একজন মানুষের শরীর সুস্থভাবে চলতে হলে প্রতিনিয়ত কিছু মিনারেল আবশ্যক। এইসব মিনারেলের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আয়রন। যে রক্তের প্রবাহের উপর পুরো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্বাভাবিকতা নির্ভর করে, সেই রক্ত উৎপাদনের জন্যই অতি দরকারি একটি উপাদান হচ্ছে আয়রন। শরীরে আয়রনের ঘাটতি থেকে হয় রক্তস্বল্পতা, যার ফলাফল হিসেবে হয় হৃদরোগ, স্ট্রোক, থ্যালাসেমিয়া এমনকি অভ্যন্তরীণ কোন অঙ্গের স্থায়ী ক্ষতিও!
Table of Contents
আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
আয়রনের এতো গুরুত্বের কথা বিবেচনা করলে বলতেই হয় যে, দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় আয়রন সমৃদ্ধ খাবার রাখার দরকার খুবই বেশি। তবে এর জন্য কোন খাবারগুলোয় ভালো পরিমাণে আয়রন আছে, সেই সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরী। চলুন জেনে নেই আয়রনে ভরপুর এমনই কিছু খাবারের কথা। (M. Bell, 2020)
#১. লিভার
লিভার বা কলিজা, আয়রনের একটি সমৃদ্ধ উৎস। আয়রনের ঘাটতি মেটাতে মুরগি, গরু বা খাসীর কলিজা খাওয়া যেতে পারে। তবে গরুর কলিজায় তুলনামূলকভাবে আয়রনের পরিমাণ বেশি।
“১০০ গ্রাম গরুর কলিজায় ৬.৫ মিলিগ্রাম পরিমাণ আয়রনের উপস্থিতি থাকে, যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক আয়রনের চাহিদার প্রায় ৩৬ শতাংশ।”
তবে কলিজায় কিন্তু বেশ ভালো পরিমাণ কোলেস্টেরলও আছে! তাই খুব বেশি পরিমাণে না খেয়ে সপ্তাহে অন্তত একদিন কলিজা খেতে পারেন।
#২. ঝিনুক
সী-ফুডের মধ্যে সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া, স্কুইড ইত্যাদি অনেকে স্বাচ্ছন্দে খেলেও, ঝিনুক খাওয়ার প্রচলনটা এখনো কিছুটা কম। তবে জেনে রাখা ভালো, ঝিনুকে কিন্তু আয়রনের উপস্থিতি প্রচুর।
“১০০ গ্রাম ঝিনুকে পাওয়া যায় প্রায় ৩ মিলিগ্রামের মতো আয়রন। যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক আয়রনের চাহিদার প্রায় ১৭ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম।”
ঝিনুকে থাকা আয়রন মানুষের শরীরে শোষণ হয় খুব সহজেই ও দ্রুত। যা শরীরের বাতের ব্যাথা, মাংসপেশির জড়তা ইত্যাদি কাটাতে কার্যকরী।
#৩. পালং শাক
ক্যালোরি নেই বললেই চলে, কিন্তু আয়রন ও অন্যান্য পুষ্টিগুণে ভরপুর- এমনই একটি খাবার হচ্ছে পালং শাক।
“একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক আয়রনের চাহিদার প্রায় ১৫ শতাংশ পূরণ করতে পারে ১০০ গ্রাম পালং শাকে থাকা ২.৭ মিলিগ্রাম আয়রন।”
পালং শাকের উদ্ভিজ্জ আয়রন খাওয়ার পর ধীরে ধীরে শরীরে শোষণ হয় এবং কাজ করে শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় যায়গায়। রান্না কিংবা সেদ্ধ, বিভিন্ন উপায় রয়েছে আয়রন সমৃদ্ধ এই পালং শাক খাওয়ার।
#৪. লেটুস
আয়রন সমৃদ্ধ উদ্ভিজ্জ খাবারগুলির মধ্যে আরেকটি হচ্ছে সবুজ লেটুস পাতা।
“১০০ গ্রাম লেটুস পাতায় পাওয়া যায় ০.৯ মিলিগ্রাম পরিমাণ আয়রন।”
পরিমাণে সামান্য হলেও প্রতিদিনের খাবার তালিকায় সালাদের সাথে লেটুস রাখা গেলে, আপনার ও আপনার পরিবারের দৈনিক আয়রনের চাহিদার অনেকটাই মেটানো যাবে।
#৫. মাংস
আপনার পছন্দের খাবার মাংসই কিন্তু শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় আয়রনের চাহিদা পূরণের অন্যতম উৎস! বিশেষ করে গরুর মাংস।
“১০০ গ্রাম গরুর মাংসে আছে ২.৭ মিলিগ্রাম আয়রন। যা একজন মানুষের দৈনিক চাহিদার প্রায় ১৫ শতাংশ।”
উদ্ভিজ্জ আয়রনের তুলনায়, মাংসে থাকা আয়রন শরীরে শোষণও হয় তাড়াতাড়ি। গবেষকরা এমনও দাবী করেন যে, যেসব মানুষ মাংস খায় না বা খুবই কম খায়, তাদের মধ্যে আয়রনের ঘাটতি জনিত সমস্যা বেশি দেখা যায়।
তবে পরিমাণমত অবশ্যই। আয়রনের চাহিদা মেটাতে যেয়ে আবার কোলেস্টেরল বাড়ান যাবেনা।
#৬. কুমড়ার বিচি
বড় খাবারের মাঝে ছোটখাটো ক্ষুধা মেটাতে পুষ্টিকর স্ন্যাক হিসেবে কুমড়ার বিচি এর তুলনা হয় না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ক্ষুধা মেটানোর পাশাপাশি শরীরে আয়রনের চাহিদা মেটাতেও কুমড়ার বিচির তুলনা নেই।
“মাত্র ২৮ গ্রাম কুমড়ার বিচিতেই থাকে ২.৫ মিলিগ্রাম আয়রন। যা আপনার প্রতিদিনের আয়রনের চাহিদার প্রায় ১৪ শতাংশই পূরণ করতে পারে।”
ভাজা ছাড়াও, সেদ্ধ, রান্না বা সালাদের সাথেও খাওয়া যেতে পারে কুমড়ার বিচি।
#৭. ব্রকলি
জন্মগত দিক দিয়ে বিদেশী সবজি হলেও, বর্তমানে বাংলাদেশেও উৎপাদন হচ্ছে সবুজ এই সবজিটি। স্বাদ ও পুষ্টিগুণের কারনে মানুষের কাছে জনপ্রিয়ও বেশ। সুস্বাদু এই সবজিটিই কিন্তু আয়রনের বেশ ভালো একটি উৎস। সেদ্ধ বা রান্না যেকোনো ভাবে খাওয়া যেতে পারে সবজিটি। দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় যত শাকসবজি থাকে, তাদের মধ্যে ব্রকলিকে যুক্ত রাখলে, ঝুঁকি কমবে আয়রন ঘাটতি ও রক্তশূন্যতা জনিত বিভিন্ন অসুখের।
#৮. ডার্ক চকলেট
চকলেট পছন্দ না, এমন মানুষ খুজে পাওয়াই দুষ্কর। চকলেট যখন খাবেনই, তখন না হয় স্বাস্থ্যকর চকলেটটাই খেলেন। বলছি ডার্ক চকলেটের কথা। যেটায় ফ্যাট ও চিনির পরিমাণ কম থাকলেও আয়রন আছে বেশ ভালো পরিমানেই।
“৩.৫ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে প্রতি ২৮ গ্রাম ডার্ক চকলেট এ। যা একজন মানুষের দৈনিক আয়রনের চাহিদার প্রায় ১৯ শতাংশই পূরণ করতে পারে।”
#৯. টফু
সয়ার দুধ থেকে তৈরি এক প্রকার উদ্ভিজ্জ পনিরকে বলা হয় টফু। সাধারণত উদ্ভিজ্জ প্রোটিন জাতীয় খাবারগুলোর একটি উৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয় টফুকে। তবে, প্রোটিন ছাড়াও আরেকটি প্রয়োজনীয় উপাদান, আয়রনেরও উৎকৃষ্ট উৎস কিন্তু টফু।
দুধের তৈরি পনির আর উদ্ভিজ্জ পনির টফুর মধ্যে পার্থক্যটাই হচ্ছে, দুধের পনিরে ক্যালসিয়াম বেশি থাকে, আর টফুতে বেশি থাকে আয়রন।
“প্রতি আধা কাপ বা ১২৬ গ্রাম টফুতে থাকে ৩.৪ মিলিগ্রাম আয়রন। যা একজন মানুষের প্রতিদিনের আয়রনের মোট চাহিদার প্রায় ১৯ শতাংশই পূরণ করতে পারে।”
তরকারি, সবজি, সালাদ, নুডলস, পাকোরা ইত্যাদি নানান উপায়ে খাওয়া যেতে পারে আয়রনে ভরা টফু।
#১০. মাছ
নানান ভিটামিন, খনিজ ও পুষ্টিগুণে ভরপুর আরেকটি আমিষ জাতীয় খাবার হচ্ছে মাছ। এতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদানের সাথে রয়েছে আয়রনও। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ ও ছোট মাছ। খুব ঘন ঘন সামুদ্রিক মাছ হয়তো খাওয়া হয় না। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের আয়রনের ঘাটতি রোধ করতে খাবারের তালিকায় ছোট মাছ কিন্তু প্রায়ই রাখা যেতে পারে।
একজন মানুষের শরীরের জন্য আয়রন এমনই অতি জরুরী একটি উপাদান, যার সামান্য ঘাটতি হলেই, শরীরে ক্লান্তি, শক্তি কমে যাওয়া, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরানো, ঝিমঝিম করার মতো সমস্যা দেখা দেয়। খিটখিটে হয়ে যায় মন মেজাজ। সাথে বড় বড় অসুখের ঝুঁকি তো আছেই। আর এই কারনেই একটি পরিবারের সকল বয়সী সদস্যের আয়রনের চাহিদা পূরণে, আয়রন যুক্ত খাবার প্রতিদিনের খাবার তালিকায় থাকা জরুরী। হতে পারে সেটা প্রানিজ, কিংবা উদ্ভিজ্জ। কারণ, অসুখবিসুখ দূরে রেখে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনধারা মেনে চলাও জরুরী।
Reference
M. Bell A. (2020, January 27) 12 Healthy Foods That Are High in Iron, Retrieved from Healthline: https://www.healthline.com/nutrition/healthy-iron-rich-foods
Last Updated on October 16, 2023
Leave A Comment