-keep-your-lungs-strong-and-healthy/972162aa61cd25b12baaab1bae94d9e0
Last Updated on October 31, 2023
Leave A Comment