শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে খাবারের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে। কারণ অনেকেই দ্রুত শরীরের ওজন কমাতে গিয়ে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে এমন খাদ্যাভ্যাস বেছে নেন।  

সপ্তাহে ১ থেকে ২ পাউন্ড (০.৫ থেকে সর্বোচ্চ ১ কিলোগ্রাম পর্যন্ত) শরীরের ওজন কমানো হলো নিরাপদ। এর চেয়ে বেশি হারে ওজন কমানোর চেষ্টা করা হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করবে এমন ৯টি স্বাস্থ্যকর খাবার নিয়ে এই অনুচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

১। মাংস 

১ গ্রাম প্রোটিন থেকে ৪ ক্যালরি পাওয়া যায় যা শর্করার সমপরিমাণ। তবে প্রোটিন জাতীয় খাবার হজম ও বিপাক প্রক্রিয়ায় (Metabolism) অনেক বেশি ক্যালরি খরচ হয়। তাই শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য শর্করা জাতীয় খাবারের পরিমাণ কমাতে হবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে।  

মাংস হলো প্রোটিন জাতীয় খাবার তবে সবধরনের মাংস খাওয়া যাবে না। যেমনঃ মুরগির মাংস শরীরের জন্য অনেক উপকারী। তবে গরুর মাংস ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে চর্বিযুক্ত মাংস, কলিজা ও মুরগির চামড়া খাওয়া যাবে না। 

ফার্মের‌ মুরগির তুলনায় দেশি মুরগির মাংস বেশি স্বাস্থ্যকর। কারণ দেশি মুরগি প্রকৃতি থেকে খাবার গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে ফার্মের মুরগি যেসব খাবার খেয়ে বড় হয় তাতে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। তাই যতটা সম্ভব দেশি মুরগির মাংস খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। 

২। মাছ

fish

সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর একটি প্রোটিন হলো মাছ যা সবার জন্য খাওয়া নিরাপদ ও উপকারী হবে। প্রোটিন ছাড়াও মাছ থেকে ভালো মানের ফ্যাট (ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড) পাওয়া যায় যা শরীরের জন্য বিভিন্ন উপকারিতা বয়ে আনতে পারে।  

মাছ খাওয়া শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ সহ হার্টের রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। তাই খাবার তালিকায় সপ্তাহে অন্তত ২ দিন বা তার বেশি মাছ রাখার চেষ্টা করতে হবে। 

সামুদ্রিক মাছের পুষ্টিগুণ তুলনামূলক বেশি তবে এতে মার্কারী থাকতে পারে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই সামুদ্রিক মাছ সপ্তাহে ২ থেকে সর্বোচ্চ ৩ দিনের বেশি না খাওয়াই ভালো।

৩। ডিম 

ডিম সবচেয়ে সহজলভ্য ও মজাদার একটি খাবার যা ছোট বড় সবার কাছেই খুব প্রিয়। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদিনের খাবার তালিকায় ডিম রাখা যেতে পারে।

ডিম খাওয়া হলে দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। তবে যেকোনো ভাবে ডিম খেলেই হবে না বরং সিদ্ধ ডিম হলো সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর খাবার। তেলে ভাজা ডিমে ক্যালরির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়।

কুসুম সহ ডিম খাওয়া হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে এই ভয়ে অনেকেই ডিম পরিহার করেন। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৭ টি (প্রতিদিন ১ টি) ডিম খাওয়া হলে তা হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় না। (Lopez-Jimenez, 2022) 

যারা অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য ডিমের কুসুম খাওয়া উচিত হবে না।

৪। সবজি 

শাকসবজি হলো সবচেয়ে বেশি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন কিন্তু কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি রাখতে হবে। 

শুধু একধরনের শাকসবজি না খেয়ে বরং বৈচিত্র্যময় শাকসবজি খেতে হবে। যতটা সম্ভব কম তাপে শাকসবজি রান্না করতে হবে। কারণ আগুনের তাপে পুষ্টিগুণ কমে যেতে থাকে। 

টমেটো, গাজর, শশা, কাঁচা পেঁপে, লেটুসপাতা ইত্যাদি সালাদ হিসেবে খেলে বেশি পুষ্টিগুণ পাওয়া যাবে।

শাকসবজি হলো ভিটামিন,‌ মিনারেলস ও এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। নিয়মিত শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে।

৫। ফল 

শরীরের ওজন কমানোর জন্য ফল খাওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে অল্প পরিমাণে খাবার খাওয়ার পর পেট ভরা রাখতে ফল খাওয়ার অভ্যাস করা উপকারী হবে। 

সাধারণত ফল খুব কম ক্যালরি সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। তাই ফল খাওয়ার অভ্যাস শরীরের ওজন বাড়িয়ে না দিয়ে বরং কমাতে সাহায্য করবে। 

অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় ফল‌ বেশি পরিমাণে খাওয়া যাবে না। কারণ মিষ্টি ফল তুলনামূলক বেশি ক্যালরি সরবরাহ করে। যেমনঃ আম, কাঠাল, আপেল, আনারস, কলা, কিসমিস, খেজুর ইত্যাদি কম খেতে হবে।

ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য মিষ্টিজাতীয় ফলগুলো পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। কারণ এতে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। ফলের জুস না‌ খেয়ে বরং আস্ত ফল খেতে পারলে বেশি ভালো‌ হবে।

৬। বাদাম এবং বীজ

nuts

সহজলভ্য ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার হলো বাদাম যা শরীরের জন্য অনেক উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। শরীরের ওজন কমাতে স্ন্যাকস হিসেবে বাদাম খাওয়া যেতে পারে। (Gunnars, 2018) 

বাদাম দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। বিভিন্ন ধরনের বাদাম রয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে সস্তা হলো চীনাবাদাম যা প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখা যেতে পারে।

স্ন্যাকস হিসেবে দারুণ আরেকটি খাবার হলো বীজ অর্থাৎ কুমড়ার বিচি ও সূর্যমুখী বীজ। বীজ খাওয়ার ফলে বাদামের মতোই দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা থাকবে।

বাদাম ও বীজ খাওয়ার অভ্যাস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

যাদের ক্ষেত্রে বাদাম ও বীজ খাওয়ার ফলে এলার্জির সমস্যা দেখা যায় তাদের জন্য খাওয়া যাবে না।

৭। মিষ্টি আলু

মিষ্টি আলু কার্বোহাইড্রেট জাতীয় একটি খাবার হওয়া সত্ত্বেও শরীরের ওজন কমাতে উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। স্ন্যাকস হিসেবে মিষ্টি আলু খাওয়া হলে এতে থাকা ফাইবার দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। 

ফাইবার সমৃদ্ধ ১৪টি খাবার সম্পর্কে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।   

মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেলস ও এন্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

ওজন কমানোর জন্য দিনে ৩ থেকে ৪টির বেশি মিষ্টি আলু খাওয়া যাবে না। অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া হলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে।

ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য দিনে ১টির বেশি মিষ্টি আলু খাওয়া উচিত হবে না। কারণ এতে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।  

৮। চর্বি এবং তেল

চর্বি ও তেল (ফ্যাট) হলো সবচেয়ে বেশি ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার যার প্রতি ১ গ্রাম থেকে ৯ ক্যালরি পাওয়া যায়। তবে চর্বিযুক্ত খাবার মানেই শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেবে এমন নয়।   

স্বাস্থ্যকর ফ্যাট জাতীয় খাবার খেয়েও শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। দৈনিক ক্যালরি চাহিদার ৩০ শতাংশ ফ্যাট জাতীয় খাবার থেকে গ্রহণ করা উচিত। 

স্বাস্থ্যকর ফ্যাট বলতে মাছে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, অলিভ অয়েল, সয়াবিন তেল, বাদাম তেল, তিসির তেল, সূর্যমুখী তেল, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি বোঝানো হয়ে থাকে। 

৯। ইয়োগার্ট (Yogurt) 

ইয়োগার্ট হলো প্রোবায়োটিকস সমৃদ্ধ একটি খাবার যা শরীরের জন্য অনেক উপকারিতা বয়ে আনতে পারে। ইয়োগার্ট খাওয়া হলে দীর্ঘসময় পর্যন্ত পেট ভরা থাকে যা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সুবিধাজনক হবে।

বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ইয়োগার্ট কিনতে পাওয়া যায় যার মধ্যে থেকে সবচেয়ে কম চিনি রয়েছে এমনটি সংগ্রহ করতে হবে। 

ইয়োগার্টের সাথে ওটস (Oats) মিশিয়ে সকালের একটি দারুন নাস্তা তৈরি করা যেতে পারে যা খেতে মজাদার হবে এবং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।  

References

Gunnars, K. (2018, April 24). Top 9 Healthiest Foods to Eat to Lose Weight and Feel Great. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/top-9-healthiest-foods-to-eat

Lopez-Jimenez, F. (2022, 01 21). Eggs: Are they good or bad for my cholesterol? Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/high-blood-cholesterol/expert-answers/cholesterol/faq-20058468

Last Updated on January 1, 2024