কুমড়ো বিচির খুব পরিচিত এবং সুস্বাদু একটি সবজি যার ভেতরে থাকা বিচিকে আমরা সাধারণত উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফেলে দেই। তবে আপনি জেনে অবাক হবেন যে, প্রতি ১০০ গ্রাম কুমড়োর বিচিতে বিদ্যমান রয়েছে প্রায় ৫৭৪ ক্যালরি,

এবং প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন বি, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, জিংক, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সহ গুরুত্বপূর্ণ সব পুষ্টি উপাদান। আর তাই প্রতিদিন সামান্য পরিমাণে কুমড়োর বিচি খাওয়ার মাধ্যমে আপনি পেতে পারেন নানাবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা। (Ware, 2018)

এই অনুচ্ছেদে কুমড়োর বিচির (Pumpkin seeds) বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ ১০ টি স্বাস্থ্য উপকারিতা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেই সাথে প্রতিদিন কতটুকু পরিমাণে কুমড়োর বিচি খাওয়া যাবে এবং অতিরিক্ত খেলে কি কি সমস্যা হতে পারে সেই সম্পর্কে জানতে অনুচ্ছেদটি একদম শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।

কুমড়োর বিচির ১০ টি উপকারিতা

১. হার্ট ভাল রাখে !

কুমড়োর বিচিতে পাওয়া যায় ফাইবার, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, ওমেগা সিক্স ফ্যাটি এসিড এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা হার্ট (Heart) ও লিভার ভালো রাখতে সহায়তা করে। এছাড়াও এতে রয়েছে sterols এবং phytosterols নামক বিশেষ কিছু উপাদান যা রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL-low density lipoprotein) এর মাত্রা কমায়। উল্লেখ্য LDL কোলেস্টেরল রক্তনালীতে জমে গিয়ে উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মতো গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করে।

যাদের ইতিমধ্যেই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কুমড়োর বিচি খাওয়া উপকারি হতে পারে। কারণ এতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তবে কুমড়োর বিচির সাথে লবণ মিশিয়ে খাওয়া যাবে না, কারণ তাতে লবণে থাকা সোডিয়াম রক্তচাপ বাড়িয়ে দেবে।

হার্ট ভাল রাখে

২. রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

কুমড়োর বিচিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফাইটোকেমিক্যালস (Phytochemicals) এবং ভিটামিন-ই রয়েছে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরে যে কোনো ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। আর তাই রোগের আক্রমণ ও ইনফেকশন প্রতিরোধে নিয়মিত কুমড়োর বিচি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

৩. কুমড়োর বিচি বাড়তি ওজন কমাতে সাহায্য করে !

শরীরের বাড়তি ওজন কমানোর জন্য অনেকেই ইচ্ছা পোষণ করেন কিন্তু ডায়েট কন্ট্রোল করার মতো মতো কষ্ট পেতে চান না। বিশেষত তিনবেলা খাবার গ্রহণ করা ছাড়াও অনেকেই সকাল সন্ধ্যায় বিভিন্ন রকমের হালকা নাস্তা করেন যার অধিকাংশই হয়ে থাকে ফাস্টফুড ও উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার যা শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেয়।

আপনি যদি হালকা নাস্তা হিসেবে কুমড়োর বিচি খেতে পারেন তবে শরীরের ওজন কমাতে পারবেন খুব বেশি কষ্ট ছাড়াই। কারণ, কুমড়োর বিচিতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ (Fiber) রয়েছে যা হজম হতে বেশ সময় লাগে এবং পেট ভরা থাকে অনেকক্ষণ। এতে করে বাড়তি খাবার শরীরে ঢোকার সুযোগ পায় না যার ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।

৪.কুমড়োর বিচি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনেও সাহায্য করে

কুমড়োর বিচি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনেও সাহায্য করে

টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে কুমড়োর বিচি। এর কারণ হতে পারে, কুমড়োর বিচিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়ামের উপস্থিতি। আর শরীরে ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি হওয়ার সাথে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার যোগসূত্র রয়েছে।

এছাড়াও প্রাণীদের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে যে, কুমড়োর বিচি‌ বা বিচির গুঁড়া (Powder) রক্তে সুগারের মাত্রা কমিয়ে দেয়।‌‌ (Brown, 2018) তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ওষুধ বা ইনসুলিনের পরিবর্তে কুমড়োর বিচির উপর ভরসা করা যাবে না। বরং ওষুধের পাশাপাশি সহায়ক উপাদান হিসেবে খেতে হবে।

৫. হাত-পা এবং পেশীর জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে

কুমড়োর বিচিতে রয়েছে প্রদাহ নাশক (Anti-inflammatory) গুণাবলী যা হাত-পা এবং পেশীর জ্বালাপোড়ার অনুভূতি কমাতে সহায়তা করে। সেই সাথে বাতের ব্যথা (arthritis) কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে বলে কিছু কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে। এছাড়াও অস্থিসন্ধির ব্যথা কমাতে বাহ্যিকভাবে‌‌ কুমড়ো বিচির তেল ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায়।

৬. প্রোস্টেট এর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে

অধিকাংশ পুরুষের ক্ষেত্রেই ৫০ বছরের পর থেকে প্রস্টেট গ্রন্থির একটি কমন সমস্যা দেখা দেয় যাকে মেডিক্যালের ভাষায় BPH (Benign prostatic hyperplasia) বলে। এক্ষেত্রে প্রস্রাব নিঃসরণ ও বীর্যপাত সম্পর্কিত নানাবিধ অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যায়।

১৪০০ জন পুরুষ মানুষের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে যে, নিয়মিত কুমড়োর বিচি খাওয়ার ফলে প্রস্টেট সমস্যা (BPH) সম্পর্কিত লক্ষণগুলো অনেকটাই কমে যায়। তবে BPH এর চিকিৎসায় সাপ্লিমেন্ট হিসেবে এটি ব্যবহার করা যাবে কিনা সেই বিষয়ে এখনো গবেষণা বিদ্যমান রয়েছে। (Brown, 2018)

পুরুষের প্রস্টেট গ্রন্থির সমস্যা (BPH) ছাড়াও কুমড়োর বিচিতে থাকা কিছু বিশেষ পুষ্টিগুণ নারী ও পুরুষ উভয়ের মুত্রথলির কার্যক্ষমতা ভালো রাখতে সহায়তা করে।

৭. পুরুষের ক্ষেত্রে শুক্রাণুর (Sperm) গুণগত মান বৃদ্ধি করে 

গবেষণায় দেখা গেছে যে, একজন পুরুষের শরীরে জিংকের ঘাটতি হওয়ার সাথে শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণগত মান কমে যাওয়া সহ পুরুষের ইনফারটিলিটি সমস্যা হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। কুমড়োর বিচিতে প্রচুর পরিমাণে জিংক রয়েছে যা শুক্রাণু ভালো রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও এতে বিদ্যমান ভিটামিন ই, সেলেনিয়াম ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট একজন পুরুষের শরীরে যৌন হরমোনের (Testosterone) উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে।

৮. ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে

খাদ্য তালিকায় নিয়মিত কুমড়োর বিচি রাখলে তা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমনঃ

  • পাকস্থলী ক্যান্সার
  • স্তন ক্যান্সার (Breast cancer)
  • ফুসফুসের ক্যান্সার
  • কোলন ক্যান্সার
  • প্রস্টেট গ্রন্থির ক্যান্সার ইত্যাদি

দীর্ঘমেয়াদী একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেনোপজের (Menopause) পরবর্তী স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশেই হ্রাস করতে সহায়তা করে কুমড়োর বিচিতে বিদ্যমান lignans নামক বিশেষ একটি উপাদান। (Brown, 2018)

স্তন ক্যান্সার কেন হয় এবং কিভাবে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব সেই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।

৯. ভালো ঘুমে সাহায্য করে!

ভালো ঘুমে সাহায্য করে

ভালো ঘুমে সাহায্য করে

প্রাকৃতিক ঘুমের উষুধ পাওয়া যায় কুমড়োর বিচিতে। কারণ এতে বিদ্যমান ট্রাইপটোফ্যান (tryptophan) নামক বিশেষ একটি অ্যামিনো অ্যাসিড শরীরে গিয়ে স্নায়ু নিয়ন্ত্রক সেরোটোনিনে রূপান্তরিত হয় যা ভালো ঘুম নিশ্চিত করে। এছাড়াও কুমড়োর বিচি থেকে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায় যা ভালো ঘুমের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। আর তাই রাতের বেলায় মুঠোভর্তি কুমড়োর বিচি আপনাকে এনে দিতে পারে পুরো রাত্রির জন্য শান্তিময় ঘুম।

১০. চুলের যত্নে কুমড়োর বিচি 

কুমড়ো বিচির তেল চুলের যত্নে ব্যবহার করার মাধ্যমে চুল পড়া সমস্যার সমাধান এবং নতুন চুল গজাতে সহায়তা করে। কুমড়োর বিচিতে থাকা ভিটামিন-ই এবং Phytosterols এর উপস্থিতি চুলের যত্নে ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হয়। চুলের জন্য কুমড়োর বিচির তেলের উপকারিতা বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে এতটুকু বলা যায় যে, এটি নিরাপদ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত। আর তাই আপনি চাইলে ব্যবহার করার মাধ্যমে এর কার্যকরীতা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। (White, 2018)

কুমড়োর বিচি কি পরিমাণে খাওয়া যাবে?

কুমড়োর বিচি আপনি বিভিন্ন ভাবে খেতে পারেন। যেমনঃ কাঁচা অবস্থায় অথবা সামান্য টেলে বা কেক, স্যুপ ও সালাদ হিসেবে।‌ তবে দৈনিক সর্বোচ্চ একটি কাপের চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ বা ৩০ গ্রামের বেশি খাওয়া উচিত নয়। কারণ তাতে পেটে গ্যাস এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। (Dhanorkar, 2020) উল্লেখ্য কুমড়োর বিচি সংরক্ষণ করতে চাইলে রোদে শুকিয়ে শুষ্ক কাঁচের জারে সংরক্ষণ করুন। এতে করে ৩ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত পুষ্টিগুণ ভালো থাকবে।

কুমড়োর বিচি একটি পুষ্টিকর খাবার, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটি কোনো ওষুধ নয় যা রোগ সারিয়ে ফেলতে পারে। আর তাই অতিরঞ্জিত ধারণা থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া উচিত নয়। বরং প্রতিদিন খাবারের সাথে অথবা হালকা নাস্তা হিসেবে পরিমিত মাত্রায় খেতে থাকুন।

 

References

Brown, J. (2018, september 24). top 11-benefits-of-pumpkin-seeds . Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/nutrition/11-benefits-of-pumpkin-seeds

Dhanorkar, A. (2020, 12 16). How Much Pumpkin Seeds Should I Eat Per Day? Retrieved from MedicineNet: https://www.medicinenet.com/how_much_pumpkin_seeds_should_i_eat_per_day/article.htm

Ware, M. (2018, july 24). What are the health benefits of pumpkin seeds? Retrieved from medical news today: https://www.medicalnewstoday.com/articles/303864

White, A. (2018, may 30). Pumpkin Seed Oil for Hair Loss: Does It Work? Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/pumpkin-oil-for-hair

 

Last Updated on April 16, 2023