শরীরের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী সকল মানুষের ক্ষেত্রেই মেটাবলিসমের বাইপ্রোডাক্ট (বর্জ্য) হিসেবে ক্রিয়েটিনিন তৈরি হয় এবং কিডনি সেই বর্জ্যকে ছেঁকে প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। যারা কিডনি রোগে (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ) আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে কিডনি শরীর থেকে ক্রিয়েটিনিন ছেঁকে বের করে দিতে পারে না। যার ফলে শরীরে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়। (Mayo Clinic, 2023)
ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে গেলে তার জন্য কোনো ঘরোয়া প্রতিকার নেই। বরং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ সেবন অথবা ডায়ালাইসিস করার প্রয়োজন পড়ে। কিডনি রোগীদের শরীরে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা যেন দ্রুত বেড়ে না যায় সেজন্য কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয় যা এই অনুচ্ছেদের আলোচনার বিষয়বস্তু।
Table of Contents
ক্রিয়েটিনিন কমানোর ঘরোয়া উপায়
ক্রনিক কিডনি ডিজিজের রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা, কিডনির কার্যক্ষমতা, বয়স, লিঙ্গ ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় ব্যক্তিভেদে সুনির্দিষ্ট ডায়েট প্ল্যান মেনে চলতে হয়।
নিচে বর্ণিত বিষয়গুলো কোনো সুনির্দিষ্ট ডায়েট প্ল্যান নয়, বরং কিডনি রোগীদের জন্য সাধারণ নীতিমালা হিসেবে বিবেচিত হবে।
১। কম প্রোটিন গ্রহণ
খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো প্রোটিন যা শরীরের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধি সাধনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত প্রোটিন জাতীয় খাবার রাখা জরুরী। তবে কিডনি রোগীদের জন্য পরিমিত পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। কারণ প্রোটিন গ্রহণের ফলে শরীরে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে যায়।
তবে খাদ্যতালিকা থেকে প্রোটিন জাতীয় খাবার একদম বাদ দেওয়া যাবে না। কিডনির অবস্থা বিবেচনায় শরীরের প্রতি ১ কেজি ওজনের জন্য ০.৫ থেকে ১ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে।
কিডনি রোগীদের জন্য প্রোটিন হিসেবে ডিমের সাদা অংশ, মাছ, মুরগির মাংস ইত্যাদি খেতে হবে। তবে গরু ও খাসির মাংস খাওয়া যাবে না। কারণ গরু ও খাসির মাংস খেলে ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যেতে পারে।
২। শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ
শরীরের ক্যালরি চাহিদার বেশিরভাগ অংশ শর্করা জাতীয় খাবার থেকে গ্রহণ করতে হবে। শর্করা জাতীয় খাবার মেটাবলিসমের ফলে তৈরি বর্জ্য (বাইপ্রোডাক্ট) কিডনির মাধ্যমে সহজেই ছেঁকে বের হয়ে যায়।
শর্করা জাতীয় খাবার হলো ভাত, রুটি, বিস্কুট, নুডুলস ইত্যাদি। তবে যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পরিমিত পরিমাণে শর্করা জাতীয় খাবার খেতে হবে।
৩। ফলমূল ও শাকসবজি
ফলমূল ও শাকসবজি শরীরে পানি, ভিটামিন, মিনারেলস ও এন্টি-অক্সিডেন্ট সরবরাহ করে। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত ফলমূল ও শাকসবজি রাখতে হবে। তবে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সবরকম ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া যাবে না।
প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম রয়েছে এমন ফলগুলো (যেমনঃ পাকা কলা, ডাবের পানি, নারিকেল, ডালিম, বড়ই, আমড়া, লেবু, আম, কাঁঠাল, বাদাম, খেজুর ইত্যাদি) বর্জন করতে হবে। আপেল, কমলা, পেয়ারা, আনারস, পাকা পেঁপে, জাম, বেল, তরমুজ ইত্যাদি খাওয়া যাবে।
সবজির মধ্যে লাউ, কুমড়া, বেগুন, পটল, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, শশা, করলা, ফুলকপি, ব্রকলি, কাঁচা পেঁপে, কাঁচা কলা, লাল শাক ইত্যাদি খাওয়া যাবে। পালংশাক, পুঁইশাক, ধনেপাতা, ঢেঁড়স, শিম, বরবটি, কচু, আলু ইত্যাদি বর্জন করতে হবে।
৪। সঠিক পরিমাণে পানি পান করা
ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। তবে ক্রনিক কিডনি ডিজিজের রোগীদের জন্য অতিরিক্ত (দৈনিক এক থেকে দেড় লিটারের বেশি নয়) পানি পান করা যাবে না।
এছাড়াও চা, কফি, ফলের জুস, শরবত, কোমল পানীয় ইত্যাদি না খাওয়াই উত্তম। বিশেষ করে অতিরিক্ত কফি খাওয়া যাবে না এবং কোমল পানীয় বর্জন করতে হবে। তবে গ্রীন টি খাওয়া উপকারী হতে পারে।
৫। পরিমিত লবণ খাওয়া
অতিরিক্ত লবণ এড়িয়ে চলতে হবে। খাবার খাওয়ার সময় এক্সট্রা লবণ নেওয়া যাবে না। এছাড়াও অতিরিক্ত লবণ সমৃদ্ধ খাবারগুলো বর্জন করতে হবে। যেমনঃ ফাস্টফুড, চিপস, সস, আচার ইত্যাদি খাওয়া যাবে না।
৬। ব্যথা নাশক ওষুধ কম খেতে হবে
ব্যথা নিরাময়ের জন্য চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়া ব্যথা নাশক ওষুধ সেবন করা যাবে না। আইবুপ্রোফেন, এসপিরিন, ন্যাপরোক্সেন, ক্লোফেনাক ইত্যাদি হলো বহুল ব্যবহৃত ব্যথা নাশক ওষুধ।
ব্যথা নাশক ওষুধ সেবনের ফলে ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও অতিরিক্ত ব্যথা নাশক ওষুধ খাওয়ার ফলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই ব্যথা নাশক ওষুধের ব্যবহার সীমিত করতে হবে।
৭। ধুমপান ও মদ্যপান বর্জন
ক্রিয়েটিনিন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস বর্জন করতে হবে। (Whelan, 2023)
ধুমপান ও মদ্যপান করার ফলে ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস কিডনির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস বর্জন করা জরুরী।
৮। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
বর্তমান সময়ে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস খুব কমন স্বাস্থ্য সমস্যা। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এছাড়াও রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সাথে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের যোগসূত্র রয়েছে। তাই উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট হতে হবে।
অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে। আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ সেবন অথবা ইনসুলিন ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ
অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যথা নাশক ওষুধ সেবন অথবা মারাত্মক প্রকৃতির ডায়রিয়া্র ফলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে। এই জাতীয় ক্ষেত্রে (অস্থায়ীভাবে ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়া) চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবনের মাধ্যমে সুস্থ হওয়া যায় এবং সারাজীবন ধরে ক্রিয়েটিনিন নিয়ন্ত্রণের নিয়ম-কানুন মেনে চলার প্রয়োজন হয় না।
তবে ক্রনিক কিডনি ডিজিজে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ক্রিয়েটিনিন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সারাজীবন ধরে নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে।
যেমনঃ পরিমিত মাত্রায় প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে, আঁশযুক্ত শর্করা খেতে হবে, প্রচুর পটাশিয়াম রয়েছে এমন ফলমূল ও শাকসবজি বর্জন করতে হবে, পরিমিত মাত্রায় পানি পান করতে হবে, অতিরিক্ত লবণ খাওয়া যাবে না, চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ব্যথা নাশক ওষুধ সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে, ধুমপান ও মদ্যপান বর্জন করতে হবে, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে ইত্যাদি।
Bibliography
Mayo Clinic. (2023, February 09). Creatinine test. Retrieved from Mayo Clinic: https://www.mayoclinic.org/tests-procedures/creatinine-test/about/pac-20384646
Whelan, C. (2023, March 09). 8 Home Remedies to Naturally Lower Your Creatinine Levels. Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/how-to-lower-creatinine
Last Updated on January 7, 2024
Leave A Comment