বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রায় ২৮ কোটি মানুষ বিষন্নতায় (Depression) আক্রান্ত এবং প্রতিবছর ৭ লাখের বেশি মানুষ বিষন্নতা জনিত কারণে আত্মহত্যা করে। মহিলাদের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি (দিগুণ) দেখা যায়। (World Health Organization, 2023)

বিষন্নতা‌ নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আমাদের দেশে বিষন্নতার জন্য চিকিৎসা গ্রহণের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে অনীহা দেখা যায়। এই অনুচ্ছেদে বিষন্নতার কারণ, লক্ষণ সমূহ, রিস্ক ফ্যাক্টর ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

ডিপ্রেশন কি?

ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা হলো খুব কমন একটি মানসিক সমস্যা। বেশিরভাগ সময়েই মন‌ খারাপ থাকা বা কোনো কিছুতেই আনন্দ বা আগ্রহ না পাওয়া হলো বিষন্নতার লক্ষণ।

বিষন্নতার ফলে শারীরিক সমস্যা সহ কাজে কর্মে মনোযোগ কমে যায়। অর্থাৎ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয় এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা (কাজ, খাওয়া, ঘুম ইত্যাদি) ব্যাহত হয়। 

ডিপ্রেশনের লক্ষণ

যুক্তরাষ্ট্রের সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, নিচে উল্লেখিত লক্ষণগুলো একটানা দুই সপ্তাহ বা‌ তার বেশি সময় ধরে দেখা গেলে বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়েছে বলে ধরা হয়। (American Psychiatric Association, 2020)  

  • বেশিরভাগ সময় মন খারাপ থাকা
  • কোনো কিছুতেই (বিনোদন) আগ্রহ থাকে না এবং আনন্দ পায় না 
  • খাওয়ার প্রতি অরুচি বা অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের প্রবণতা (শরীরের ওজন কমা বা বেড়ে যাওয়া)
  • ভালো ঘুম না হওয়া বা অতিরিক্ত ঘুমানো (প্রয়োজনের চেয়ে বেশি) 
  • শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি বোধ 
  • চলাফেরায় ধীরগতি হয়ে যাওয়া 
  • নিজের ব্যাপারে নেতিবাচক চিন্তা করা বা খারাপ কিছুর জন্য দায়ী মনে করা (Guilty feeling)
  • কাজে মনোযোগ দিতে না পারা, চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং সিদ্ধান্ত নিতে না পারা 
  • মৃত্যু বা আত্মহত্যার চিন্তা করা 

ডিপ্রেশন কেন হয়?

নানাবিধ কারণে ডিপ্রেশন হয়ে থাকে। যেমনঃ 

  • প্রিয়জন হারানোর শোক 
  • বেকারত্ব সমস্যা বা দরিদ্রতা 
  • জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনা 
  • পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি  
  • মদ্যপান বা অন্যান্য নেশাদ্রব্য গ্রহণ  

মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায়, বাচ্চা প্রসবের পর, পিরিয়ড (Menstruation) ও মেনোপজের সময় শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটে এবং এর ফলে ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে।

বিষন্নতার ঝুঁকির কারণ (রিস্ক ফ্যাক্টর) 

যেকোনো বয়স ও লিঙ্গের মানুষের ক্ষেত্রে বিষন্নতা হতে পারে। তবে কতিপয় ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি রয়েছে যাকে বিষন্নতার রিস্ক ফ্যাক্টর বলা হয়। যেমনঃ 

  • পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ বেশি‌ থাকে। এর কারণ হলো শরীরে হরমোনের পরিবর্তন, সামাজিকভাবে নারী পুরুষের অসমতা, যৌন হয়রানির ইতিহাস ইত্যাদি।  
  • শিশু বয়সে আঘাত বা অত্যাচারের ইতিহাস থাকলে তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। 
  • বিষন্নতার পারিবারিক ইতিহাস অর্থাৎ মা বাবা বা ভাই বোনদের মধ্যে কারো বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকলে সেই সন্তান বা সহোদরের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকি রয়েছে।  
  • মস্তিষ্কের গঠন ও রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তনের সাথে বিষন্নতার যোগসূত্র রয়েছে। 
  • কতিপয় রোগে (বিশেষ করে ক্রনিক ডিজিজ যার ফলে দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা বা যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়) আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। 
  • যারা অর্থনৈতিক সমস্যায় ভোগেন তাদের ক্ষেত্রে বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে। 
  • শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতির সাথে বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। 
  • কতিপয় ওষুধ (সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে) বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। যেমনঃ জন্মনিরোধক পিল, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, বিটা-ব্লকার গ্রুপের ওষুধ ইত্যাদি।  

রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে মানে বিষন্নতায় আক্রান্ত হবেই এমন কোনো কথা নেই। রিস্ক ফ্যাক্টর থাকা মানে হলো বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি রয়েছে। আবার রিস্ক ফ্যাক্টর না থাকলে বিষন্নতা হবেই না এমন কোনো কথা নেই। অর্থাৎ রিস্ক ফ্যাক্টর ছাড়াও বিষন্নতা হতে পারে তবে সম্ভাবনা খুবই কম।

ডিপ্রেশনের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা

ডিপ্রেশন মৃদু (Mild), মধ্যম (Moderate) ও তীব্র (Severe) প্রকৃতির হয়ে থাকে। আপনি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত কিনা বা ডিপ্রেশনের কোন পর্যায়ে রয়েছেন তা একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর সহায়তায় নির্ণয় করতে হবে।

শারীরিক অসুস্থতা নির্ণয়ের মতো ডিপ্রেশনের জন্য তেমন কোনো টেস্ট (রক্ত পরীক্ষা, এক্সরে বা আল্ট্রাসনোগ্রাফি) করানো যায় না। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট বিভিন্ন মানসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ডিপ্রেশন নির্ণয় করে থাকেন। যেমনঃ রোগীর আচরণ পর্যবেক্ষণ করা, রুগীর মুখে সমস্যার বিস্তারিত বর্ণনা শোনা, বিভিন্ন প্রশ্ন করা ইত্যাদি।   

থাইরয়েডের সমস্যা, ব্রেইন টিউমার, শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিনের অভাব ইত্যাদি নানাবিধ কারণে ডিপ্রেশের অনুরূপ লক্ষণ দেখা যায়। তাই এইসব সমস্যা রয়েছে কিনা তা জানার জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। যেমনঃ শরীরে ভিটামিনের মাত্রা ও থাইরয়েডের সমস্যা সম্পর্কে জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা এবং ব্রেইনের জন্য সিটি স্ক্যান বা এমআরআই। 

ডিপ্রেশনের চিকিৎসা

বিষন্নতা নিরাময়ের জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্ট চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হতে হবে। নিয়মিত ওষুধ সেবন এবং কাউন্সেলিং (Counselling) গ্রহণের মাধ্যমে বিষন্নতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। 

কাউন্সেলিং 

consultation

বিষন্নতার প্রথম ও প্রধান চিকিৎসা হলো কাউন্সেলিং যা একজন সাইকিয়াট্রিস্ট প্রদান করে থাকেন। কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে সাইকিয়াট্রিস্ট রোগীকে সঠিকভাবে চিন্তা করতে শেখায় এবং বিষন্নতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেন। 

মৃদু প্রকৃতির বিষন্নতার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কাউন্সেলিং এর মাধ্যমেই সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব।

ওষুধ

সাধারণত মৃদু প্রকৃতির বিষন্নতার ক্ষেত্রে কোনো ওষুধ সেবন করতে হয় না। তবে মধ্যম ও তীব্র প্রকৃতির বিষন্নতার জন্য ওষুধ সেবনের প্রয়োজন পড়ে। বিষন্নতা নিরাময়ের জন্য যেসব গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করা হয় তা হলোঃ (Higuera, 2023) 

  • SSRIs (Selective serotonin reuptake inhibitors)
  • SNRIs (Serotonin and norepinephrine reuptake inhibitors)
  • NDRIs (Noradrenaline and dopamine reuptake inhibitors)
  • MAOIs (Monoamine oxidase inhibitors) 
  • Tricyclic and tetracyclic antidepressants
  • N-methyl D-aspartate (NMDA) antagonists 

সাইকিয়াট্রিস্ট এর নির্দেশনা অনুযায়ী সঠিক নিয়ম মেনে বিষন্নতা নিরাময়ের ওষুধ সেবন করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না। তবে ওষুধ চলাকালীন সময়ে কোনো জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সেক্ষেত্রে ওষুধ সেবন বন্ধ রেখে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

বিষন্নতা থেকে মুক্তির উপায় 

meditation

বিষন্নতা থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়ার জন্য এবং পরবর্তীতে বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে জীবন যাপন পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। যেমনঃ 

  • অলস জীবন যাপন না করে নিজেকে কর্মব্যস্ত রাখতে হবে।
  • নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। বিশেষ করে ইয়োগা ও মেডিটেশন মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। 
  • পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। 
  • সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে এবং ভালো ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।  
  • মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে তা বর্জন করা জরুরী। 
  • দুর্ঘটনা ও দুঃখজনক পরিস্থিতি প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করতে হবে যেন সাপোর্ট পাওয়া যায়। 
  • প্রয়োজনে মানসিক সাপোর্ট এর জন্য সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরণাপন্ন হতে হবে। 

ভালো ঘুম নিশ্চিত করার টিপস জানতে এই অনুচ্ছেদটি পড়ুন।  

শেষ কথা

শরীরের অসুস্থতার মতোই বিষন্নতা একটি মানসিক রোগ। শরীরের অসুস্থতায় যেমন চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় তেমনিভাবে বিষন্নতা নিরাময়ের জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরণাপন্ন হওয়ার ব্যাপারে অনীহা বা সংকোচ বোধ করা যাবে না। 

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য বিষন্নতা সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা (বিশেষ করে বিষন্নতার লক্ষণ জানা থাকতে হবে) থাকা উচিত। আপনার প্রিয়জন বা বন্ধুবান্ধব বিষন্নতায় ভুগলে তাকে যতটা সম্ভব মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করুন।  

Bibliography

American Psychiatric Association. (2020, October). What Is Depression? Retrieved from American Psychiatric Association: https://www.psychiatry.org/patients-families/depression/what-is-depression

Higuera, V. (2023, August 15). Everything You Need to Know About Depression (Major Depressive Disorder). Retrieved from healthline: https://www.healthline.com/health/depression

World Health Organization. (2023, March 31). Depressive disorder (depression). Retrieved from WHO: https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/depression

Last Updated on January 4, 2024