অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, অলস জীবন যাপন ইত্যাদির ফলে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ (Systemic chronic inflammation) বেড়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহের ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার ও কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া সহ লিভারের রোগ হতে পারে। (Furman, 2020)

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ কমানোর ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। এই অনুচ্ছেদে ১২টি অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি খাবার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।‌ এই খাবারগুলো প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

১। বাদাম

বাদামে বিদ্যমান ভিটামিন, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। বাদামের বিভিন্ন প্রকরণ (চীনাবাদাম, আখরোট, কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম, কাজুবাদাম ইত্যাদি) রয়েছে যার মধ্যকার সবচেয়ে সহজলভ্য হলো চীনাবাদাম। 

প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় একমুঠো বাদাম রাখতে পারেন যা বিকাল বেলার স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। যেকোনো একধরনের বাদাম অথবা সবগুলোর সংমিশ্রণ (কিনতে পাওয়া যায়) খেতে পারেন। 

বাদামের মতোই স্বাদ ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার হলো মিষ্টি কুমড়োর বিচি ও সূর্যমুখী বীজ যা স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। এই খাবারগুলো প্রদাহ কমানো সহ শরীরের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনতে পারে।

২। ব্রকলি

ব্রকলি হলো ক্রুসিফেরাস (Cruciferous) গোত্রের সবজি যা প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী সম্পন্ন। ব্রকলি খাওয়া হলে প্রদাহ কমানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করে। বাঁধাকপি ও ফুলকপি ক্রুসিফেরাস গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। 

যতটা সম্ভব কম তাপে সবজি রান্না করে খেলে সবচেয়ে বেশি উপকারিতা পাওয়া যায়। কারণ আগুনের তাপে দীর্ঘসময় সবজি রান্না করা হলে ভিটামিন ও এন্টি-অক্সিডেন্ট কমে যেতে থাকে। 

৩। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার

fiber rich foods 1

ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। তাই খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে। যেমনঃ বাদামী চালের ভাত, আটার রুটি, যবের ছাতু, ওটস, ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি। 

প্রিবায়োটিকস ফুড অর্থাৎ যা অন্ত্রের ভেতর বসবাসকারী উপকারী ব্যাকটেরিয়ার জন্য পুষ্টি জোগায় এমন সাপ্লিমেন্ট (ইসবগুলের ভুসি বা চীয়া বীজ) গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রতিদিন সকালে ও রাতে একগ্লাস পানিতে ২ চা চামচ ইসবগুলের ভুসি বা চীয়া বীজ গুলিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন।  

৪। মাছ 

মাছ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ একটি খাবার যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনির রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।‌ (Spritzler, 2023) 

সব বয়সের মানুষের জন্য মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সপ্তাহে নূন্যতম ২ দিন মাছ খেতে হবে। শুধু একধরনের মাছ নয়, বরং বৈচিত্র্যময় মাছ খাওয়া ভালো। এছাড়াও খাদ্যতালিকায় সামুদ্রিক খাবার রাখতে হবে।

৫। অ্যাভোকাডো 

অ্যাভোকাডোর অসাধারণ পুষ্টিগুণ রয়েছে। প্রচুর পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফাইবার ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট সমৃদ্ধ অ্যাভোকাডো খাওয়ার ফলে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

বিদেশি ফল হলেও বর্তমানে আমাদের দেশে অ্যাভোকাডো কিনতে পাওয়া যায়। দাম কিছুটা বেশি, তবে মাঝেমধ্যে খাওয়া (বিশেষ করে সালাদ হিসেবে) যেতে পারে।‌

৬। গ্রিন টি

অন্যান্য সব প্রকরণের চা ও কফির তুলনায় গ্রিন টি হলো সবচেয়ে কম ক্যাফেইন এবং সবচেয়ে বেশি এন্টি-অক্সিডেন্ট সম্পন্ন। গ্রিন টি পান করার অভ্যাস প্রদাহ কমানো সহ স্বাস্থ্যের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনে। গ্রিন টিতে চিনি মেশানো উচিত নয়।

দিনে ৩ থেকে ৪ কাপের বেশি গ্রিন টি পান করা যাবে না। বিশেষ করে যাদের রাতে ঘুমের সমস্যা হয় তাদের জন্য সন্ধ্যার পর গ্রিন টি সহ কোনো ধরনের চা ও কফি খাওয়া যাবে না।  

৭। মাশরুম

মাশরুম চাষ করা হয় এবং খাওয়া যায়। মাশরুম প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী সম্পন্ন যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও মাশরুম থেকে ভিটামিন বি, সেলেনিয়াম ও কপার (মিনারেলস) পাওয়া যায় যা শরীরের বিভিন্ন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মাশরুম খুব কম ক্যালরি সম্পন্ন একটি খাবার যা স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস হিসেবে খাওয়া শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের পক্ষে বেশ উপকারী হবে। চাষ করা মাশরুম কিনে খেতে হবে। কখনো বাড়ির আশেপাশে জন্মানো মাশরুম খাওয়া যাবে না। কারণ এগুলো বিষাক্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে।  

৮। আপেল ও আঙ্গুর 

grabes

প্রতিদিন একটি আপেল খাওয়ার অভ্যাস ডাক্তার থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে বলে প্রবাদ রয়েছে। অর্থাৎ আপেল খেলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায় এবং ডাক্তারের কাছে খুব কম যেতে হবে। আপেলের প্রদাহ নাশক গুণাবলী রয়েছে এবং রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ আরেকটি ফল হলো আঙ্গুর যা প্রদাহ কমাতে এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। যেমনঃ ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, আলজেইমার্স, আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি। 

আঙ্গুর ও আপেল সারাবছরই পাওয়া যায়। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এই ফলগুলো রাখতে (অল্প পরিমাণে হলেও) চেষ্টা করুন।  

৯। হলুদ

হলুদে থাকা কারকিউমিনের (Curcumin) প্রদাহ নাশক গুণাবলী রয়েছে। অর্থাৎ হলুদ প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।    

সাধারণত রান্নার কাজে হলুদ ব্যবহার করা হয় যা খাবারের স্বাদ, গন্ধ ও রং বাড়ায়। হলুদের প্রদাহ নাশক উপকারিতা পাওয়ার জন্য রান্নার কাজে ব্যবহার করা ছাড়াও সাপ্লিমেন্ট হিসেবে হলুদের গুঁড়া খাওয়া যেতে পারে।  

প্রতিদিন সকালে একগ্লাস পানিতে এক চা চামচ হলুদের গুঁড়া গুলিয়ে খাওয়ার ফলে উপকার পাওয়া যাবে। তবে দীর্ঘদিন ধরে হলুদ সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।  

১০। বীট রুট 

এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী সম্পন্ন সেরা একটি সবজি হলো বীট রুট যা অনেকের কাছেই অপরিচিত কিংবা অবহেলিত। খাদ্যতালিকায় মাঝেমধ্যে বীট রুট রাখা উচিত যা সালাদ হিসেবে ও জুস বানিয়ে খাওয়া যায়।  

মূলত শাকসবজি ও ফলমূলের বর্ণের জন্য দায়ী উপাদান সমূহ প্রদাহ নিরাময়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই শুধুমাত্র একই রকমের ফলমূল ও শাকসবজি না খেয়ে বরং বিভিন্ন বর্ণের ও ধরনের ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যেমনঃ গাজর, মিষ্টি কুমড়া, পেঁপে, আম, কলা, টমেটো, শশা, মাল্টা, কমলা, জাম, বেগুনী বাঁধাকপি ইত্যাদি।  

১১। ডার্ক চকলেট  

৭০ শতাংশ বা তার বেশি কোকোয়া সম্পন্ন চকোলেট হলো ডার্ক চকোলেট যার প্রদাহ নাশক গুণাবলী রয়েছে। ডার্ক চকোলেট খাওয়ার ফলে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

বাজারে কিনতে পাওয়া অধিকাংশ চকোলেট প্রচুর চিনি সমৃদ্ধ হয়ে থাকে যা শরীরের জন্য ততটা উপকারী নয়। কোকোয়ার পরিমাণ দেখে চকোলেট কিনতে হবে। চকোলেট সাধারণত অধিক ক্যালরি সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে।   

ডার্ক চকোলেট খাওয়ার ৭টি উপকারিতা সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন। 

১২। এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল

রান্নার কাজে বা সালাদ তৈরিতে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ব্যবহার করা উত্তম। কারণ এতে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ফ্যাট ও এন্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলী রয়েছে যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। 

বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় দেখা গেছে যে, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল খাওয়ার অভ্যাস হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার সহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। (Spritzler, 2023) 

যেসব খাবার প্রদাহ বাড়ায় 

  • পরিশোধিত শর্করা (সাদা ভাত, ময়দার তৈরি খাবার, বিস্কুট, পাস্তা, নুডুলস, পাউরুটি ইত্যাদি) 
  • পোড়া তেলে ভাজা খাবার (সমুচা, সিঙ্গাড়া, পেঁয়াজু, পুরি ইত্যাদি) 
  • সবধরনের ফাস্টফুড, চিপস ও কোমল পানীয় (সফট ড্রিংকস) 

প্রদাহ বাড়ায় এমন খাবারগুলো যতটা সম্ভব বর্জন করতে হবে। এছাড়াও কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মেডিটেশন ও ইয়োগা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।  

References

Furman, D. (2020, April 10). Chronic inflammation in the etiology of disease across the life span. Retrieved from PubMed Central: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC7147972/

Spritzler, F. (2023, May 23). Anti-Inflammatory Foods to Eat: A Full List. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/13-anti-inflammatory-foods

Last Updated on January 3, 2024